শহর থেকে বহুদূর...

 


শহর থেকে বহুদূর

মিসির হাছনাইন 


মেম্বার বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বহু বছরের পুরনো শিমুল গাছ। গ্রামের মানুষ চিনে তুলা গাছ নামে। বসন্তে ফুল হয়, রক্তের মতন লাল লাল ফুল রাস্তায় পড়ে থাকে, মানুষের পায়ের তলায় ফুলগুলো কত অসহায়। তবে কোন্ ফুলের তুলা বাতাসে উড়ে উড়ে মেঘের মতন পথিকের নাকেমুখে এসে পড়ে? সন্ধ্যার পর যে কেউ এই রাস্তায় হেঁটে গেলে গা ছমছম করবেই। গ্রামের সবাই জানে এই গাছে একটা বোবা ভূত থাকে। ভয়টা সবার মনে গেঁথে গেছে। 

বাজার থেকে উত্তরে যে রাস্তাটা সোজা দুই গ্রামের মাঝখান দিয়ে কচুয়ার বিল আর পরান্নাইর বাগান, আরো কিছুদূর আসতেই প্রথমে পড়ে চৌকিদার বাড়ি। বংশের আট-দশ পুরুষ এই গ্রামের চৌকিদারী দায়িত্বে নিজেদের পূর্বপুরুষদের সন্মান এখনও ধরে রেখেছেন। মাহে আলম চৌকিদারের বড় ছেলে শাহে আলম বর্তমান কুটিরিয়া গাঁয়ের চৌকিদার। গাঁয়ের চোর, বাটপার, জুয়ারি, নেশাখোর চৌকিদারের চোখে পড়লে তাঁর রেহাই নেই। নিরপেক্ষ বিচার করে গাঁয়ের মানুষের কাছে খুবই সন্মানী ব্যক্তি শাহে আলম। চৌকিদার বাড়ির পাশ দিয়ে অন্য একটি রাস্তা নীলিমাগঞ্জ বাজারের দিক চলে গেছে। পুব পাশে হাওলাদার বাড়ি। বলতে হয় লবাগাজী হাওলাদার এই গ্রামের জমিদার। তিন বউের সংসার। প্রত্যেক ঘরের ছেলে-মেয়ে বিয়ে-শাদি দিয়ে আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অনেক রাগী আর হিংসুটে স্বভাবের কারণে প্রথম বউ পাশের গ্রামের আলমাস মাস্টারের সাথে গভীর রাতে পালিয়ে যায়। যদিও এ নিয়ে হাওলাদার কোন বিচার সালিশ ডাকেনি। ছয় বছরের মেয়েকে রেখে গেছে এতেই সে খুশি। চার ছেলের কোন ছেলের ঘরের ভাত সে খায় না। ছোট বউ আর তার প্রথম ঘরের কন্যা বিলকিস সহ হাওলাদার একসাথে থাকে। লোকজন বলে, প্রচুর জায়গা জমির মালিক হাওলাদার মারা গেলেও তাঁর বংশের পাঁচ পুরুষ খেয়েও নাকি থেকে যাবে।

হাওলাদার বাড়ির পশ্চিমে হাজী বাড়ি। এই বাড়ির লোকজন কারও আগেও নাই কারও পিছেও নাই। বাড়ির উত্তরের ভিটায় মোতাহার হাজীর ঘর। দুই ছেলে তিন মেয়ে। পুবের ভিটায় নতুন ঘর উঠেছে সেখানে নয়া বউ নিয়ে বড় ছেলে আতাহার থাকে। বড় মেয়ে হাওলাদারের পুতের বউ, মেজো মেয়ে শাহে আলম চৌকিদারের শালা বউ। ছোট মেয়ের জন্যেও দুই তিন গ্রাম থেকে সমন্ধ আসে কিন্তু মোতাহার হাজী চান পাত্র হবে হুজুর মসজিদের মুয়াজ্জিন বা ইমাম। সবার ছোট মতিহার ঢাকায় পড়াশোনা করে। তাঁর গ্রাম ভালো লাগে না। 

