গন্ধ সাবান
মুহাম্মদ বরকত আলী
আমিনা খাতুন রান্না ঘর থেকে রিফা, রিফা বলে করেকবার ডাক দিলেও মেয়ের কোনো প্রতুত্তর পেলো না। চুলায় আগুন জ¦ালিয়ে পানির হাড়িটা চুলায় বসিয়ে বলল, ‘কোথায় যে গেল মেয়েটা, হাতে-পাতে একটু আধটু কাজ করে দিবে কিনা সে গুণ নেই। মা যে সেই সক্কাল ভোরে উঠেছে সে কথা তার খেয়াল আছে? নামাজ পর আমাকে যে মন্ডল বাড়ি যেতে হবে সেকথা কি জানে না? সময় মত না গেলে অন্য কাউকে নিয়ে নেবে। তখন বছরকার দিনটাই মাটি হয়ে যাবে।’
আমিনা খাতুন একা একাই বকবক করে চলেছে। মেয়ের জন্যতো আর কাজ থেমে থাকবে না। রিফা কতটুকুই বা সাহায্য করবে। টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে আসা আর এটা সেটা গুছিয়ে দেওয়া। মানে, ফুটফরমাশ খাটা আর কি।
আজ ঈদের দিন। কুরবানির ঈদ। ঈদের সকাল। সূর্য ওঠার আগেই আমিনা ঘুম থেকে জেগেছে। রিফা আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সাদিয়াদের বাড়িতে গিয়েছে। সাদিয়ার ঈদের নতুন জামাটা দেখবে।
আমিনা খাতুন সেমাই রান্না শেষ করে লুচি বানানোর জন্য ময়দা তৈরি করছে। ঘরে অনেকদিনে পুরনো কিছু ময়দা ছিল। সেটুকু দিয়েই চালিয়ে নেবে।
মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের আহব্বান। কয়টার সময় ঈদের জামাত হবে সেটা বলছে। নিজ নিজ জায়নামাজসহ ঈদ গাহে আসতে হবে। সবার মুখে মাস্ক থাকা বাধ্যতা।
রিফা গমগম পায়ে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল। আমিনা বলল, ‘কোথায় গিয়েছিলি, হ্যাঁ? কাজের সময় পাওয়া যায় না। আমার সাথে হাতে-পাতে একটু কাজতো করতে পারিস।’ একুটু বলে চুপ থেকে আবার বলল, ‘ কল থেকে পানি নিয়ে আয় দিনি।’
রিফা মুখ ভার করে বলল, ‘পারবো না।’
আমিনা মেয়ের মলিন মুখটা দেখে বুঝতে পরলো কিছু একটা হয়েছে।
‘কি হয়েছে? ঈদের দিন, বছরকার দিনে এমন মুখ ভার করে থাকলে হয়?’
রিফা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার গন্ধ সাবান চাই।’
মেয়ের এমন আবদারের কাছে নিজেকে সত্যিই অসহায় লাগে আমিনার। তাইতো, মেয়েকে নতুন জামা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও অন্তত একটা গন্ধ সাবান কিনে দেওয়ার মত সক্ষমতা নিশ্চয়ই আছে। বছরকার দিন বলে কথা।
আমেনা বলল, ‘আমাকে আগে বলিসনি কেনে? সব কিছু কি আর মনে থাকে?’
