কাগুজে যোদ্ধা
যাহিদ সুবহান
মহরম আলী। বয়স পঁচাত্তর। গাঁয়ের মোড়ে মোতালেব হোসেন মতুর চায়ের দোকান; সেখানে প্রতিদিন দুবার তিনি নিয়ম করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পাঁতানো বাঁশের মাঁচায় এসে বসে থাকেন। প্রতিদিন একই সময় বাড়ি ফেরেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মহরম আলীর একমাত্র ভরসা বাঁশের লাঠিটা। লাঠিটা খুব শৈল্পিক; মাথাটা দেখতে অবিকল মানুষের মাথার মতো। রাজার মাথার মুকুটের মতোও বলা যায়। এই লাঠিটাই মহরম আলীকে সোজা হয়ে হাঁটতে সাহায্য করে। শরীরটা একটু ঝুঁকে থাকলেও অন্তত মাথাটা উঁচু হয়ে থাকে। মহরম আলী অর্থবিত্তে গরীব হলেও সারাটা জীবন মাথা উঁচু করেই চলেছে। এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। এলাকার মানুষ বিষয়টি খুব ভালোভাবেই জানে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মোটামুটি ভাল থাকলেও বয়সের কারণে মহরম আলীর কানে একটু সমস্যা হয়েছে। কানের একটা মেশিন কেনা জরুরী। কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। সাত হাজার টাকা লাগবে। এই টাকা জোগানোর সামর্থ্য তার নেই। শ্রবণশক্তি কমে গেছে; কানে শোনেন না বললেই চলে। সে কারণেই তিনি সকলের সাথে একটু জোরেই কথা বলেন। কথা বলার সময় মনে হয় অন্যরা হয়তো তাঁর কথা শুনছে না। অনেকটা কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শোনারত কোন ব্যক্তির মতো। সে মনে করে তার কথা হয়তো কেউ শুনছে না। মহরম আলীরও ঠিক একই অবস্থা। কেউ কিছু বললেও একবারে শোনেন না। উল্টো তাকেই উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,‘এ্যা, কী কচ্ছাও!
মোড়টাতে মতুর দোকান ছাড়াও রয়েছে কয়েকটি মুদির দোকান আর একটি ধানের কল। গাঁয়ের মানুষের ধান ভানার কাজ চলে কলটায়। গাঁয়ের মানুষের বিনোদনের জায়গা মতুর চায়ের দোকান। দোকানের ভিতরে রয়েছে ভিসিডি প্লেয়ার। গাঁয়ের নানা বয়সের শ্রমজীবী মানুষ চা খায় আর হা করে রঙিন টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখে। বাংলাদেশী সিনেমা এবং ভারতীয় সিনেমা। তবে অবশ্যই বাংলা ভাষার। রঞ্জিত মল্লিক-মিঠুন চক্রবর্তী-দেব-জিৎ-কোয়েল মল্লিক আর বাংলাদেশের মান্না-আমিন খান-সাকিব খানের সিনেমা। নানা রকম সিনেমা; নরম-গরম! মোড়ের কয়েকটা মুদি দোকানের একটা মহরম আলীর ছোট ছেলে আলালের। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিল আলাল। সেই পুঁজির জোরেই কোনমতে দোকানটা চালায়। বুড়ো বাপটাকে সেই দেখে। মহরম আলীর আরেকটা ছেলে আছে। দুলাল। সে বড় ছেলে। নিজের কোন জমি-জিরাত না থাকায় পরের জমিতে কৃষাণ দেয়। সারাদিন হাড়খাটুনি খেটে বউ-ছেলেপুলে নিয়ে কোনমতে সংসার চালায়। মহরম আলীর একটা মেয়েও আছে। পাশের গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন।
মহরম আলী মতুর দোকানের বাঁশের মাঁচায় বসে থাকে। যাকেই পায় তার সাথেই গল্প জুড়ে দেয়। অনেকেই মহরম আলীর গল্প শোনে; অনেকেই বিরক্তও হয়। সবচেয়ে বেশী বিরক্ত হয় চায়ের দোকান্দার মোতালেব হোসেন মতু। এই বিরক্তির কারণও আছে। মহরম আলীর গল্পের বিষয় একটিই। প্রতিদিন একই গল্প শুনতে কারই বা ভাল লাগে। মানুষ বিরক্ত হলেও মহরম আলীর গল্পের সিংহভাগ জুড়ে থাকে একই বিষয়। মহরম আলীর এই পৌঢ় জীবনের অভিজ্ঞতা সেসব গল্পকে জীবন্ত করে তোলে। মহরম আলীর গল্পের মূল শব্দ দুটি। গন্ডগোলের বছর আর শেখ সাহেব। এ দুটি শব্দ যেন মহরম আলীর কাছে স্লোগান। