হাল আমলে মুসলমানদের আইডেনটিটি ক্রাইসিস, জাতিসত্তা ও জাতীয়তা নিয়ে বাঙালি মুসলমানের অবসেশন
হাসনাত আসিফ কুশল
অবসেশন কথাটি বস্তুত মানসিক পীড়াগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে বোঝায়। স্পেসিফিক অর্থে শুচিবায় বলা যেতে পারে। বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা দেখলে এই পীড়া খুব ভালোভাবে অনুধাবন করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার করার প্রবণতা থেকে এমন পীড়ার উদ্ভব হয়েছে। যেন আমাদের ভেতর থেকে আত্মিক প্রশান্তি তুলে নেয়া হয়েছে।
পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে সুসম্পর্ক ছিলো তার মূলে আঘাত করেই পাকিস্তানের কায়দÑইÑআযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উদ্ভাবন করলেন ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’। জিন্নাহর ‘এক প্লেটে হিন্দু মুসলিম খায় না’ এমন তত্ত্ব মেনে নিতে পারেন নি ভারতের কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ। বিশেষ করে প-িত জওহরলাল নেহেরু ও মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধী এ ব্যাপারে ভিন্নমত অবলম্বন করেছিলেন। প-িত জওহরলাল নেহেরু যুক্ত ভারত তথা অখ- ভারতের প্রস্তাব করলেও শেষ অবধি তৃপ্তির হাসি হাসলেন জিন্নাহ। দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে ভ্রান্ত, উদ্ভট ও ব্যর্থরাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। একদিকে চাঁদতারাখচিত সবুজসফেদ পতাকা উড়ছে, অপরদিকে স্বাধীনতার বাঁধভাঙা অপেক্ষা। এই অপেক্ষা মোটেই শান্তিময় ছিলো না। বরং দুই দেশের মানুষকে দেশত্যাগের অপরিসীম ও অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট কী ছিলো আর অখ- ভারতবর্ষে তদানীন্তন হিন্দু ও মুসলমানের ভেতর সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা এবং পরবর্তীতে মুসলমানদের মধ্যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস সম্পর্কে এখানে তুলে ধরার প্রয়াস করছি।
বঙ্গভঙ্গ ও তদানীন্তন ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা :
ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ এবং এর মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরম্পরা এখানে তুলে ধরার প্রয়াস করছি। তদানীন্তন ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করার প্রয়োজন অনুভব করেছি। তাই সেসব উল্লেখ করে এই প্রবন্ধটি লেখা শুরু করছি। কেননা ভারতের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ এবং দেশভাগ গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কেননা এ দুটো অনভিপ্রেত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ভারতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে।
বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপট :
পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমাগত বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার মূলে রয়েছে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস। এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিস পাকিস্তান সৃষ্টির পরে শুরু হলেও এর শেকড়টি ছিলো ব্রিটিশ শাসনামলে। সুচতুর ব্রিটিশরা ঠিকই বুঝেছিলো যে এখানে তাদের প্রভুত্ব বিস্তার করতে গেলে বিভাজনের প্রয়োজন। কিন্তু জাতিতে বিভাজন ? সম্ভব নয়। কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে বিভাজন ? অসম্ভব। দেখা গেল ধর্মের নামে যদি এই উপমহাদেশের লোকজনকে উন্মাদ করে রাখা যায় তাতে ব্রিটিশরা দীর্ঘ দিন এই বিবাদ মীমাংসার নামে এখানে অবস্থান করতে পারবে। এদেশে ব্রাহ্মণÑকায়ঃস্থ’র মধ্যে ভেদাভেদ রয়েছে কিন্তু তা কখনো দাঙ্গাহাঙ্গামায় রূপ নেয় নি। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান সংঘাত তা এ পর্যন্ত আদর্শিক রূপ পেয়েছে।
ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হলো তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। অর্থাৎ আল্লাহকে একমাত্র উপাস্য হিসেবে এবং হযরত মুহাম্মাদকে (সাঃ) মুসলমানরা সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। আর হিন্দু ধর্মের ভিত্তি হলো তাদের তেত্রিশ কোটি দেবদেবী। ভারতবর্ষের হিন্দুরা বিশ্বাস করে থাকে, সমগ্র বিশ্ব ত্রিমূর্তির পরিচালনাধীনÑব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। হিন্দু ধর্মের এই ত্রিমূর্তি ভাবনার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের ট্রিনিটি’র সাদৃশ্য লক্ষ্যনীয়। এছাড়া এই উপমহাদেশে পারস্যের জরুথুস্ত্রবাদ, নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ ও জৈন এবং শিখ ও ইহুদি ধর্মের ক্ষুদ্র প্রভাব রয়েছে। আর মুসলমানদের মধ্যে দল ও উপদলে ভেদাভেদ শুরু হয়েছিলো শিয়া ও সুন্নী দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে। শিয়া সম্প্রদায় হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র (সাঃ) পরে খিলাফতের হক্বদার হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। অতঃপর নবী নূরের নাকি মাটির তৈরি, নবী গায়েব জানতেন কী জানতেন না এসব বিষয়ে মুসলমানদের ভেতর বহু দল ও উপদল গড়ে ওঠে। বাংলাদেশ এবং গোটা বিশ্বে মুসলমানদের মধ্যে এমন বিভক্তি অনভিপ্রেত এবং অনাকাক্সিক্ষত। কারণ মুসলমানরা পরস্পর ভাই। আর আমরা তো সকলেই আদমসন্তান। যিনি হিন্দু তিনিও তো আদমসন্তান। মুসলমানরা পরস্পর পরস্পরের বিপদেআপদে এগিয়ে আসেন; সহমর্মিতা জানান। কালক্রমে মুসলমানদের গ-ি বিস্তৃত হলে ভারতবর্ষ পর্যন্ত ইসলাম প্রবেশ করে। পরবর্তীতে পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ হয়ে ওঠে মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল।১
বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ও তার প্রতিক্রিয়া :
