ফুটপাতে ভাগ্যের টিয়াপাখি
প্রিন্স আশরাফ
শ্যামলী শিশুমেলার টিকেট কাউন্টারের ঠিক সামনের জায়গাটা থেকে একটু সরে গুড়োদুধের বিজ্ঞাপনের বিশাল ছাতার সূর্য আড়াল করা রোদের ছায়ায় ফুটপাতে টিয়াপাখি নিয়ে বসল জ্যোতিষী সামাদ।
জ্যোতিষীর কাজের মধ্যে কাজ ছাতার ছায়ায় চুপটি করে বসে থাকা। ফুটপাতের এই জায়গাটুকু যেমন কিনে নিতে হয়েছে, তেমনি ছায়াটুকুও। ছাতার ছায়ার জন্য শিশুমেলার দারোয়ান মজিদকে মাসোহারা দিতে হয়। এই শহরে কিছুই মাগনা নয়, এমনকি ছায়াও!
সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় বসে বসে ঝিম ধরে পড়ে থাকতে হয়। পথ দিয়ে ¯্রােতের মতো এগিয়ে যায় মানুষ, ফুটপাতের ভাগ্যের টিয়াপাািখর দিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায়? তারপরেও ভাগ্যবিড়ম্বিত দ্এুকজন নি¤œ আয়ের মানুষ সেই প্রবল ভিড়ের মধ্য থেকেও টিয়াপাখিকে লক্ষ্য করে দাড়িয়ে পড়ে, নিজের ভাগ্য ও ভবিষ্যত গুনে নিতে চায়। বিনিময়ে দশ-বিশ টাকা। দিন শেষে হয়তো দুইশ আড়াইশটাকা। তাতেই চারটে প্রাণীর কোনমতে দিনগুজরান হয়। বয়সী বাজা বউ, সত্তোরোর্ধ হাড্ডিচর্মসার বৃদ্ধা মা, ও আপন সন্তানের মতোই রুটি রুজির জোগানদাতা টিয়াপাখির কোনমতে পেট চলে।
ফুটপাতে রঙচটা ছাতার নিচে দাবার ছকের মতো বড়ো বড়ো ছক আঁকা প্লাস্টিকের কাগজটা বিছিয়ে বসতে না বসতেই শিশুমেলার গেটের ভেতরে ঝিমুতে থাকা দারোয়ান মজিদ বন্ধ গেটে হাতের চকচকে লাঠি দিয়ে শব্দ করে, ‘জইতিষি ভাই, আজকারথন এইহ্যানে বইসা আর কুনু লাভ হবে না। মানুষ পাইবেন কই?’
জ্যোতিষী কলোনীর গেট থেকে বেরিয়েই এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে। রাস্তাঘাট দোকানপাট সবর্ত্রই মানুষের আনাগোণা খুবই কম, একেবারেই হাতে গোণা। কিন্তু সে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সে খুব একটা কথা খরচ করে না। জ্যোতিষীর মুখের এক একটা শব্দও দামে বিক্রি হয়!
শিশুমেলার গেটের দিকে এগিয়ে এলো জ্যোতিষী। কাধে বসা টিয়াপাখি জ্যোতিষীর চলাচলের সাথে নিজের শরীরের ব্যালান্স করে নিচ্ছে। ‘মজিদ ভাই, ঘটনা কি? আপনার পার্কও কি আজ বন্ধ নাকি? কোন ছুটিছাটা?’
‘খবর জানেন না কিছু? আপনে আবার কেমন জইতিষি?’ জ্যোতিষির সাথে মজিদের সম্পর্কটা কিছুটা বন্ধুত্বের, কিছুটা দেনদরবারের।
জ্যোতিষি দুদিকে মাথা নাড়ে, সাথে সাথেই কাধের টিয়াপাখিও দুদিকে মাথা নাড়ে। তাই দেখে হেসে ফেলে মজিদ। ‘ছুটি মানে জনম জনমের ছুটি। এই ছুটি কবে শেষ হবে আল্লামাবুদই জানে!’
জ্যোতিষী উৎসুক চোখে দারোয়ানের দিকে তাকায়, পাঞ্জাবীর পকেট থেকে স্বস্তার সিগারেট বের করে বাড়িয়ে দিল।
দারোয়ান সিগারেট নিল, ‘আমাদের চাকরিটা এখনও আছে, আল্লায় জানে তাও থাকে কিনা? কি এক করুনা ভাইরাস আইছে বিদ্যাশ থাইক্যা, হাজারে হাজারে মানুষ মাইরা ফালাইতাছে।’ মনে পড়তেই পকেট থেকে মাস্ক বের করে পরে নেয়।
তখনই ব্যাপারটা খেয়াল হয় জ্যোতিষীর। এই করোনা ভাইরাসের কথা সে শুনেছে। বারবার সাবান পানি দিতে হাত ধুতে হবে, মুখে মাস্ক পরতে হবে, মানুষের থেকে দূরে সরে থাকতে হবে এগুলো সে জানে। আবার এও জানে দেশের সরকার বলেছে এই দেশে এই ভাইরাস হবে না, হলেও পাত্তা পাবে না। সেই মতেই সবকিছুই তো চলছিল, এখন নতুন করে আবার কি হলো?
