প্রেম ও মায়াবতী
ইরফান তানভীর
দ্যা প্যারাডাইস অন আর্থ, কাশ্মীরের প্রতি আমার এক অদ্ভুত মায়া আছে। বলা যায় একধরনের প্রেম। বই টই পড়ে পড়ে অদেখা কাশ্মীরের প্রতি যে পুলক আমার তৈরি হয়েছে তা দেখে আম্মা প্রায়ই বলতেন, কোন এক দেশ কাশ্মীর ,যার জিকির তুই উঠতে বসতে করে যাচ্ছিস! পাগল হওয়ার আর কদ্দুর বাকি? বললাম, এখন একটা বিয়ে শাদি কর! না তা না, উনার কেবল একটাই কাজ, বাবার পয়সা খরচ করে ওনি ঘুরবেন আর ঘুরবেন। আবার কোন এক পাগলামি উঠল মাথায় ‘ কাশ্মীর কাশ্মীর ’॥
আমার মনে হলো - যে কাশ্মীরে শালিমার বাগ, গুলমার্গ, চেশমা শাহী, ডাল ও নাগীন লেকের মতো স্বর্গীয় অনুরণণ মিশে আছে, সে কাশ্মীরের প্রতি আমার পাগলামো নেহাৎ সামান্য। পাঁচ ছ বছর আগে, তখন ভার্সিটিতে বন্ধুরা মিলে প্লান করেছিলাম দেশ ভ্রমনের। পর্যটক হবার শখ জেগে ছিল কিনা। দেখা গেল সেমিষ্টার শেষ, পনের ষোল জনের বন্ধু গ্রুপটা ছুট দিতাম বান্দারবানের নাফাখুম অথবা মাধবকুন্ডের জলপ্রপাতে। কি যে এডবেঞ্চার, আহা। যে সময়ে অন্য বন্ধুরা তাদের জীবন নিয়ে ছিল বিরক্ত, বন্ধের সময় গৃহপালিত প্রাণীর মতো আবার ঢুকে পড়ত তাদের দশ পনের তলা আলিশান খোঁয়াড়ে, সে সময়ে আমরা হাতেগনা কজন ছুটতাম নতুন অদেখাকে দেখতে। নতুনকে বরণ করে নিতে। আমাদের ইচ্ছে ছিল ভার্সিটি শেষ হতে হতেই আমরা মুঘল ¯থাপত্যের তাজমহল, আগ্রা-ফোর্ট কিংবা লাল কেল্লা দেখে ফেলব। অথচ, কেবল তাজমহলই দেখার স্বাধ হলো। তাও কম বেগ পোহাতে হয়নি, টাকার জন্য আমাদের রিতিমত রাতের ঘুম হয়েছে হারাম। হবিগঞ্জ অথবা কিশোরগঞ্জ যাবার জন্য বাবার কাছ থেকে টাকা পাওয়া গেলেও মূঘল ¯া’পত্য দেখতে বাবারা টাকা দিতে অপারগতা দেখাতে থাকেন প্রথম থেকেই। সে যাই হোক, ভার্সিটি থেকে বের হলাম কদিন হলো? বছর হতে পারে। তবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা ভ্রমণালাপ এখনো আগের মতো। সেদিন আজমাল ফোন দিয়ে ভ্রমনের পোকাটা উসকে দিল। শুন ইকবাল, এবার কিন্তু দূরে কোথাও যাচ্ছি। সিকিম, ভুটান অথবা দার্জেলিং। সবাইকে নিয়ে সামনের শুক্রবার রমনায় বসছি। বিকেলে। ঠিকাছে? আচ্ছা।
সবাই যদি সিকিম ভুটানই যেতে চায় তাহলে আমার কাশ্মীর যাবার কি হবে? নাহ্, যেতে হলে কাশ্মীরই যাব, আর না হলে কোথাও না! শুক্রবার বিকেলে রমনায় গিয়ে যখন মনমরা হয়ে বসি, তখন আজমাল সহ সবারই সিদ্বান্ত কাশ্মীর যাবে। পেহেলগাঁমে নাবিলের কোন এক বন্ধু যেন থাকে। সেই আমন্ত্রন জানিয়েছে নাকি। আহা, মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। নাগরিক কোলাহল ভুলে কাশ্মীরের স্বর্গীয় শান্ত সমাহিত নীল জল আর ঝিকমিক করা রঙবেরঙের ফুল ফল মূহুর্তে আমার চোখে আনন্দের সঙ্গীত জাগিয়ে দিল। ১৪ এপ্রিল রাতে বাসা থেকে যখন বের হই আম্মা হৈ হৈ শুরু করে দিয়েছে। কই যাচ্ছিস? যুদ্ধের দেশ, এখন কি আর কাশ্মীর কাশ্মীর আছে?