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হন। এরপর এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী কতৃত্ব বিস্তার করে। বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের পর ব্রিটিশরা মহীশূরের টিপু সুলতানকে পরাজিত করে এবং সমগ্র দক্ষিণ ভারত করায়ত্ত করে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে তিন ভাগে বিভক্ত করে : বাংলা প্রেসিডেন্সি, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ও বম্বে (মুম্বাই) প্রেসিডেন্সি। কিন্তু বাংলা প্রেসিডেন্সি ছিলো আয়তনে সুবিশাল। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম এবং ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে এই প্রেসিডেন্সি গঠিত হয়েছিলো। সেসময় এই প্রেসিডেন্সি ছিলো একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এই সুবিশাল বঙ্গাঞ্চলের দেখভাল করা একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ছিলো। বাংলার হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ‘পশ্চিম বাংলায়’ যোগাযোগ ও জীবনব্যবস্থার কিছু উন্নয়ন হলেও কার্যত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ‘পূর্ববঙ্গ’, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা অবহেলিত রয়ে যায়। বিষয়টি অচিরে ব্রিটিশ প্রশাসনের দৃষ্টিগোচর হয় ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময়। এ দুর্ভিক্ষের মূল কারণ অনুসন্ধানে তদানীন্তন ভারত বিষয়ক সচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড হেনরি নর্থকোর্ট একটি কমিটি গঠন করেন ও বাংলা প্রেসিডেন্সির অভ্যন্তরীন প্রশাসনিক সমস্যা কমিটির রিপোর্টে উঠে আসে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৮৬৭ সালে বাংলার ছোটলাট উইলিয়াম গ্রে বাংলা প্রেসিডেন্সিকে ভাগ করার জন্য সুপারিশ করলেও তদানীন্তন বড়লাট তথা ভাইসরয় লরেন্স এতে বাধা দান করেন। লরেন্স বরং আসাম এবং তার পাশ্ববর্তী জেলাসমূহের বিভাজনের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য লরেন্সের যুক্তি না মেনে বঙ্গবিভাজনের অনুকূলে চিন্তাভাবনা শুরু করে দেয়। এই কারণে ১৮৭২ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট বিবেচনায় এনে তদানীন্তন ছোটলাট ক্যাম্বল বঙ্গ বিভাজনের সুপারিশ করতে থাকে। তার সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৭৪ সালে আসামকে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ থেকে পৃথক করা হয়। এর ফলে আসামের বাংলা ভাষাভাষী তিনটি জেলাÑ শ্রীহট্ট (সিলেট), কাছাড় ও গোয়ালিয়র বাংলা থেকে পৃথক হয়ে যায়। এ তিনটি জেলার দায়িত্ব পড়ে চিফ কমিশনারের ওপর। ১৮৯৬ সালে আসামের তদানীন্তন চিফ কমিশনার উইলিয়াম ওয়ার্ড ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামকে আসামের অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব করেন। হেনরি কটন এতে বিরোধিতা করেন এবং নাকচ করে দেয়া হয়।১
বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে দেনদনবার :
১৯০১ সালে মধ্য প্রদেশের চিফ কমিশনার অ্যা-্রু ফ্রেজার উড়িয়া ভাষাভাষী অঞ্চলকে আসামের অন্তর্ভূক্ত করে একটি পৃথক প্রেসিডেন্সির প্রস্তাব করেন। তিনি অবশ্য তদানীন্তন বড়লাট কার্জনের নিকট যুক্তি প্রদর্শন করেন, এক্ষেত্রে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলকে আসামের অন্তর্ভূক্ত করা হলে ব্রিটিশদের শাসনকার্যে সুবিধা হবে। কার্জন ফ্রেজারের কথামতো ১৯০২ সালে ‘বাংলা প্রেসিডেন্সির’ সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজনের কথা জানান। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী হাবার্ট রিজলে চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে আসামের চিফ কমিশনারের অধীনে করে দেয়ার সুপারিশ করেন। তবে এ সুপারিশের পর সরকারি ও বেসরকারি মহলে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।১
লর্ড কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফর :
১৯০৪ সালে তদানীন্তন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম সফরে আসেন এবং ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মুসলমান নেতৃবর্গকে নিয়ে সভা আহবান করেন। এ সভায় ঢাকাকে পূর্ববঙ্গের রাজধানী করার এবং মুসলমানদের সুযোগসুবিধা দেয়া হবে মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন। লর্ড কার্জনের এই সফর বঙ্গভঙ্গ এবং ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কেননা একদিকে যেমন ব্রিটিশদের মধ্যে প্রশাসনিক দেনদরবার চলছিলো, তেমনই অন্যদিকে বঙ্গীয় অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় একত্রে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছিলো। ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মুসলিম ক্রানিকল’ নামক পত্রিকার সম্পাদকীয় অংশে উল্লেখ করা হয়, ‘জনগণÑসম্পর্কিত কোনও বিষয়ে দেশবাসী এতখানি ঐক্যবদ্ধ আগে কখনও হয়নি, যতটা প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হয়েছে।’ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ভ-ুল করে দেয়ার জন্য এবং বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে মুসলমানদের জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে কার্জন এই সফরে এসেছিলেন। তদানীন্তন মুসলিম নেতৃবর্গ কার্জনের এমন প্রতিশ্রুতিতে মজে গেলেন। ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমোল্লা মানুষকে এ কথা বোঝাতে সমর্থ হন যে আদতে বঙ্গভঙ্গ মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর। কিন্তু পশ্চিম বাংলায় হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদের’ সমতুল্য বলে অভিহিত করে এর বিরুদ্ধে পূর্ববৎ আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। পূর্ববঙ্গেও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতে থাকে। ফলে লর্ড কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফর বঙ্গীয় ভূমিতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির যবনিকা ঘটিয়ে দিয়েছিলো। কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফরকে কেন্দ্র করে মুসলিম নেতৃবর্গের ব্রিটিশপ্রীতির বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের সেন্ট্র্যাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন বিক্ষুব্ধ হয়। কারণ নওয়াব স্যার সলিমোল্লা ছিলেন ব্রিটিশদের প্রতি অনুরক্ত। সুতরাং ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় সেন্ট্র্যাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের এক সভায় মৌলভী শামসুল হুদা ও মৌলভী সিরাজুল ইসলাম বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেন। শামসুল হুদা বলেন, ‘মুসলিম সংগঠনগুলির ততখানি জোরের সঙ্গে প্রতিবাদ করা উচিত যতটা হিন্দু সংগঠন গুলি করছে, কারণ এতে হিন্দুÑমুসলমান উভয়ের স্বার্থ জড়িত।’ সেন্ট্র্যাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি জাতির কোন অংশকে বাঙলা থেকে আলাদা করা উচিত হবে না, যদি প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোই বিভাজনের উদ্দেশ্য হয় তাহলে সমগ্র বাঙলাকে মাদ্রাজ এবং বোম্বাইয়ের মতো নির্বাহী পরিষদ (ঊীবপঁঃরাব ঈড়ঁহপরষ) গঠন করে গভর্ণরের শাসনাধীনে আনা হোক।’ এ ছাড়া মুনতাসির মামুন সংকলিত ‘উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদÑসাময়িকপত্র’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে সেই সময় পূর্ববঙ্গ থেকে ঢাকা প্রকাশ ও বেঙ্গল টাইমস পত্রিকা বঙ্গভঙ্গের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। তবে কার্জনের পূর্ববঙ্গ সফরে মুসলিম নেতারা আনুগত্যের ছবক দিলেও মার্চ মাসে পূর্ববঙ্গের ঢাকার জগন্নাথ কলেজে হিন্দু ও মুসলমানের এক যৌথ সভায় ‘ভাইসরয়ের মিষ্টি কথাতে জেলার জনগণের মন ভোলেনি’ মর্মে প্রস্তাব পেশ করা হয়।২
বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা, বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে রাজনীতি এবং পরিপ্রেক্ষিত আন্দোলন :
১৯০৫ সালের ৯ জুন তদানীন্তন ভারত বিষয়ক সচিব ব্রডরিক বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন এবং ১০ জুলাই তা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হয়। ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে এবং ১৬ অক্টোবর থেকে তা কার্যকর করা হয়।
বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষি ক্রমান্বয়ে বিস্তৃত হতে থাকে। এর ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলিম নেতৃবর্গ মুসলিমদের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। ফলে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠন করে। ১৯০৭ সালে গঠিত হয় ‘বঙ্গীয় মুসলিম লীগ’। অপরদিকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবিস্তৃত সংঘাতময় পরিস্থিতির ভেতরে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী ও উদারপন্থী দুই পক্ষের উত্তেজনা শুরু হয়। ১৯০৫ সালে বেনারসে গোপালকৃষ্ণ গোখলে’র সভাপতিত্বে অধিবেশনে অনভিপ্রেত বিভক্তির হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পায় কংগ্রেস। ১৯০৬ সালেও কলকাতায় দাদাভাই নওরোজির সভাপতিত্বে বৈঠক হয় এবং দাদাভাই নওরোজির মধ্যস্থতায় বিভক্তি এড়ানো সম্ভব হয়। কিন্তু ১৯০৭ সালে সুরাটের অধিবেশনে কংগ্রেস দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চলতে থাকে স্বদেশী ও চরমপন্থী আন্দোলন।
বঙ্গভঙ্গ রদ পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম বাংলার প্রতিক্রিয়া :
ব্রিটিশ রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড ১৯১০ সালের ৬ মে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার ছেলে পঞ্চম জর্জের অভিষেক ১৯১১ সালের ২২ জুন অনুষ্ঠিত হয়। এ বছর নভেম্বর ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ তার রাণী মেরিকে নিয়ে রাজকীয় শোভাযাত্রা সহকারে ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করেন এবং দিল্লিতে ৭ ডিসেম্বর পৌঁছান। দিল্লিতে এসে রাজা পঞ্চম জর্জ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা পূর্বতন বাংলা এবং পূর্ববঙ্গ ও আসাম বিচ্ছিন্ন অখ- বাংলা প্রদেশ গঠিত হবে, বাংলা প্রদেশের শাসনভার ভারতের গভর্নরের হাতে ন্যস্ত করা হবে এবং কলকাতার পরিবর্তে ভারতের রাজধানী হবে দিল্লি। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, দার্জিলিং ও ত্রিপুরা এবং আসাম নিয়ে ১৯০৫ সালে গঠিত ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে নতুন প্রদেশ এবং পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ‘পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের’ বিলুপ্তি ঘটে এবং আন্দোলনরত পশ্চিমবাংলার হিন্দু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম বণিক সম্প্রদায় এতে উল্লসিত হয়। অপরদিকে ঢাকায় নওয়াব স্যার সলিমোল্লা এবং বঙ্গভঙ্গের সমর্থকরা হতাশ হয়ে পড়েন। এর ফলে মুসলিম নেতৃবর্গ তদানীন্তন ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এর নিকট যথাবিহিত আবেদন করলে এর পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড হাডিঞ্জ পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন। এ মর্মে মুসলিমরাও খুশী হয়। কারণ লর্ড ক্যানিং ১৮৫৭ সালে ‘দ্য অ্যাক্ট অব ইনকর্পোরেশন’ জারি করার মধ্য দিয়ে কলকাতা, মাদ্রাজ ও বম্বেতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাক্সক্ষা করতে থাকে। আর তাদের দীর্ঘ আকাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশ্রুতিতে মুসলমান নতুন আশায় বুক বাঁধে।
আইডেনটিটি ক্রাইসিসের মূল!