সোজা রাস্তার একটু উত্তরে মেম্বার বাড়ি। চারচালা টিনের ঘর। মেম্বার হওয়ার দুই মাসের মাথায় দ্বিতীয় বউ ঘরে আনেন। প্রথম বউের কোন সন্তানাদি নাই। এই কারণে কি দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছেন মেম্বার শেফালীর ভাবনার বিষয়। মেম্বার বাড়িতে এসেই সে দেখেছে প্রথম বউের পাগলামি, কে জানে এই ভালো এই খারাপ! তাঁর কথা কেউ বুঝতে পারে না। বোবা মানুষের মতন দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ই....... করে ওঠে কতক্ষণ পর পর। সবাই বলে তুলা গাছের বোবা ভূত। আর যখন ভালো থাকে, তখন মনে হয় তাঁর মতন লক্ষ্মী বউ দ্বিতীয়টা এই গ্রামে নাই। শেফালী মনে মনে খুশিই হয়। যদি এখন একখান সন্তান দিতে পারে তাহলে ঐ পাগলিরে সে এই বাড়ি থেকে বের করবে। সেদিন মেম্বার গেছে হাঁটে, সন্ধ্যার একটু পর, শেফালী হাঁসের বাচ্চা খুঁজতে খুঁজতে এই পুকুর ঐ পুকুর কোথাও খুঁজে পায় না, শেষে দেখে, তুলা গাছে হাঁসের বাচ্চা নিয়ে বসে আছে প্রথম পক্ষের বউ ছামিনা। হাঁট থেকে এসে এসব শুনে মেম্বার বলে উঠে, বলো কি! আজ পর্যন্ত কেউ দেখে নি, তুমি দেখেছো, তুলা গাছে বসে আছে ছামিনা! ওর ত দুই মাস হলো এই রকম আচরণ!! তারপর, মেম্বার বহু চেষ্টা করেছে হুজুরের পানি পড়া, ভূত তাড়ানোর দোয়া, তাবিজ-কবচ, গাছে পেরেকঠোকা, খনকারের কেরামতি, বাড়ি বান্ধানো ইত্যাদি ইত্যাদি কিন্তু কিছুই কাজ করেনি। অবশেষে নিরাশ হয়ে দ্বিতীয় বার বিয়ে করেছে সে। সোজা রাস্তা উত্তর দিকে গিয়ে ঘুরে গেছে পশ্চিমে তারপর বহুদূর গেলে একসময় পরবে উপজেলা শহর।

পুরো গ্রাম মূর্খ মানুষ দিয়ে ভরা। এদের নিয়ে গ্রামে বসবাস করা যায়! না, আমি আর গ্রামে আসবো না। এইরকম বহু কথা চিঠিতে লিখেছে মতিহার। ম্যাট্টিক পাশ করেই ঢাকায় কলেজে ভর্তি হয়ে নিজের থাকা খাওয়ার খরচ টিউশনির ইনকাম দিয়েই বেশ ভালোই আছে। কলেজ পাশ শেষে একটা ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি নেয়, সাথে ডিগ্রিতে পড়াশোনাও চলছে। হাজীসাবরে বলে দিয়েছে পড়াশোনার পাশাপাশি সে চাকরি করবে, বিয়ে শাদিও ঢাকায় করবে, তাকে নিয়ে তাদের মাথা ঘামাতে নিষেধ করে দিয়েছে মতিহার। হাজীও সব মেনে নিছে, পড়াশোনা জানা ছেলে, বাবা, ‘তুই যা ভালো বুঝিস’। এখন আর দুনিয়ায় চিন্তা তাঁর মাথায় নাই, পরকালের সুখের চিন্তায় তাঁর ঘুম হয় না। বাকি জীবন একটা সেজদায় কাটিয়ে দিতে চান মোতাহার হাজী। 

হাওলাদার বাড়ির পুবে চির চেনা মেঘনা নদী। নদীর নৌকায় মাছ ধরে সংসার চালায় বেড়ীবাঁধের সরকারি জায়গায় ঘর করে থাকা শ'খানেক জেলে পরিবার। হাওলাদারের সেজো ছেলে রহিম গাজী নৌকার মহাজন। বছর ঘুরতে ঘুরতেই প্রচুর টাকার মালিক হয়ে যান। এক রাতে নদীর পাড়ে নৌকার খরচের হিসাব নিতে একাই গেছিলেন, পথে ডাকাতের হাতে পড়ে কোনোমতে নিজের জীবন বাঁচিয়ে ঘরে ফিরেছেন।