আহা কাশ্মীর, পৃথীবির স্বর্গ! এখন ধংসের পদপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। ভাবতে গিয়ে এক অনিরুদ্ধ আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল। বেনাপল বর্ডারের বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন সেন্টারে সকাল ন’টায় এসে চোখ কপালে উঠার যোগার। এই সকালেই ইমিগ্রেশনের সামনে ইন্ডিয়াগামি যাত্রীদের বিশাল লাইন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের এগার জনের এই টিমটার পেটে তখন গুরু গুরু অবস্থা। ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে বিশাল লাইনটাতে দাঁড়াতেই দালালদের দেখা মিলল। আমরা তো প্রায় দাললদের মুরিদ হয়েই যাচ্ছিলাম, মনোয়ার একাই আমাদের সামলাল, তারপর ইমিগ্রেশনের যাবতীয় ঝামেলা শেষ করে আমরা যখন কলকাতা এসে পৌঁছাই তখন ঘড়িতে বিকাল পাঁচটা প্রায়। পরদিন দুপুর তিনটায় দিল্লির ট্রেন শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে যাবে। কলকাতা নিউমার্কেটের ঠিক পাশেই আমাদের হোটেল বুকিং দেয়া ছিল। সারারাত এবং পরদিন দুপুর পর্যন্ত রেস্ট করে শিয়ালদাহ রেল স্টেশনে এসে পৌঁছাই তিনটা বাজার এক ঘন্টা আগে। শিয়ালদহের কমলা আর ক্রিম কালারের সুন্দর বিল্ডিংটার প্রবেশমুখ দিয়ে ডুকছিলাম সবে, গজকয়েক দূর থেকে একটি ছোঁড়া বাক্য শুনতে পেলাম। ইকবাল!
পেছনে তাকাতেই কলকাতার সূর্যের আলো ঝাপটা মেরে চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ইকবাল, মেরি আন্দাজ, ইকবাল? সূর্যের আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে এবার তাকালাম সে উজ্জল দেবী মুখটির দিকে, যার দিকে তাকিয়ে আমার চোখজোড়ায় আরো দ্বিগুন আলো খেলে গেল। কিছু মূহুর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রবল চিৎকারে বলে উঠলাম, ফারজানা! হাউ সারপ্রাইজ! কতোদিন পর?
ভাঙা ভাঙা বাংলায় ফারজানাও কথা বলা শুরু করল। কোথায় যাচ্ছো? কাশ্মীর? বুঝলে কিভাবে? অনুমান। তোমার তো অনুমান শক্তি প্রবল দেখছি। কতোদিন পর ফারজানার সাথে দেখা? বছর চারেক তো হবে। কাশ্মীরের মেয়ে ফারজানাকে প্রথম দেখি ঢাকা মেডিকেলের সামনে। নতুন ভর্তি হয়েছে তখন। একবছর তক ছিল। তারপর কাশ্মীরের মেয়ে কাশ্মীরেই ফিরে যায়। আর যোগাযোগ হয়নি। মাঝেমধ্যে মনে হয়েিেছল। ফারজানা, আহা ফারজানা। তার বাঁকা ভ্রুজোড়াকে আমার কাশ্মীরের সচ্ছ নীল ঢেউ মনে হতো।
তারপর আর কি খবর বলো? কলকাতায় কি করছ? বান্ধবির কাছে এলাম বেড়াতে। বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে হয় না? অফকোর্স হয়। সেদিন আম্মা তোমার কথা বলছিল। কি বলল আন্টি? সে অনেক কথা। আচ্ছা আমার কথা মনে হয় তোমার?
নাহ্! তারপর ফারজানা খলখল করে হাসতে লাগল, সে হাসি কাশ্মীরের নয়নাভিরাম নিসর্গকেও হার মানাবে। আজমাল এসে তাড়া দিয়ে বলল, এই ইকবাল, ট্রেনের সময় হয়ে এল। সে সময়ে ফারজানার পাশে ভদ্রগোছের এক যুবক এসে দাঁড়াল। কাঁদে ছোট্ট ব্যাগ। চলে যাব, ঠিক সেসময় ফারজানা যুবকটির হাত ধরে পরিচয় করিয়ে দিল, আমার হাজবেন্ড। কলেজের লেকচারার। একসাথেই আমরা তোমার বাংলাদেশে যাব। ভদ্রলোক হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়াল। আই এ্যাম হাসান ইসফার। শিয়ালদহ রেলওয়ের ফ্ল্যাটফর্ম বি থেকে তখন দিল্লিগামি রাজধানি এক্সপ্রেস হুঁইশেল দিচ্ছিল।