হুমায়ূন আহমেদ উঁকি দেন দিনমান

 


 হুমায়ূন আহমেদ

উঁকি দেন দিনমান 

ইরফান তানভীর


আমার মা নিকটতম কোনো লেখককে তেমন জানেন কিনা জানিনা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে নাকি অনেক আগ থেকেই চিনতেন। জানতেন। তার গল্প উপন্যাস পড়তেন সেই নানা বাড়ি থাকতেই। ১২ তে  যখন হুমায়ূন আহমেদ মারা যান সেসময় মাকে দেখেছি বাসায় বসে বসে পত্রিকায় তিনি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখাগুলো পড়ছেন গভীর মনোযোগে। মাঝেমধ্যে আব্বু থাকতে গুলতেকিনের কথা উঠাতেন।  কোনো কোনো বিকেলে বাসায় সবাই বসে আছি হয়ত। প্রসঙ্গ উঠতো মেহের আফরোজ শাওনকে নিয়ে। মেয়ের বান্ধবী! 

একজন হুমায়ূন আহমেদ নানাদিকে নানাভাবে বেজে উঠেন।

তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ মেধাবী লেখক। লেখক হুমায়ূন আহমেদের অনুপম উপস্থাপনশৈলী অনবদ্য রসবোধ আর জীবন নিয়ে অসামান্য  পর্যবেক্ষণ তাঁকে আসিন করেছে মহা নন্দিত এক জাদুর আসনে। হুমায়ূন আহমেদ যেনো এক জাদুর কলম হাতে নিয়ে জন্মেছেন। তার জাদুকরী হাতের লেখায় বাংলা সাহিত্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে।


ভাষা প্রয়োগ আর নান্দনিক চরিত্র নির্মাণ করে  হুমায়ূন আহমেদ তার লেখাকে নিয়ে গেছেন  অন্য এক উচ্চতায়। যা পাঠকের কাছে জীবন্ত মনে হতো। মনে হতো এইসব গল্প তাদের নিজেদের’ই গল্প অথবা এ হচ্ছে মানবজীবন। 


 একজন লেখকের সার্থকতা কোন জায়গাতে? অবশ্যই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদকে যেনো এই বাংলা মুলুকের পাঠকরাই পরম যতেœ কাছে টেনে নিয়েছেন। এর অবশ্য কারণও আছে।


বলতে দ্বিধা নেই- হুমায়ূন আহমেদ পাঠকের আগ্রহকে গুরুত্ব দিতেন অনেকবেশি। তিনি বুঝতে চাইতেন পাঠক গল্পের বয়ানে কেমন পটভূমি চাইছেন! চিন্তা করতেন পাঠকের সীমিত অবসর নিয়েও। 

কাহিনীর বিবরণীতে তিনি অযথা বর্ণনায় যেতেন না। দুই পৃষ্ঠার একটা বর্ণনা তিনি এক সংলাপেই প্রকাশ করতে পারতেন। এজন্য লেখক হুমায়ূন আহমেদের গল্পের মায়াজালে পাঠক বুঁদ হয়ে যায়। বিরক্তি আসেনা। হুমায়ূন আহমেদের বই শেষ করে ফেলে এক বাসাতে। পাঠক যে দ্রুতগতিতে চলতে পছন্দ করে হুমায়ূন আহমেদ সেটি বুঝতেন এবং সেদিকে তিনি মনোনিবেশও করেছেন। অযাচিত কোনো বর্ণনায় গিয়ে পাঠককে বিরক্ত করেননি। 


হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার অথবা নন্দিত নরকের মতো পরিপূর্ণ একটা জীবনের এপিঠ ওপিঠ তিনি উপস্থাপন করেছেন খুবই অল্প পৃষ্ঠায়। লিও টলস্টয়  এ বইগুলোর বয়ান দেখলে আন্না কারেনিনার মতো দীর্ঘ কলেবরের বই  করতে চাইতেন। তিনি হয়ত বলতেন- এত অল্প কথায় শেষ করা কী করে সম্ভব!  

কিন্তু সৃষ্টিশীল লেখক হুমায়ূন আহমেদের সে ক্ষমতা ছিলো। তিনি গল্পের জন্য যে ফাঁদ পাততেন, সেখানে সবাই ধরাশায়ী হতো।


এ কথা তো চিরসত্য যে বাংলাদেশের পাঠক তৈরিতে হুমায়ূন আহমেদের অবদান অবিস্মরণীয়। বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদ যখন যেতেন, সমস্ত স্টলগুলো ফাঁকা হয়ে জনস্রোত গিয়ে ভিড় করত হুমায়ূন আহমেদের চারদিকে। একজন হুমায়ূন আহমেদ লেখালেখির পাতায় যেমন উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছেন ঠিক তেমনই নির্মাতা হিসেবেও হালআমলের মহারথী হয়ে আছেন। 


জীবনঘনিষ্ঠ, সাবলীল পটভূমি আর  আবহমান বাংলার মানুষের জীবন বৈচিত্রকে অসাধারণ বৈভবে টিভি পর্দায় নিয়ে এসেছেন এ কারিগর।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে  বাংলা সাহিত্যের চালকের আসনে বসেও হুমায়ূন আহমেদ বিন্দুমাত্র যৌনতার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। 


একজন গল্পবাজের ক্লান্তিহীন ভাবে কত গল্প বলতে পারাকে আপনার জাদুকরী মনে হবে! 

হূমায়ূন আহমেদ সে গল্পজাদুর জাদুকর।

মানুষটি  তিন দশকেরও বেশী সময় পর্যন্ত আমাদেরকে গল্পের পাতায়  পাতায় জমিয়ে রেখেছেন। কী নান্দিনকতায় তিনি হেঁটেছেন।  অথচ কতো বিবর্ণ ছিলো সে দীর্ঘতম পথ। 

ব্যাক্তি হুমায়ূন আহমেদের শিল্প-সৌন্দর্য আত্মবিশ্বাসের সাথে বেজে উঠে পরম্পরায়।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট