মুখোশের ফাঁকে
শফিক নহোর
বেলা রানী আমাদের গ্রামের মেয়ে। ও ছিল আমার শৈশবের খেলার সাথী। আমি আর বেলা কামারহাট সরকারি স্কুলে এক সাথেই পড়তাম। বেলা রানী জেলে পাড়ার মেয়ে। এজন্য তাকে কেউ পছন্দ করতো না। উঁচু জাতের ছেলেমেয়ের সাথে ওর খেলাধুলাকে গ্রামের কেউ কেউ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতো।
তখন গ্রামে জগো পাগলি নামে একটা মেয়ে ছিল। আমরা তাঁকে পেছন থেকে ঢিল ছুঁড়ে মারতাম। ঢিল দিয়ে হুট করে খেজুর গাছের আড়ালে লুকিয়ে যেতাম। ঢিল খেয়ে জগো পাগলি পেছনে ফিরে দেখতো কেউ নেই।
জগো পাগলি মনের সুখে গান গাইতো। ধুলোপড়া রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেত নদীর পাড়ে। পায়ের তলায় কোনোকিছু পড়লে রাস্তায় ফেলে রাখতো না। অথচ এই জগো পাগলির উপর অমানবিক অত্যাচার চলতো। সারাদিন এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরতো। বিকেল হলে খেলার মাঠেও ঘুরে বেড়াতো। কখনো কখনো একাএকাই উঁচুস্বরে হেসে উঠতো। কিন্তু খানিকপরেই চোখের দিকে তাকালে দেখতাম, পাগলির দু’চোখের ধারা মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে । মাঝেমধ্যেই নিজের মাথার চুল নিজেই টেনে টেনে ছিঁড়তো। তখন বিড়বিড় করে কী যেন বলতো। কথাগুলো সহজে বুঝা যেত না। কাজ একটু কম করলে পাতে খাবারও কম উঠতো। ঘানি টানার গরু থাকা সত্বেও তাকে দিয়েই ঘানি টানায়ে নিত আলতাব শেখের স্ত্রী । জগো পাগলী ক্ষণেক্ষণে হেসে উঠতো, কখনো চোখের জল গড়িয়ে পড়তো। জগো পাগলীর আরেকটা কষ্ট ছিল- রাতের আকাশের মতো একাকী চাঁদকে পাহারা দেওয়া। পাখিডাকা ভোরে কুয়ো থেকে পানি তুলে আনতে হত। রান্নাঘর থেকে শুরু করে গোয়ালঘর পর্যন্ত দরকারি পানির যোগান দিতে হতো। ঘরে প্রয়োজনীয় খাবার ছিল না। কোনো কোনোদিন সকালে বা দুপুরে না খেয়ে থাকতে হতো। পাতিলপোড়া ভাত, মাছছাড়া তরকারি ছিল প্রায় প্রতিদিনের রাতের খাবার। অনেকেই বলতো ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে পাগলিটাকে কেউ মেরে ফেললেই ভালো হতো। এতটা কষ্টের কিছুই টের পেতে না!
নিয়মিতই সংসারের ঘানি টানছে জগো পাগলি। মানুষ পরের দুঃখ দেখে শুধু হাহুতাশ করে, কাজের কাজ কিছুই করতে পারে না। মুখে শুধুই ফাঁকাবুলি আর রঙবেরঙের কথা! এরা কুটনি বুড়ির মতোই সবার কাছে প্রিয়। এরা আসলে দুমুখো সাপ।
কুয়োর জলে জগো পাগলি দড়িবাঁধা কলস ফেললে জলের ভেতরে দুটো মুখ চাঁদের মতো হেসে উঠতো। জল ভর্তি কলস উঠানোর সময় কিছু জল ছলাৎ ছলাৎ করে নিচে পড়তো। তখন মনে হতো জাগো পাগলির চোখের জল কুয়োর পানিতে গড়িয়ে পড়ছে। জগো পাগলি একটা সময় ঘানি টানতে পারতো না। অভাবের সংসার। সৎ মা রাতে আধাথালা খাবার দিতো। যে কারণে কিছুদিন পরেই কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছিল। শরীরের হাড়হাড্ডি গোণা যেত। গলার হাড়ও বেড়িয়ে পড়েছিল। তারপরও সৎমা জোর করে ঘানির জোয়াল কাঁধে তুলে দিতো।
দুই চক্কর দেবার পরেই জগো পাগলি কেঁদে কেঁদে বলতো, মা গো, আমি আর পারছি না। আমারে তুমি মেরে ফেল।
হারামজাদি সংসারে খাবি, আর ঘানি টানবি না?