নতুন করে খবরটা মজিদই জানায়। সরকার করোনা ভাইরাসকে রুখে দেওয়ার জন্য পনেরদিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে এবং বলেছে তাতেও কাজ না হলো আরো পনের দিন, এভাবে বাড়তেই থাকবে।
শনি রাহু কেতুর গতিপথ ও খবরাখবর জানা জ্যোতিষী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। মানুষই যদি না থাকে তাহলে মানুষের জন্য অপেক্ষা করে ফায়দা কি? তবুও এসেই যখন পড়েছে, আর কলোনীর একচিলতে গা ঘেষাঘেষির ঘরে ফিরতে মন চায় না বলেই সে দারোয়ানের দিকে কাচুমাচু চোখে তাকিয়ে বলল, ‘একটু বসে দেখি। বউনিটা হয় কিনা!’
দারোয়ানও আর কিছু না বলে ফাকা পার্কের ভেতরে ঢুকে পড়া কুকুর তাড়াতে এগিয়ে গেল।
জ্যোতিষী দাবার ছকের প্লাস্টিক বিছিয়ে পার্কের দেয়ালের দিকে বসে কাপড়ের ঝোলা থেকে একের পর এক ভাগ্যগণণার জিনিসগুলো বের করে খুব বিছিয়ে রাখে। কাধের টিয়াপাখি নিচে নেমে গম্ভীরভাবে পায়চারী করতে থাকে। হস্তরেখা বিচারের হাতের তালুর রেখা আকা প্লাকার্ড, কতগুলো হলদেটে হয়ে যাওয়া কড়ি ও একটি লালরঙের প্রচ্ছদের পঞ্জিকা, একটা সরিষার তেলের বোতল, এগুলো ছকের একপাশে গুছিয়ে রাখে। ছকের মধ্যে নানারকম অক্ষর, জাফরানি রঙের আরবী হরফ, অংক সংখ্যা, হিসেব রোদের মধ্যে তাকিয়ে থাকলেও তার হিসাব মেলে না।
কোথায় শনি, কোথায় মঙ্গল, কোথায় রাহু, কোথায় কেতু অবস্থান করলে অদৃষ্টচক্রের কোথায় কি ঘটে সেগুলো আগ থেকে ছক কষে বের করে জ্যোতিষী। জ্যোতিষী হাত দেখে রাশি বিচার করে তার সমন্ধে ভালোমন্দ বলে দিতে পারে। একটি স্লেটের উপর চক দিয়ে দেগে অংক কষে লোকটির জীবনের অবধারিত পরিণাম, আসন্ন পরিণামের আভাস, ভবিষ্যতের খবর বলে দিতে পারে। মানুষের কররেখা দেখে, এমনকি স্বপ্নের বর্ণনা শুনেও ভবিষ্যতের অনেক ভালোমন্দ সম্ভবনার কথা আগাম বলে দেয়।
তবে সবচেয়ে বড় আর্কষণ টিয়াপাখির ভাগ্য গণনা। ছেলেবুড়ো সবারই টিয়াপাখির ভাগ্য গণনায় বেশি আগ্রহ দেখা যায়। টিয়াপাখির কানের কাছে মন্ত্রপুত কড়িগুলো নিয়ে জ্যোতিষী বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে টিয়াপাখিকে কিছু একটা নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই টিয়াপাখি বহু ব্যবহারে মলিন হয়ে যাওয়া কাগজের খামগুলোর উপর দিয়ে একবার এপাশ ওপাশ হেটে অপেক্ষারত মানুষটির উৎকণ্ঠা তাতে বাড়ায়। অনেকগুলো খাম নেড়েচেড়ে একটা খাম তার বাকানো ঠোটে তুলে নিয়ে জ্যোতিষীর কাছে দেয়...
আজ এসবের কিছুই হবে না বুঝে ফেলেছে জ্যোতিষী। পার্ক বন্ধ, মার্কেট বন্ধ, স্কুল বন্ধ। এই ব্যস্ত রাস্তা ধরে ¯্রােতের মতো যে মানুষগুলো এতোদিন তার সামনে দিয়ে পার হতো, আজ সেই ¯্রােত একেবারে থেমে গেছে, মরা নদীর সোতার মতোই কোন জনমানুষের চিহ্ন বলতে গেলে নেই।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না জ্যোতিষীকে। মুখে মাস্ক পরা পুলিশ মেইনরাস্তার উপর থেকেই তার দিকে লাঠি উচিয়ে কুকুর তাড়ানোর মতো ভঙ্গিমায় ওখান থেকে উঠে যেতে ইশারা করে। জ্যোতিষী জানে, এই শহরের সবচেয়ে বড়ো মালিক হচ্ছে পুলিশ, মালিককে রাগিয়ে এখানে বসে থাকা যাবে না। সেও মুখে হাসি টেনে পুলিশের কাছে মাফ চাওয়ার ভঙ্গিমা করতে গিয়ে বুঝতে পারে তার মুখে মাস্ক নেই, তাড়াতাড়ি হাসিটা গিলে ফেলে। একটা মাস্কের কত দাম কে জানে?
তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিষন্ন মুখে জনবিরল ফুটপাথ দিয়ে হাটতে হাটতে মাস্ক কোথায় পাওয়া যাবে ভাবতে থাকে। ওষুধের দোকানেই পাওয়া যাবে হয়তো। আগারগাওয়ের মোড়ের ফার্মেসীতে ‘মাছ আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই জানায়, ‘আছে, বিশ টাকা লাগবে।’
টিয়াপাখির ছোলা কেনার জন্য এই টাকাটা আলাদা করে রাখা ছিল। কিন্তু রাস্তায় পুলিশের লাঠিসেবা খাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই, কাজেই আগে জীবন বাচুক, টিয়াপাখির খাবার পরে দেখা যাবে। মাস্কটা মুখে দিয়ে হেটে হেটে বস্তির বাসায় চলে এলো।
বাশ দিয়ে লকডাউন দেয়া হয়েছে। সকালে বের হওয়ার সময়ও এরকমটি দেখেনি। দুই ছোকড়ার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বাশের নিচ দিয়ে ঢুকে পড়ল। ছোট্ট এক চিলতে ঘরে ঢুকতে দেখে বউ অবাক হলেও তেমন কিছু বলল না, সেও কানাকানিতে ঘরে বন্ধ থাকার কথা শুনেছে। ‘এরকম বন্ধ থেকে আমাদের কতদিন চলবে? হাড়ায় লাথি পড়লো বলে।’
জ্যোতিষ নিচু স্বরে বলল, ‘কোনমতে চালাও দেখি। আর মার শরীরের দিকে খেয়াল রেখো। বুড়োবুড়ির নাকি করুনার ভয় বেশি!’
‘আলাদা করে আর কি খেয়াল রাখব? তুমি যা আনবে তাই তো খাবে!’
জ্যোতিষী আর বউকে ঘাটাল না।
লকডাউনের পনেরদিনে একবারও বাড়ির থেকে বের হতে পারেনি জ্যোতিষি। চেষ্টাচরিত্র করে বের হলেও কোন লাভ হতো না। যেখানে মানুষই নেই সেখানে হাত দেখাবে কে? এদিকে বাড়িতে যতটুকু সঞ্চয় ছিল ধারদেনাবন্ধক সব করেও হাড়ার শূণ্য হয়ে গেল। মানুষের মুখে দুমুঠো তুলে দেওয়া তো দূরে থাক, অবলা পাখিটার দানাপানিও জোগাড় করা সম্ভব হলো না। বুড়িমার মতোই টিয়াপাখি নেতিয়ে যেতে লাগল। জ্যোতিষী আর বউ শুধু পানি খেয়েই কাটিয়ে দিল দুদিন। আশেপাশেরও ঘরগুলোরও অবস্থা প্রায় একই রকম। অনেকে পেটের তাগিদে ভিক্ষা করতে বের হয়েছে। জ্যোতিষীর এতোদিনের পরিচিতির কারণে সে ভিক্ষা করতে বের হতে পারছে না। অভুক্ত পেটে দাড়ে বসা টিয়াপাখির গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এই টিয়াপাখি যে তার রুটিরোজগারের উৎস, সন্তানসম।
এরই মধ্যে বুড়িমা অসুস্থ হয়ে পড়ল। তবে তার মধ্যে করোনার কোন লক্ষণ নেই। না খেতে পেয়ে পেয়ে হাড্ডিচর্মসার শরীর আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। পেটে দানাপানি না দিলে আর বোধ হয় বাচানো যাবে না।
পনেরদিনে লকডাউন শেষ হবে বলে দম ধরে ছিল জ্যোতিষী। কিন্তু পনেরদিন পরে আবারও পনেরদিনের লকডাউন ঘোষণা করলে মুষড়ে পড়ল। ভিক্ষাবৃত্তি করতে হলেও ঘরে বসে হবে না, পথে বের হতে হবে। লকডাউন উপেক্ষা করে চোরের মতো বেরিয়ে পড়ল পথে। সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে চেয়েচিন্তে কয়েকটা টাকা জোগাড় করতে পেরেছিল। কিন্তু লকডাউন ভেঙে বের হওয়ায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সেটুকুও অর্থদন্ডি দিতে হলো।
দিনশেষে শূন্য হাতে ঘরে ফিরল জ্যোতিষী। টিয়াপাখির জন্য কটা দানাপানি জোগাড় করতে পেরেছিল। সেট্ইা পকেটে আছে। ঘরে ঢুকতেই মাংসের লোভনীয় মৌ মৌ গন্ধে অভুক্ত খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল। দেখল বুড়িমাও উঠে বসে তৃপ্ত মুখে মাংসের সুপের মতো কি যেন খাচ্ছে। এই আকালের দিনেও বউ মাংস জোগাড় করতে পেরেছে দেখে খুশি হলো সে।
টিয়াপাখির দানাপানিগুলো বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে আনন্দিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের মাংস রেধেছো?’
‘টিয়াপাখির!’ বউয়ের নির্বিকার জবাব!