শব্দমালা
সাদিক আল আমিন
দয়িতা অথবা অন্য কাউকে
সবুজ আর হলুদের মাঝামাঝি যে দূরত্বে আমরা মুখ ডুবিয়েছি
সেখানে কেবলই নর্দমার গন্ধ আসে
সেখানে, সেই জায়গায়, আমরা ভেবেছিলাম বাঁধবো প্রণয়ের বাঁধ
দয়িতা, তোমার সাথে সেখানে, থাকবো শুধু দুজনে
আধভাঙা চাঁদের নিচে আমাদের একাকী ঘরে
চকচকে টিনের চালে ঝিলিক দিয়ে উঠবে জোছনা আর আমরা
মহাবিশ্ব ভেঙে যাচ্ছে কিনা ভয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরবো
আমরা হবো মহাবিশ্বের সর্বশেষ নর-নারী, প্রথম যেমন আদম-হাওয়া;
সবকিছু ধ্বংসের পর আমরা পরস্পরের ঠোঁটে চুম্বন করে মারা যাবো
যেমন রোমিও মরেছিল জুলিয়েটকে চুম্বন করে-
সেখানেই থাকবো আমরা, পূর্ণিমায় দীঘল নদীর শরীরে দেবো ডুব
যদিও সাঁতার জানিনা; পরম্পরের বিশ্বাসে ভেসে থাকবো শলাকা হয়ে
তারপর ভাববো, কতকিছু অন্যায়ের পরেও আমরা টিকে আছি
হয়তো পাপীদের বিধাতার পছন্দ নয়, তাই তারা পরে মরে
আমরা তাই আরো পাপে জড়াতে থাকি যাতে আরো কিছুটা ক্ষণ পাই
আমরা স্বর্গে যাবোনা জানি, তবুও শেষ সময়টুকু উপভোগ করি
দয়িতা, সেখানে একদিন টিনের চাল ফালি করে নির্জন ঘরে ঢুকে পড়বো জোছনা,
তারপর সেই আলো মাটি ফুড়ে আরো গভীরে চলে যাবে
আমরা তাই ঠিক করি, সেখানেই আমাদের কবর হবে
সেখানে দুজনে আমরা মুহুর্তেই ভালোবাসার পাখি থেকে
গোরখোদক হয়ে যাই, আমরা যতই মাটি খুড়ি, আলো তত ভেতরে যায়
তারপর তুমি মুখ ফিরিয়ে বলো, ‘এসবের আশা করে লাভ নেই’
আমি ভাবি, লাভের কতোকিছুই না আছে জীবনে! লাভ আর লোভেই তো মানুষ
সেই আদম-হাওয়াও ভুল করেছিল লোভ করে, লোভ আমাদের অস্থিমজ্জায়
সুতরাং আমরা লোভ করতে থাকি আর মাটির ভেতরে তলিয়ে যেতে থাকি
তলিয়ে যেতে যেতে একসময় জোছনার আলো ফুরিয়ে যায়,
আমরা আরো লোভ করে মাটি খুড়তে থাকি-
তারপর তুমি বলো, আমাদের মৃত্যু অতি সন্নিকটে
আমরা তখন পরস্পরে চুম্বন করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকি...
তারপর আমরা জন্ম নেই কীট হয়ে, চারদিকে নর্দমার এক ব্রহ্মাণ্ড ছাড়া কিছুই দেখিনা
তখন আমরা আবার সবুজ আর হলুদের মাঝামাঝি যে রঙ, সে রঙে মিশতে চাই
আমরা চাই নদীর ধারে কোনো বালুচরে আমরা সময় কাটাই সারাজীবন
কিন্তু সব রঙ যেন ফিকে হয়ে আসে, কালো রঙ আর উৎকট গন্ধ ছাড়া আর কিছুই দেখিনা
তারপর... তারপর... তারপর...
তুমি দয়িতা, আমাকে তোমার সর্বনাশের মূল মনে করে দূরে সরে যাও
তোমার প্রার্থনা বিধাতা মেনে নেয়, তোমার পাপ আমাকে দিয়ে দেয়
তুমি তখন অন্য এক উদ্যমী স্বপ্নাতুর যুবকের সাথে প্রণয়ে লিপ্ত হও
আর আমি তখনও নর্দমার কীট হয়ে লোভ করতে থাকি,
একদিন কালিমার আস্তরণ ছেদ করে অনাবিল শুভ্রতায় ভেসে বেড়াবো...
অবিরাম, অবিরত
অন্যদিন অন্যজীবন
আজ ফুলগুলো গুল্মের শাখায় শাখায় ব্যক্ত
আজ খাঁচাবন্দি এক পাখি বন্য হয়ে উড়ে গেল
আজ আমার পাকা চুলে কালোর স্মৃতি হাত ছোঁয়াল
আজ তোমার কথা মনে পড়তেই বুকটা যেন শূন্য লাগলো
কাল যত্মে রাখা ফুল অন্যের হাতে শোভা পাবে
কাল উড়ে যাওয়া পাখি অন্য খাঁচায় বন্দি হবে
কাল প্রেমিক হওয়া কৈশোরে না পাওয়া প্রেম ধরা দেবে
কাল তোমার সাথে অন্যদেশে ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা হবে
সীমাবদ্ধতার দেয়ালগুলো
যেই সখ্য মেঘেদের সাথে ভেসে এসেছি এতোদূর
তাদের বেশ অপরিচিত মনে হয়
যেখানে অধিকার ছিল সহজলভ্য
সেখানে আজ অনুমতির শক্ত দ্বার
ক্রমাগতই তলিয়ে যাচ্ছি অতলে আর
সেইসাথে আগন্তুক হচ্ছে পরিচিতজন
যে প্রেমিকার চোখে চোখ রেখেছি অকপটে
তার চোখে চোখ রাখতে দ্বিধা হয়
যে প্রকৃতির উদোম ন্যাংটো শরীরে মিশিয়েছি নিজেকে
তাকে সহজ করে পেতে মরিয়া হই...
যেন নিজেকেই বানিয়ে ফেলেছি অন্যরকম
সৃষ্টি করেছি নাগালের বাইরের এক আবরণ
সে আবরণ ভেদ করে কখনো
বিশৃঙ্গল আগের মতো হতে ইচ্ছে হয়
আজ সারাদিন বৃষ্টি হোক
আজ আর সূর্য না উঠুক
আজ কালো মেঘেই ছেয়ে থাক আকাশ, তোমার মুখ
আজ ঝড় উঠুক ক্ষুধার্তের ক্ষুধার উদ্রেক বাড়িয়ে
আজ সিক্ত হোক ব্যভিচারী চোখ
সেই আগন্তুক দুর্বিষহ ঝড় শেষে দানাদানা শস্যের মতো বৃষ্টি ঝডুক
টিনের চালে, বৃষ্টি ঝড়ুক তোমার সমস্ত অঙ্গজুড়ে
দুলন্ত বাঁশঝাড় শুকনো ফুসফুস ভিজিয়ে তুলুক নিমিশেই
আজ মুকুলঝরা আমবাগানে টিনের ঘরটা ঝিমিয়ে পড়ুক ঘোর নিদ্রায়
আজ আর সূর্য না উঠুক
আজ সারাদিন বৃষ্টি হোক