মরলে তো শান্তি পেতাম। মরতে পারিস না পোড়ামুখী।
মা আমারে একটু পানি দাও।
মরে গেলে খাস। এখন পানি খেয়ে কী তোর পরাণ ভরবে? আমার সংসারে তুই হয়েছিস কাল! মরলে তো আরাম আয়েশ করে খেতে পারতাম!
যখন জাগো পাগলি আর ঘানি টানতে না পারতো, তখন শরীরে খেজুরকাঁটার খোঁচা দিয়ে বলতো, হারামজাদী, ঘানি টানবি না, বল টানবি না? মুখে কথা নাই কেন?
তখন সে অশ্রুসাগরে নীরবে সাঁতার কাটতো, আর বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে ঘানি টানতো।
মা, আমি ঘানি টানবো।
জাগো এসব ঘটনা ওর বাবাকে বলতো না। কারণ, জাগোর বাবা এতকিছু জানলে ভীষণ রেগে যাবে। তাছাড়া ও চায় না, ওর বাবা যেন কষ্ট পাক। শুধু বলতো, মা, বাবায় জানি না বুঝে, তুমি আমারে এইভাবে মারছো।
একথা শুনে সৎমায়ের চোখ মুহূর্তেই রক্তলাল। নির্মমতায় মায়ের হৃদয় যেন শুকিয়ে মরুভূমি হতে লাগলো।
জগো পাগলি সবকিছু বুঝতে পারতো। কথা বলতে গেলে স্পষ্ট করে বলতে পারতো না, মুখে জড়িয়ে যেত। বাড়ির ভেতরে সৎ মায়ের অত্যাচার, বাইরে মানুষ ঢিল। কেউ কেউ পোদ্দার বাড়ির জঙ্গলে নিয়ে যেতে চাইতো। ওরা যেন মানুষ নয়, মানুষখেকো বাঘ। অথচ সেই পোদ্দার বাড়ির জঙ্গলে রান্নার জন্য গাছের ঝরেপড়া পাতা কুড়াতে যেতে হত। জগো পাগলির কুড়ানো পাতায় তিনবেলার রান্না হত। তার খাবার ছিল শুধুমাত্র রাতে!
মনের ভেতরে শেয়াল-কুকুরের কোনো ভয় ছিল না। তবে পুরুষ মানুষ দেখলে ভয়ে পিলে চমকে যেত। এইতো মানুষ খাওয়া রাক্ষস।’
জগো পাগলির বাবা ছিল আলাভোলা মানুষ। বউ তাকে শাড়ির আঁচলেই প্যাঁচিয়ে রাখতো। মেয়ে লতার মতো বড় হয়েছে, সে খেয়াল আলতাব শেখের নেই। ভোরবেলা তৈলের ঘটি নিয়ে গাঁওয়ালে বের হত, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতো। বাড়ি ফিরে কুয়ো থেকে পানি তুলে গোসল করতো। গোসলের আগে সারা গায়ে সরিষার তৈল মেখে নিতো।
একদিন চাদিতে হালকা তৈল মেখে গায়ে পানি ঢালতে ঢালতেই জগোকে বললো,
তোর মায়েরে ক, আমার জন্যি ভাত বাড়তে। খিদায় মনেহচ্ছে পুরা দুনিয়া চাবায়া খাই।
“বাজান, তোমার তবন আর গামছা নিয়ে আইতাছি” বলেই জগো কেমন জানি গুঙানি দিয়ে উঠলো। মুখ বেয়ে লালা পড়তে লাগলো! হুট করে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো সে।
আলতাব শেখ বউকে ডাক দিয়ে বললো, “শুনছো নাকি ? জগো মাটিতে পইড়া গেছে ওরে ঘরে নেও।”
মাগি বাপরে দেখলে আহ্লাদ দেখায়। শোন, তোমার মেয়ে তিনবেলা বইসা বইসা খাইবো। সংসারের চারআনার কাম তো দূরের কথা ভাতে জ্বাল দিতেও চায় না। অহন ঢঙ দেখায়া মাটিতে পইড়া গেল!