রিফা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘আমি ওসব কিছু জানি না, সাদিয়ার গন্ধ সাবান আছে। নতুন জামা আছে। মেহেদী আছে। আমিতো ওসব কিছুই চাইনি। একটা গন্ধ সাবানতো দিবে?’ কথা শেষে করেই ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল।
আমেনা খাতুন রান্না শেষ করে মেয়েকে গোসল সেরে নিতে বলল। রিফার একই কথা সে গন্ধ সাবান ছাড়া গোসল করবে না।
রিফার বাবা হাসেম আলী বাড়িতে এসে দেখে মেয়ে কাঁদছে। মেয়ের কান্না দেখে আমেনাকে জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে।
রিফার বাবা দিন মজুর। সকালে বাসি পান্ত খেয়ে কোঁদাল, নিরাড়ী আর একটা ঝুড়ি নিয়ে কাজের জন্য বের হয় শহরের পথে। তার মত আরও কয়েকজন দিন মজুরের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। কারো ডাক পেলে ছুঁটে যায় তার পিছনে। কাজ করে দেয়। মজুরি পায়। এভাবে চলে সংসার। করোনার জন্য আজকাল তেমন কাজ হয় না। শহরের লোকেরা করোনার ভয়ে বাড়ির বাইরে বের হয় কম। বাইরের লোক বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। এজন্য এখন প্রতিদিন কাজ হয় না। দু একদিন যা কাজ হয় তাতে থেকে কোনো মতে সংসার চলে। সরকারি অনুদান হিসেবে কিছু চাউল আর টাকা পেয়েছিল। তবেই রক্ষা। তানাহলে কিযে হত একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
আসেম আলী সকালে গিয়েছিল হোসেন মহাজনের বাড়ি। মহজনের কুরবানির গরুটার গা ধুয়ে দিয়েছে। কুরবানির দেওয়ার জায়গাটা পরিষ্কার করেছে। গোস্ত চুরানোর জন্য ছুঁরি-রামদা ধার দিয়ে প্রস্তুত করে তবেই এসেছে। ঈদের নামাজ শেষে করে একটু পানি মুখে দিয়েই মহাজনের বাড়িতে হাঁজির হতে হবে।
মহাজনের গরু কুরবানির দায়িত্ব হাসেমের উপর। প্রতি বছর তার জন্য এই কাজটা ধরা থাকে। লাভের লাভ বলতে গোস্ত চুরানোর জন্য দিন মজুরি হিবেসে কিছু টাকা আর বাড়ি ফেরার পথে কিছু গোস্ত পাওয়া যাবে। অন্তত তাকে গোস্তের চিন্তা করতে হবে না। ওদিকে আমিনাও মন্ডল বাড়িতে গরুর ভুড়ি সাফ করে দিয়ে কিছু গোস্ত আর ভুড়ির কিছু অংশ পাবে।
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সাবান কিনে দেওয়ার কথা বলে বাইরে বের হল হাসেম আলী। নামাজের আর অল্প কিছু সময় আছে। এর মধ্যে আমিনা বাইরে যেতে বারণ করলেও শুনলো না। মহাজনের কাছে থেকে অগ্রিম কিছু টাকা নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে একটা দোকানেও গন্ধ সাবান পেল না। গ্রামের মানুষ গন্ধ সাবান মাখেইবা ক’জন?
হাসেম মেয়েকে কথা দিয়েছে গন্ধ সাবান সে নিয়েই ফিরবে। মোকামের দোকানে থাকবে নিশ্চয়। কিন্তু ঈদে নামাজের সময় হয়ে আসছে। দোকান খোলা পাওয়া যায় কিন সেটই এখন সমস্যা। ঘাটে গিয়ে দেখে নৌকা আছে, মাঝি নেই। নৌকাটা ভাসিয়ে ছুটল নদীর ওপারে।
মোকামের সব দোকান বন্ধ। ঈদের নামাজ বাদ দিয়ে কে দোকান খোলা রাখবে?
হাসেমের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উপায় না দেখে হতাশ হয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই একটা ছোট্ট কাঠের দোকানের ভিতর থেকে ভেসে এল, ‘ক্যাডা?’ হাসেম যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল। দোকানের ছোট্ট ডালাটা খুলে ভিতর থেকে একজন বৃদ্ধ লোকের মুখ বেরিয়ে এল। হাসি মুখে বলল, ‘কি চায়?’
হাসেম বলল, ‘গন্ধ সাবান। মেয়ের জন্য। একটা গন্ধ সাবান চাই।’
বৃদ্ধ লোকটার স্বজন বলতে কেউ নেই। সবাই নাকি ভারতে আছে। সুবল কাকা নামেই সবাই চেনে তাকে। দোকানে সারাদিন ব্যবসা করে রাতে দোকানেই ঘুমিয়ে থাকা। দোকান যেন তার বাড়ি।
সাবানটা হাতে নিয়ে হাসেম আলী টাকা এগিয়ে দিল। সুবল কাকা বলল, ‘এই ঈদে নাতির জন্যি গন্ধ সাবানটা ঈদ উপহার দিলাম। নিয়ে যাও।’ কথা শেষ করে দোকানের ডালাটা বন্ধ করে দিল।
মসজিদ থেকে ভেসে আসছে, ‘‘আর মাত্র কয়েক মিনিট সময় আছে। নিজ নিজ জায়নামাজসহ তাড়াতাড়ি ঈদ গা ময়দানে চলে আসুন।’’
রিফার হাতে সাবান দিয়ে বলল, ‘এই নে মা, তোর গন্ধ সাবান।’
রিফার মুখে চৌড়া হাসির ঝিলিক। মেয়ের মুখের হাসি দেখে আমিনা চোখে জল চলে এল। এ জল আনন্দের।