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পেছনে ছিলো ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি ও বাঙালি মুসলিম রাজনৈতিক শ্রেণির অর্থনৈতিক স্বার্থ। বিশেষ করে মুসলিম লীগের রাজনীতিবিদদের পাকিস্তান সৃষ্টির আকাক্সক্ষার পেছনে সবচেয়ে যে বিষয়টি কাজ করেছে, তা হলো বহু জাতির ভারতবর্ষে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের লেলিয়ে দেয়া দীর্ঘদিনের মুসলিমবিদ্বেষ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা। ১৯০৭ সালে সুরাটের অধিবেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্তির পর থেকে নবসৃষ্ট এ সাম্প্রদায়িকতা নতুন রূপ ধারণ করে। এর আগে ১৯০৫ সালে বারানসী অধিবেশনে কংগ্রেস বিভাজিত হতে গিয়েও গোপালচন্দ্র গোখলে’র হস্তক্ষেপে অল্পের জন্য রক্ষা পায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ১৯০৬ সালের কলকাতা অধিবেশনেও এ উপক্রম হয়েছিলো। শুরু থেকেই কংগ্রেসের ভেতর এই বিভক্তি ভারতবর্ষকে নিয়ে যায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতার দিকে। সুরাটে ভ-ুল হয়ে যাওয়া কংগ্রেসের অধিবেশনে ব্রিটিশ শাসন নির্মূলের ব্যাপারে চরমপন্থা অবলম্বনকারীদের ভেতর বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন অগ্রগণ্য। বিশেষ করে অশ্বিনীকুমার দত্ত ১৮৮৫ সালে গঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে ‘তিন দিনের তামাশা’ মন্তব্য করে বসলেন। ওদিকে উদারপন্থা অবলম্বনকারীদের মধ্যে ছিলেন গোপালকৃষ্ণ গোখলে, ফিরোজ শাহ মেহতা, বদরুদ্দিন তায়েবজি, শঙ্করণ নায়ার, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেন্দ্র্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দাদাভাই নওরোজি অগ্রগণ্য। আবার মুসলিমরা ১৯০৬ সালের মধ্যেই ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ গঠন করে ফেলেছে। ব্রিটিশরাও ১৯০৫ সালে শাসনের সুবিধার কথা বলে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা দেয়। ফলে বাংলায় হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে দাঙ্গাপ্রদ অবস্থার সৃষ্টি হয়। সুচতুর ব্রিটিশ সরকার যায় ঘাবড়ে। ফলে ১৯১১ সালে আকস্মিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। এরপর নাটকীয়ভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে এবং বাংলায় হিন্দুÑমুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট হতে থাকে। সুভাষচন্দ্র রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, সৈয়দ আমীর আলী, মহাত্মা গান্ধীসহ বহু রাজনীতিবিদ ব্রিটিশদের এ উপমহাদেশ থেকে তাড়ানোর সব রকম প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন। শেষমেশ লাহোর প্রস্তাব সামনে দেখিয়ে ১৯৪৭ সালে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ‘দ্বিÑজাতি’ অনুযায়ী পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বাধীন হয়।
লাহোর প্রস্তাব :
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণ করেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনিই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তি হিসেবে সুপরিচিত। ১৯৪০ সালের ২২ মার্চ লাহোরে সম্মেলনে দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি যা বলেছিলেন তার সারমর্ম হলো, হিন্দু ও মুসলিমদেরকে এক পরিচয়ে পরিচিত করার চেষ্টা স্বপ্নমাত্র। ‘হিন্দু ও মুসলিমদের ধর্মীয় দর্শন ভিন্ন, সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন। এই দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে হয় না, তারা একত্রে খায় না। তারা পৃথক সভ্যতার অংশ যে সভ্যতার মতাদর্শ ও ধ্যানধারণা ভিন্ন।’
লাহোরে দেয়া বক্তব্যেই তিনি তার উদ্ভাবিত ‘দ্বিÑজাতি তত্ত্বের’ ধারণা পরিষ্কার করে দেন। এরপর ২৩ মার্চ কৃষক প্রজা পার্টির শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব পাঠ করেন এবং বক্তৃতা দেন। এ সময় চৌধুরী খালিকুজ্জামান এ প্রস্তাব সমর্থন করে বক্তব্য দেন। এরপর ২৪ মার্চ সকলের আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাবটি পাস হয়। এরপর পরের বছরের জন্য কার্যকরী কমিটি নির্বাচন করে অধিবেশন মুলতুবি হয়ে যায়। (পৃষ্ঠাÑ১৬, মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০)
লাহোর প্রস্তাবের প্রাথমিক খসড়াটি তৈরি করেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী স্যার সিকান্দার হায়াত খান। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়াটি তৈরি করেন স্যার জাফরুল্লাহ খান। মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ের ১৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, এ প্রস্তাব সাবজেক্ট কমিটির সভায় পুরোপুরি বদলে ফেলা হয়। এতে কস্মিনকালেও ‘পাকিস্তান’ শব্দটির উল্লেখ ছিলো না। লাহোর সম্মেলনেই এ প্রস্তাবটি পাঠ করে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক আবেগতাড়িত হয়ে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, ‘যদিও আমি বাংলায় একটি কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছি, বলতে দ্বিধা নেই আমি প্রথমে একজন মুসলমান, তারপর একজন বাঙালি। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোর মুসলমানদের ওপর যদি আঘাত করা হয়, আমি বাংলার হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ নেবো। ১৯০৬ সালে বাংলায় মুসলিম লীগের পতাকা ওড়ানো হয়েছিলো এবং মুসলিম লীগের এই মঞ্চ থেকে বাংলার নেতা হিসেবে আমি মুসলমানদের আবাসভূমির জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করছি।’