হাজী বাড়ির আতাহারের বউ ফুটফুটে এক রাজপুত্র জন্ম দিয়ে নিজে পরপারে চলে যান। আতাহার দরগায় সিন্নি আর পীরের দরবারে একটা গরু মানত করেছে। বাপ সে ঠিকই হয়েছে কিন্তু বউকে হারানোর দুঃখ সে ভুলবে কি করে! মনে আছে জমিলা বলেছিল, তাদের পুত্র সন্তান হবে। আরো কত কত স্মৃতি কত কথা মনে পড়ে.. গামছা দিয়ে বারবার মুছে নেয় চোখ। এই বুঝি বুকটা ছিঁড়ে বের হয়ে যাবে প্রাণপাখি। বউকে কবরে শুইয়ে দিয়ে পুত্র সরফরাজকে বুকে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গরগর করে কি যেন বললেন! সবাই ভেবেছিল, শোক কেটে গেলে আবার বিয়ে করবে আতাহার।

মোতাহার হাজী অনেক আগ থেকেই চান গাঁয়ে একখান মসজিদ উঠুক। রাস্তার পাশে সে তাঁর পাঁচ বিঘা জমি দিতে রাজি। রহিম গাজীও নতুন জীবন পাওয়ার পর খুব করে চায় হ্যা, গাঁয়ে মসজিদ দরকার। সেদিনই সে মেম্বার, চৌকিদার, হাওলাদার কে ডেকে নিয়ে সবাই হাজী বাড়ির উঠানে বসে। বৈঠক শেষে ঠিক হয় মসজিদ উঠবে হাজী বাড়ির দক্ষিণ পাশে যাতে গাঁয়ের সবার জন্যে সুবিধা হয়। দুদিনে চারচালা টিনের মসজিদ ঘর দাঁড়িয়ে যায়। এখন দরকার মুয়াজ্জিন আর ইমাম। একজন হুজুর রাখলেই সে একসাথে দুই করতে পারবে। কিন্তু এইরকম বেতন করা হুজুর পাওয়া ত চারটি খানি কথা না, সময়ের ব্যাপার। মোতাহার হাজী বলেন, তাহলে এতদিনে আমিই দায়িত্ব পালন করবো, আর তোমরা যত তাড়াতাড়ি পারো আশেপাশের গ্রামে গঞ্জে খোঁজ নাও একজন কুরান হাদীস জানলেওলা অবিবাহিত মাওলানা হুজুরের, যাতে করে আমার মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে একখান ঘর করে দিয়ে আমাদের গাঁয়ে রেখে দিতে পারি। হাওলাদার এক গাল হেসে বলেন, ভালোই ত হইবো কিন্তু এমন হুজুর পাইলেই হয়। হাজী বাড়ির কাজের পোলা লাবু মিয়া হঠাৎ বলে ওঠে, ‘আমগো গাঁয়ে নূরানী মাদ্রাসা আছে, ওখানে গেলে জুয়ান হুজুর পাইবেন আমগো পাতাবাহার বু’র লাই’। কথা কিন্তু খারাপ কয় নাই, কি কন আব্বা হুজুর?? বলে সেলিম গাজী। 



কুসুমপুর বাজারের উত্তরে সোনাগাজি গাঁও, পায়ে হেঁটে কিছুদূর গেলেই একটা বটগাছ, বহু দিনের পুরনো..মনে হবে, হাজার বছর আগের একজন মানুষের কথা জিজ্ঞেস করলে গরগর করে সব বলে দিতে পারে, ডানের পুকুর পাড় দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যায় বিলের পাশে ত্রিভুজ আকৃতির দোচালা টিনের ঘর মাঝখানে খোলা মাঠ বিকেলে ছাত্ররা খেলাধুলা করে। কেরামত আলী নূরানী হাফেজী মাদ্রাসা। কতগুলো ফুল ফুটে আছে, ঝরে পড়ে আছে কতগুলো ফুল, বিকেলের ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে মাদ্রাসার ভিতরে ঢুকে সোহেল গাজী সাথে শাহে আলম চৌকিদার, মোফাজ্জল মেম্বার, আতাহার।