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে যেমন মুক্তিযোদ্ধা আর গণমানুষের স্লোগান ছিল জয় বাংলা। এই স্লোগান পুরো জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছিল। মহরম আলীও তেমনটিই মনে করে। তাঁর গল্পের গোন্ডগোলের বছর মানে উশিশ’শ একাত্তর সাল আর শেখ সাহেব হচ্ছেন বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। মহরম আলীর মতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই বংশীবাদক যাঁর মোহন বাঁশির সুরে বাঙালি জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য; স্বাধীনতার জন্য। মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মহরম আলীর গল্প শুনলে মনে হয় একাত্তর মানে এই তো সেদিনের কথা। বঙ্গবন্ধু যেন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন,‘এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যে ভাষণ অনেকের সাথে মহরম আলীও শুনেছিলেন রেডিওতে।
একাত্তরে মোহন বাঁশির সুরে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য যে দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহরম আলী তাঁদের একজন। যুদ্ধদিনের স্মৃতিগুলো মহরম আলীর মুখে শোনায় মধুর মতো। মহরম আলী চার ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তামাটে বর্ণের সুঠামদেহের অধিকারী ছিলেন তিনি। আইয়ুব খানের আমলে আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। শৈশবের গুলতি মারা হাতে তীক্ষè নিশানা ছিল মহরম আলীর। প্রশিক্ষণের সময় তার নিশানা দেখে আশ্চর্য হয়েছিলো প্রশিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বুরামারা বিলের পাশে খয়ের বাগানে এলাকার পয়ত্রিশ জন যুবককে নিয়ে ক্যাম্প করা হয়েছিল। বেণু কমান্ডারের নেতৃত্বে এই ক্যাম্পের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছিল মহরম আলীর হাতে। বেণু কমান্ডারের নির্দেশে তিনিই সকলকে ট্রেনিং দিতেন। র্যাখি করা, এমবুশ করা, রাইফেল চালানো, গ্রেনেড ছোড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। মহরম আলীকে বেণু কমান্ডার খুব ভালোবাসতেন। তাই তাঁর উপরই এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। মহরম আলীর খুব মনে পড়ে সেই সোনালি দিনগুলোর কথা; সেই যুদ্ধদিনের কথা। এই পৌঢ় বয়সেও সেই পয়ত্রিশ জন যুবক মুক্তিযোদ্ধার প্রায় সবার নামই বলতে পারেন মহরম আলী। মকুল মাস্টার, সাজু, রেজু, সিদ্দিক, রবু ইত্যাদি ইত্যাদি।
আজ এই ভর বিকেলে হন্তদন্ত হয়ে সাথে আরো কয়েকজন মুরুব্বী গোছের বয়স্ক মানুষ নিয়ে মোড়ে মতুর দোকানে এসেছেন হাবিবুর রহমান। তিনি এ গাঁয়ের সবচেয়ে সম্মানী মানুষ। একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা। একজন সফল মানুষ তিনি। তাঁর দুই ছেলে আর এক মেয়ে। সবাই বড় পদে সরকারি চাকরি করে। বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদে তারা চাকরি পেয়েছে। বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা ভাবলে গর্বে বুক ভরে যায় তাদের। হাবিবুর রহমান দোকানে আসার সাথে সাথে মতু হাতাওয়ালা প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো বের করে দেয়। এই চেয়ারগুলো মূলত দোকানে গুরুত্বপূর্ণ আর সম্মানী ব্যক্তিরা আসলেই দেওয়া হয়। আম পাবলিকের জন্য এগুলো নয়। ইতিমধ্যে দোকানের টিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাবিবুর রহমান চাচার সামনে এসব বেয়াদবীর পর্যায়ে পড়ে। এলাকার মানুষ তা জানে এবং মেনে নেয়। হাবিবুর রহমান হাঁক ডাকেনÑ
- মতু, এ্যা মতু। জলদি চিনি ছাড়া এক কাপ লাল চা দে তো বাপ!
- ক্যা কাহা, আইজক্যি এতো তাড়াহুড়া ক্যা?
- হ রে বাপ। সামনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন। মুক্তিযোদ্ধাগেরে সাথে যোগাযোগ করা লাগতিছে; ভোট চাওয়া লাগতিছে। খুব চাপে আছি।
- নির্বাচনের কী অবস্থা কাহা?
- ইনশাল্লাহ্!
- আচ্ছালামু আলাইকুম মহরম ভাই। ক্যামা আইছেন?
গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাঁর চোখে পড়ে বাঁশের মাঁচায় বসে থাকা মহরম আলীকে। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে মহরম আলীকে সালাম ঠোকেন। সেই সাথে মতুকে ডেকে মহরম আলীকে চা-বিস্কুট দেওয়ার কথা বলেন তিনি। হাবিবুর রহমান সালাম মহরম আলীর কানে পৌছায় না। সে এদিকে তাকিয়ে বলে, ‘এ্যা, কী কচ্ছাও!
মতু এবার মহরম আলীর প্রসঙ্গে কথা তোলে। তার দুর্দশার কথা; মুক্তিযোদ্ধা সনদ না পাওয়ার কথা ইত্যাদি।
- ক্যা কাহা, শুনি মহরম চাচা আপনেগোরে সাতে যুদ্ধে গেছিলো। তার নাম নাকি লিস্টে ওটে নাই। আপনে রা কি তার জন্যি কিচু করতি পারেন না?
- আর কইস নি বাপ, চেষ্টা তো কম কইরলেম না। বড় একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান। তাঁর এই দীর্ঘশ্বাস অশিক্ষিত, চা বিক্রেতা মতুর মনে এই ধারণার জন্ম দেয় যে, মহরম আলীর মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার ব্যাপারে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমানের আন্তরিকতা কিংবা চেষ্টার কোন ঘাটতি নেই।
সরকার তালিকায় নাম না ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্ত করার না কি উদ্যোগ নিয়েছে। একবার কয়েকজন সাংবাদিক এসেছিলেন গ্রামে। তারা মহরম আলীকে নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন জাতীয় পত্রিকায়। পত্রিকায় এই রিপোর্ট ছাপা হলে ইউএনও সাহেব ডেকেছিলেন মহরম আলীকে। ছোট ছেলে আলালকে সাথে করে তিনিও গিয়েছিলেন ইউএনও অফিসে। মহরম আলীকে নিয়ে শুনানীও হয়েছিলো। সেই শুনানীতে ছিলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও। কিন্তু কোন মুক্তিযোদ্ধা মহরম আলীর বিষয়ে তথ্য না দেওয়ায় বিষয়টি নিয়ে আর কিছুই হয় নি।
মহরম আলীর নাম মুক্তিযোদ্ধা লিস্টে না ওঠা নিয়ে অনেকবার ভেবেছে মোতালেব হোসেন মতু। কিন্তু ক’লিয়ে উঠতে পারে নি। বিষয়টি খুব জটিল। আর জটিলতার শেষ পর্যন্ত পৌছানো মতুর মতো একজন অশিক্ষিত চা বিক্রেতার সম্ভব নয়। মতু সেটা জানে। তবু মনে অনেক প্রশ্নের উঁকি দেয়। তবে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে মহরম আলী একজন মুক্তিযোদ্ধা। যদিও মতুর বিশ্বাসে কারো যায় আসে না। শুধুমাত্র লিস্টে নাম না থাকলেই কি তিনি বীর হিসেবে বিবেচিত হবেন না? মতু এও জানে দেশের অনেকের অবস্থাই মহরম আলীর মতো। মতুর এসব ভাবনায় দিন দিন জং ধরছে। মহরম আলীর জন্য মতুর খুব কষ্ট হয়। গর্বও হয় বেশ! এদেশের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নিজের হাতে বানানো চা খাওয়াতে পারাকে নিজের ভাগ্য বলে মনে করে সে। এদেশের অনেককে দেখে মতু আশ্চর্যও হয়। মহরম আলীর মুখে উচ্চারিত সেই যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তো বেঁচে আছেন। তারা কি মহরম আলীর জন্য কিছু করতে পারেন না? যদিও হাবিবুর রহমান চাচার নাম কোনদিনও মহরম আলীর মুখে সে শোনে নি কোনদিন। মহরম আলী তার দোকানের দিকে মন দিতে চায়। বাঁশের মাঁচায় বসে থাকা মহরম আলীকে উদ্দেশ্য করে বলে-
- কাহা, এক কাপ রঙ চা খাবেন?
মতুর কথা মহরম আলীর কানে পৌছায় না। সে এদিকে তাকিয়ে বলে, ‘এ্যা, কী কচ্ছাও!
যাহিদ সুবহান, আটঘরিয়া, পাবনা।