‘জিন্নাহর আদর্শই এখনও পাকিস্তানের মূলভিত্তি’ শিরোনামে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘পাকিস্তানই প্রথম রাষ্ট্র যেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতেÑএকই জাতিসত্তা ও ভাষার ভিত্তিতে নয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটি ধর্মতান্ত্রিক (থিওক্র্যাটিক) রাষ্ট্রও নয়।’ ইসলামাবাদের কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক সিকান্দার কিরমানি জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত পাকিস্তান সৃষ্টির কারণ হিসেবে তারা দ্বিজাতি তত্ত্বকেই জানে। তারা মনে করে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনো ব্যাপারেই মিল ছিলো না কেবল এক দেশে বসবাস ছাড়া। তারা আরও জেনেছে, ধর্ম, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি রক্ষার জন্যই পাকিস্তান সৃষ্টির প্রয়োজন ছিলো। তবে প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান সৃষ্টির পর সবচেয়ে বেশি মুসলিম ভারতে চলে যান। তারপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা:
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সব থেকে গুরুতর আঘাত দেয়া হয় ভাষার প্রশ্নে। একেই মুসলিমদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র ভূমির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করা, তারপর আবার পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার হীনপ্রয়াস পূর্ব বাংলার মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। আর তাই এদেশের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর এ চক্রান্তকে মেনে নিতে পারে নি। সেই কারণেই পূর্ব বাংলার কয়েকজন রাজনৈতিক সংগঠক কলকাতায় সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে একত্রিত হয়ে পাকিস্তানে তাঁদের পরবর্তী কাজ কি হবে সেই বিষয়ে আলোচনা করেন। সেখানে শামিল ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী), কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহিদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমানসহ আরও অনেকে। এর আগে মুসলিম লীগের বাম ধারার কর্মীদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘গণআজাদি লীগ’। সে সংগঠনের সঙ্গে মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমেদ সহ আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন। তাঁরা মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন। কলকাতার আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা একমত হন যে পূর্ব বাংলায় অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনকে বেগবান করতে উপযুক্ত সংগঠনের প্রয়োজন। আর সেই উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসে তারা কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, অলি আহাদ, নুরুদ্দিন আহমদ, আবদুল ওদুদসহ আরও অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের সঙ্গে আলোচনায় রাজনৈতিক কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য এক সম্মেলন করার ব্যাপারে একমত হন। তখনও ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠনের অস্তিত্ব ছিলো। কিন্তু ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্টতা থাকায় মুসলিম ছাত্ররা এতে যোগ দিতে চাইতেন না। অবশেষে ১৯৮৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় খান সাহেব আবুল হাসনাতের বাসায় তসদ্দুক আহমদের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হলে পরের দিন পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে যুবলীগ প্রথমেই মুখ থুবড়ে পড়ে দলাদলির কারণে। সংগঠনের লক্ষ্য কি হবে তা নিয়ে দেখা দেয় মতভেদ। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ ৮৩ ও ৮৫ নং পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে বলেন: আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারলাম, কিছু কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন কর্মীও যোগদান করেছে।...আমি বললাম, এর একমাত্র কর্মসূচি হবে সাম্প্রদায়িক মিলনের চেষ্টা...যাকে ইংরেজিতে বলে কমিউনাল হারমনি, তার জন্য চেষ্টা করা। মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ এ শেখ মুজিবকে তখনও ‘মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য’ বলে উল্লেখ করেন। (পৃষ্ঠাÑ২৬) এসময় তিনি মুসলিম লীগ সদস্যদের একই সঙ্গে অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু তাঁকে না জানিয়ে যুবলীগের সাবজেক্ট কমিটিতে ব্যাপক হারে কমিউনিস্টমনা লোকদের নেয়া হয়। সবটাই করা হয়েছিলো সদস্য বাড়ানোর তাগিদে। শেখ মুজিবুর রহমান এটা টের পেয়ে এক সভায় যুবলীগের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে দেন। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক দেশভাগের আগে থেকেই ছিলো। পূর্ব বাংলায় এমনও অনেকে ছিলেন যারা বাংলা ভাষা শিক্ষা করতে দ্বিধা করতেন। তারা উর্দুতেই কথা বলতেন। মহিউদ্দিন আহমদ এ ব্যাপারে তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ের ২৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন:‘...জুন মাসের প্রথম দিকেই সংবাদপত্রে খবর বেরোয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছেন। বেশ কয়েকজন বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবী এর বিরোধিতা করে প্রবন্ধ লেখেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, র্ফরুখ আহমদ, আবদুল হক, আবুল হাশিমসহ আরও অনেকে। উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তের বিরোধিতা করে প্রথম প্রবন্ধ লেখেন আবদুল হক। ‘বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ শিরোনামে তাঁর লেখাটি দৈনিক ইত্তেহাদ এর রবিবাসরীয় বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দুই কিস্তিতে ছাপা হয়েছিলো। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ৩০ জুন দৈনিক আজাদÑএ ছাপা হয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন বারনী উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বিবৃতি দিলে জুলাইয়ের (১৯৪৭) শেষ দিকে তার বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ দৈনিক আজাদÑএ একটি প্রবন্ধ লেখেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে এসব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো।’