তোমারে বুঝাইতে চায়, আমি সৎ মা। ঠিক মতো খাওন দেই না। মাইনশে দেইখ্যা আমারে আর তোমারে মন্দ বলুক। মাইয়া নাতো, দুধকলা দিয়া কালসাপ পুষতাছি!
তুমি অর বাপ, তাই বুঝো না। আমি ঠিকই বুঝি।
আলতাব শেখ গোসল করে তবন উঠোনের তারে ছড়িয়ে দিয়ে ঘরের বারান্দায় গিয়ে বললো,
মা মরা মেয়ে। ওরে একটু দেইখ্যা রাইখো, বউ।
আমি তোমার সংসার দেখবো, না ঘানি টাইনে তেল বাইর করবু। তেল যুদি না হয় গাঁওয়ালে গিয়ে কি বেচবা? বেচা না থাকলে কী খাইবা? মেয়ের চেহারা ধুইয়া পানি খাইলে কি সংসার চলবো? তোমার সংসারে আমিই বেশি! আমারে আমার বাপের বাড়ি পাঠায়া দেও।
শোনো, আমার বাবার বাড়ি কোনো কিছুর অভাব নাই।
‘আমারে আর জগো রে খাইতে দাও।’
তোমার মাইয়া খায়াও ভান ধরছে।
তুমি খায়া নেও।
মাগির শরীর ভর্তি তেজ।
রাতের অন্ধকার যতো গভীর হয় জগোর পেটের ক্ষুধা ততোই বাড়তে থাকে। ওর শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। এবার সে রান্নাঘরে ঢুকে পাতিল থেকে এক থালা ভাত নিয়ে পিঁড়ি পেতে বসেছে। মুখে এক নলা ভাত দিতেই সৎমায়ের চোখ ভাতের থালায় পড়ল।
মুখচেপে বাইরে নিয়ে এলো সৎমা। রাতের অন্ধকারে কুয়ার ভেতর ফেলে দিল! বেঁচে থাকার আকুতিতে মায়ের হাত চেপে ধরলো। কিন্তু সৎমায়ের কাছে ওটা ছিল মিথ্যে বাহানা। ওর চোখে ছিল সমস্ত পৃথিবীর আবেগ। মাটির কলসি ধরে সারারাত বেঁচেছিল জগো।
ভোররাতে আলতাপ শেখ কুয়ো থেকে পানি তুলতে গেলে কলসির সাথে ফ্যাঁকাসে জগোও ওঠে আসে। তখন আলতাব শেখ চিৎকার করে বলে, মায়ের শোক সইতে পারলি না রে মা। শেষ পর্যন্ত কুয়ায় ডুইবা মরলি...
আমি কি তোর ভালা বাসতাম না রে জগো...
চিৎকার শুনে বাড়ির পাশের লোকজন এসে ভিড় করতে লাগলো।
মানুষের মুখে মায়ের মুখোশ থাকলে কাছের মানুষও কিছুই বুঝতে পারে না।
সংসারে নিজেকেই জায়গা করে নিতে হয়। তা নাহলে উদার মানুষগুলো শুধুই আলতাপ শেখের স্ত্রীদের মতো মানুষের অনৈতিক আচরণের শিকার হতে হয়।
এদিকে জেলেপাড়ার মেয়ে বলে বেলা রানী শৈশবে জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছিল সমস্ত রকম রঙিন দিন। জীবনে বেড়ে উঠার জন্য কেউ কখনই সুযোগ দেয়নি। আঘাত করেছে, ভুল ধরেছে। সন্ধ্যায় কানছি কোণায় গেলে কেউ লুকিয়ে থাকতো, পায়খানায় ঢিল ছুঁড়ে মারতো। বেলা রানী সহজে সমাজের কারোর কাছে হেরে যায়নি।
অনেকগুলো রাক্ষুসে হাত এগিয়ে আসতো রাতের আঁধারে। বেলা রানীর পরিবার সঙ্গ দিত, সাহস দিত এগিয়ে যাবার। শেষ পর্যন্ত বেলা রানীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল নিকষ-কালো অন্ধকার রাতে। তার গায়ের ঘ্রাণেই আমি বুঝেছিলাম সে-ই বেলা রানী।