এখানে মহিউদ্দিন আহমদ এ সিদ্ধান্তে এসেছেন দেশভাগের আগেই ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জোর দাবি তুলেছেন বুদ্ধিজীবীরাই। আবার আহমদ রফিকও তাঁর ‘ভাষা আন্দোলন’ বইয়ে মত দিয়েছেন, বাংলা ভাষার স্বপক্ষে প্রথম দাবি দেশভাগের আগে থেকেই উঠছিলো ও এ কাজে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন বুদ্ধিজীবীরাই। তিনি দৈনিক আজাদÑএ প্রকাশিত আবদুল হকের ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ প্রবন্ধের সূত্র দিয়ে তাঁর বইয়ের ১২ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, ‘যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবিই সবচেয়ে বেশি।’ এখানে তিনি একে ‘রীতিমতো সোজাসাপটা কথা’ বলেও অভিহিত করেন। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র নিয়ে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর এ সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ এর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবং তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম ভাষা বিষয়ে প্রস্তাবনা পেশ করেন। এ প্রস্তাবনায় যা লেখা হয় তা মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ের ২৭ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন: পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা, আদালত ও অফিসের ভাষা হবে বাংলা এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। বদরুদ্দিন উমরও তাঁর ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইয়ের প্রথম খ-ের ১৪ ও ১৫ নং পৃষ্ঠায় এ কথা উল্লেখ করেছেন। বদরুদ্দিন উমর ১৬ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন: ‘পূর্ব বাংলার মুসলমানদের আড়ষ্টতার আরও দুটি কারণ ঘটেছিলো। প্রথমটি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবহেলা, আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ভাষার সম্পর্কিত মনে উর্দু ভাষার প্রতি অহেতুক আকর্ষণ বা মোহ।’ এরপর তিনি আরও দেখিয়েছেন: ‘বাঙালী মুসলমানের সত্যিকার সভ্যতা বলতে যেন কোনো জিনিসই নাই, পরের মুখের ভাষা বা পরের শেখানো বুলিই যেন তার একমাত্র সম্পদ। স্বদেশে সে পরবাসী বিদেশীই যেন তার আপন।’
ঢাকার নবাববাড়ির প্রভাব খর্ব করার জন্য পূর্ব বাংলায় শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ নামে একটি মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনের আহবান করে সদস্য সংগ্রহের জন্য প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আকরাম খাঁকে রসিদ বই দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মীদের রসিদ বই দেন নি বলেই উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি ‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ে ৪০ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, ওই ক্যাম্পের সবাই ছিলো সোহরাওয়ার্দি-আবুল হাশিম গ্রুপের কর্মীদের সমর্থক। আর আকরাম-নাজিমুদ্দিন গ্রুপের সমর্থকরা তাদেরকে বিপজ্জনক বলে মনে করতেন।
আর এই দলীয় রেষারেষির কারণে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনের দোতলার হলঘরে এক সম্মেলনে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
‘আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব ১৯৪৮Ñ১৯৭০’ বইয়ে ৪৩ নং পৃষ্ঠায় মহিউদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেন, কয়েকজন দলের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি তুললেও দলের অধিকাংশই এর পক্ষে ছিলেন। তাই ‘মুসলিম’ শব্দটি রাখা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘(মাওলানা) আকরাম খাঁ, নুরুল আমিন, চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও লিয়াকত আলী পরিচালিত মুসলিম লীগ হলো সরকারি মুসলিম লীগ এবং তাঁদেরটা হবে আওয়ামের অর্থাৎ জনগণের মুসলিম লীগ।’ অবশ্য ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ফলে ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। এর ফলে অমুসলিমরাও এ দলে যোগ দিতে সমর্থ হয়। তবে মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যদিও মাওলানা ভাসানী চাইছিলেন মুসলিম শব্দটি বাদ দিতে, কিন্তু হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন যে মুসলিম শব্দটি থাকুক। কারণ তাঁর ভয় ছিলো, এটা বাদ হলে পশ্চিম পাকিস্তানে জনপ্রিয়তা কমে যাবে।’
ভাষা নিয়ে পূর্ববঙ্গে সমস্যার শুরু :
ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই পূর্ব বাংলায় এক শ্রেণির মুসলমান গড়ে উঠছিলো বাংলা ভাষার প্রতি ঘৃণা আর উর্দুপ্রীতি নিয়ে। তারা উর্দুতেই কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। অথচ জন্মসূত্রে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও তারা আইডেন্টিটি হিসেবে পাকিস্তান নামক অবাস্তব ভৌগোলিক কাঠামোকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই কারণেই পাকিস্তানের সাত ভাগ লোকের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ‘কায়দÑইÑআযম’ মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বক্তৃতায় বলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার ছাত্রসমাজ ও রাজনীতিবিদরা ক্ষুব্ধ হন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তনে এ ঘোষণা আবার দিলে সেখানে উপস্থিত ছাত্ররা ‘নাÑনা’ ধ্বনিতে শোরগোল করতে থাকে। তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল মতিন (ভাষা মতিন) অন্যতম। এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের মধ্যস্থতায় উপস্থিত ছাত্ররা শান্ত হয় এবং জিন্নাহর সঙ্গে ছাত্রদের একটি দল আলোচনার জন্য যান। তবে আজও সে আলোচনার ফল সম্পর্কে জানা যায়নি।
জিন্নাহর মৃত্যু :
পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে জিন্নাহর মৃত্যু প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়। কেননা জিন্নাহই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন। আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিয়াউদ্দিন বারনী ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পর পাকিস্তানে এসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে জিন্নাহ এ প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করেন। ফলে পাকিস্তান এবং পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে জিন্নাহর নাম উল্লেখযোগ্য। মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের আহ্বায়ক তথা কায়দÑইÑআযম হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। কিন্তু ভাষা সমস্যার সমাধানের আগেই তিনি পরলোকগমন করেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশভাগের আগে থেকেই তাঁর শরীরে বাসা বেধেছিলো মরণব্যাধী। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাঃ জাল প্যাটল বলেন, ‘এক্সÑরে প্লেটে তিনি দেখেছিলেন তাঁর ফুসফুসে ছোপ ছোপ দাগ।’ কিন্তু তিনি এ কথা সবার সামনে খোলাসা করেন নি। এ বিষয়ে পাকিস্তানের লেখক তিলক দেভেশর বলেন, ‘ডা. প্যাটেল খুব পেশাদার চিকিৎসক। সেজন্যই কারও কানেই পৌঁছয়নি জিন্নাহর অসুস্থতার বিষয়টা। তবে আমার ধারণা এ কথা লর্ড মাউন্টব্যাটেন জানতেন (এ বিষয়টি), সেজন্যই স্বাধীনতার তারিখ ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারি থেকে মাস ছয়েক নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অতদিন দেরি করলে জিন্নাহ যদি বেঁচে না থাকেন! যতি গান্ধী, নেহেরু বা সরদার প্যাটেলদের কাছে জিন্নাহর অসুস্থতার খবর পৌঁছাতো, ওরাও নিজেদের নীতি বদলে ফেলে বিভাজনের জন্য আরও সময় চাইতেন।’ আর তাই তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মারা যান। ফলে পূর্ব বাংলার ভাষা সমস্যা আপাতত অমীমাংসিতই থেকে যায়।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন :
এ সময় ছাত্র ও যুব সমাজের ভেতর ভাষা প্রসঙ্গে বিক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকায় এক ভাষণে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দুই। আহমদ রফিক ও আবদুল মতিনের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য’ বইয়ে খাজা নাজিমউদ্দিনের বক্তব্য লেখা হয়েছে এভাবে, ‘পাকিস্তানকে আমরা এছলামি রাষ্ট্ররূপে গঠন করিতে যাইতেছি। যে এলমে কোপ কুসংস্কার বা ভেদাভেদ নাই সে রাত্রে কেমন করিয়া প্রাদেশিকতার বীজ বপন করা চলিতে পারে ?’ এতে করে ছাত্রসমাজও তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনের জন্য। ফলে ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যালয়ে সকলে একত্রিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৪৪ ধারা জারি করে রাখার ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এক পক্ষে ছিলেন শেখ মুজিব ও অন্যরা, অন্য পক্ষে ছিলেন মাওলানা ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতা। মাওলানা ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতা ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিব এবং অন্যরা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করার পক্ষে ছিলেন এবং এ পক্ষের দাবিই গৃহীত হয়। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেলের পূর্বদিকে মিছিল করে আসতে থাকে ছাত্ররা। সহসা পুলিশের গুলিতে আবদুস সালাম, রফিকুল ইসলাম, সফিউর রহমান, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে শহিদ হন। পুলিশ কতৃক ছাত্র হত্যার এ খবর মুহূর্তেই সারা দেশে আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়লে সবাই এ ঘটনার নিন্দা জানাতে থাকে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ঘৃণা পোষণ করতে থাকে। তবে ভাষা আন্দোলনে ঢাকাবাসীর নিরপেক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে আহমদ রফিক তাঁর ‘ভাষা আন্দোলন’ বইয়ের ৫১ নং পৃষ্ঠায় এ বিষয়ে উল্লেখ করেছেন: ‘সেদিন বিকেলের ঘটনা যেমন ছিলো অভাবিত, তেমনি মর্মস্পর্শী। কান্না আর বেদনার প্রকাশ সেদিন নুরুল আমিন সরকারের প্রতি ধিক্কার ছুঁড়ে দিয়েছিলো। ব্যারাক প্রাঙ্গণে ঢাকাই আমজনতার ঢল চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। পুরান ঢাকার নানা বয়সী মানুষ ঘুরে ঘুরে পুলিশি হত্যাকা-ের আলামত দেখে ক্ষোভে উত্তাল হয়েছে। প্রাঙ্গণে রক্তের ছাপ আর হোস্টেলের শেডগুলোতে গুলির চিহ্ন তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, তা একটিমাত্র বাক্যে প্রকাশ পায়: গুলি কইরা ছাত্র মাইরা হালাইছে। হাসপাতালে তাদের ভীড়ে অন্য রোগীদের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই ঢাকাইয়া মানুষই আটচল্লিশে ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছে, কেউ কেউ ছাত্রদের ওপর হামলা করেছে। আর একুশের প্রস্তুতিপর্বে তারা এক ধরণের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছে। পুলিশের গুলি আর মৃত্যুর ঘটনাই তাদের সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিলো।’ পরবর্তীতে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পূর্ব বাংলায় ব্যাপক আকার ধারণ করে। ১৯৫৪ সালে বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র রচনা করা হয়, তখন আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর স্বীকৃতি পায় বাংলা ভাষা। আর এই আদর্শের পথ ধরেই পরবর্তীতে বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশ হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে এই বাংলাদেশ।
বঙ্গভঙ্গ ও দেশভাগ নিয়ে বাংলাদেশের মুসলমানদের আইডেনটিটি ক্রাইসিস :
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শই একটি কথা বলে থাকেন বাঙালিরা আত্মবিস্মৃত জাতি। বঙ্গভঙ্গ রদের পর মহাত্মা করমচাঁদ গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষবোসের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। অন্যদিকে, শওকত আলী, মোহাম্মদ আলী জওহর ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। এই দুটি আন্দোলনের সময় ভারতে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও তুরস্কের উসমানীয় খিলাফতের পরিসমাপ্তি এই আন্দোলনের যবনিকা হয়। অন্যদিকে গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা চৌরিচোরার পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করলে পুলিশের গুলিতে তিন জন নিহত ও বহু লোক আহত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী এ আন্দোলনের ইতি টানেন। এ সময় তাঁর যুক্তি ছিলো যে যেহেতু এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য অহিংস উপায়ে জাগরণ সৃষ্টি করা, কিন্তু পরিস্থিতি সহিংস হয়ে উঠেছে, সেহেতু আন্দোলন বন্ধ করাটাই ভালো। তবে ১৯৪২ সালে গান্ধী সত্যাগ্রহীরূপে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও ফলপ্রসূ হয়নি। ফলে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠলো এবং ভারতের উত্তরÑপশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠলো পাকিস্তান নামক ব্যর্থরাষ্ট্র। পাকিস্তানউত্তর পূর্ববাংলা এবং স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের মধ্যে আইডেনটিটি ক্রাইসিস মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করে। বিশেষ করে পাকিস্তানে শুরু থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কতৃক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবজ্ঞা এদেশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুললেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়ার পর এদেশের বেশিরভাগ মানুষ এই ক্রাইসিসে ভুগতে থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান ও প্রেসিডেন্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরে আসে এবং এদেশের মানুষ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা মারাত্মক আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকে। এর সুযোগই নিয়েছে ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারী সামরিক সরকার সমর্থকরা। ইসলাম ধর্মকে রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বরং কুরআন ও সুন্নাহকে অবমাননা করেছে তারা। যেমন ‘বাঙালি মুসলিম নাকি মুসলিম বাঙালি’ এই নিয়ে বিতর্ক, কুতর্ক অনেক হয়েছে। আবার ‘বাঙালি নাকি বাংলাদেশি’ এই নিয়েও অর্থহীন বিবাদ হয়েছে। বর্তমানে একশ্রেণির তরুণ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখার ব্যাপারে তর্কবিতর্ক করছে। অথচ ইসলামের এমন বিপদসঙ্কুল দিনে আমাদের উচিৎ একত্রিত হওয়া। পারস্পরিক মতভেদকে ঝগড়াবিবাদে রূপ না দিয়ে বরং আমাদের রাসূলুল্লাহকে (সাঃ) অনুসরণ করা উচিৎ। আমরা অধিকাংশই তা এড়িয়ে যাই বলে আমরা আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগি।
তথ্যসূত্র :
১. মুনতাসির মামুন, ‘উনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদÑসাময়িকপত্র’
২. মুনতাসির মামুন, ‘১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে প্রতিক্রিয়া’
৩. ডঃ আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫Ñ১৯৭১
৪. এবনে গোলাম সামাদ, ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’
৫. ডঃ অতুল সুর, ‘বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন’
৬. অধ্যাপক ডঃ সিরাজুল ইসলাম, ‘বাংলার ইতিহাসঃ ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো’
৭. ডঃ মর্তুজা খালেদ, ‘বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ’
৮. কমল চৌধুরী সংকলিত ও সম্পাদিত ‘বঙ্গভঙ্গ ও সমকালীন বঙ্গসমাজ’
৯. যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/শঁংযধষ.যধংহধঃধংরভ/ঢ়ড়ংঃং/১১০৮০৩১৪১২৯১১৫৬৭
১০. যঃঃঢ়ং://নষড়ম.সঁশঃড়-সড়হধ.পড়স/২০১৭/০১/১০/৪৯৯০৩/
১১. যঃঃঢ়ং://ৎড়ধৎ.সবফরধ/নধহমষধ/সধরহ/যরংঃড়ৎু/ঢ়ধৎঃরঃরড়হ-ড়ভ-নবহমধষ-ঃযব-নধপশমৎড়ঁহফ-ংঃড়ৎু/
১২. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪৪৬০৯৮৯১
১৩. যঃঃঢ়ং://ধৎঃং.নফহবংি২৪.পড়স/?ঢ়=৪৫৭৬
১৪. আওয়ামী লীগ উত্থানপর্ব (১৯৪৮Ñ১৯৭০), মহিউদ্দিন আহমদ
১৫. ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, আহমদ রফিক ও আবদুল মতিন
১৬. ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক
১৭. পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীত, বদরুদ্দিন উমর
১৮. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪৫৮৪৯৯৩৭ (যদি জিন্নাহর রোগের কথা জানা যেত, তাহলে কি ভারতÑভাগ আটকানো যেত?)
১৯. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪০৯৭৫৮৭৭ (জিন্নাহর আদর্শই এখনও পাকিস্তানের ভিত্তি)
২০. যঃঃঢ়ং://িি.িননপ.পড়স/নবহমধষর/হবংি-৪৮৭৩৪৮৮২ (আওয়ামী লীগের ৭১ বছরঃ যেভাবে জন্ম হয়েছে দলটির)
লেখকঃ সাংবাদিক।