ছোট ছোট কতগুলো ছেলে তাদের খেলা বন্ধ করে দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একজন দৌড়ে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকে গেল, সবার পড়নে লুঙ্গি, গায়ে দাদা গেঞ্জি, মাথায় সাদা টুপি। তোমারা খেলো, খেলো, তোমাগো বড় হুজুরের ঘরটা কোনদিকে? বলে,সোহেল গাজী। ‘আন্নে আ’র লগে আইয়েন’ বলে, ছয় বছরের কালো ছেলেটা তাদের নিয়ে যায় হুজুরের ঘরে।

-আসসামুলাইকুম, হুজুর কেমন আছেন?

হাতে হাত মিলিয়ে সবাই বসে পড়লো।

-অলাইকুমআসসালাম, আলহামদুলিল্লাহ। যাও ঐ ঘরে গিয়ে বলো, চা দিতে। ছেলেটি চলে গেল।

পুরো ঘটনা শুনে হুজুর একটু মুচকি হাসি দিলো পান খাওয়া মুখে। বলে, জুয়ান পাশ করা ছেলে আরো এক মাস পর দিতে পারুম। তো, এখন আমি আপনাগো একটা ক্লাসে নিয়ে যাবো এখানের সবাই পাশ করে বেরুবে কিছুদিন পর, প্রথমে যারে পছন্দ হবে শুধু তারে ডাকবেন, নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করে আপনারা ফিরে যাবেন গাঁয়ে, ছেলের পিতাসহ আমি কুটিরিয়া গাঁয়ে যাবো, কথা দিলাম। কি সুন্দর গুনগুন করে সবাই মুখস্থ করছে আল্লাহর পবিত্র কুরআন শরীফ। ক্লাসে ঢুকলে সবাই সালাম দেয়, তারপর সবাইকে দাঁড়াতে বললেন বড় হুজুর। চৌকিদার একজনকে দেখে আতাহার, সোহেল গাজীকে কানে কানে কি জানি বললো মেম্বারও তাতে রাজি হয়ে গেল। ছেলেটার বয়স আঠারো কি উনিশ, মুখে কেমন জানি লজ্জা, চোখে একটু ভয়। উঁচা লাম্বাই ভালোই মানাবে আমগো পাতাবাহারের সাথে, মনে মনে ভাবলো আতাহার। 

-কি নাম তোমার? জিজ্ঞেস করলো আতাহার।

-মোহাম্মদ রফিকউল্লাহ। 

-তোমগো গেরাম কোনটা? বাপের নাম কি ? বলে, মোফাজ্জল মেম্বার। 

- মনিরামপুর গাঁও, বাবা ইসমাইলউল্লাহ খনকার।

-ওওও শুনছি, ইসমাইল খনকারের পোলা তুমি, আচ্ছা, আচ্ছা। বললেন, সোহেল গাজী। 

তোমরা সবাই বসো, যাও রফিকউল্লাহ, গিয়ে বসো, মনোযোগ দিয়ে পড়ো.. বড় হুজুর এই বলে ক্লাস থেকে সবাইকে নিয়ে বের হলেন, সবাই আবার গুনগুন করে পড়তে লাগলো সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। হুজুর আমরা তাহলে গেলাম আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে খুব তাড়াতাড়ি, এই বলে সোহেল গাজী হাত মিলালো, একে একে সবাই হাত মিলিয়ে কথা বলতে বলতে কুসুমপুর বাজার থেকে মিষ্টি খেয়ে রওনা দিলো তখন রাত দশটা বাজবে হয়তো, কারো কাছে ঘড়ি নাই। মসজিদ নিয়ে নানান কথাবার্তা বলতে বলতে তাঁরা একসময় চলে আসেন গাঁয়ে।

মতিহার বিয়ে করেছে। একইসাথে ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করতো মেয়েটা। ঢাকায় বড় বাসা নিয়ে থাকে, চাকরির বেতনও পায় ভালো। কিছুটাকা সাথে শাড়ি লুঙ্গিসহ একখানা বড় চিঠি লিখে পাঠায় মতিহার। মোতাহার হাজী মনে মনে খুশি হয়। যা হোক ছেলে মেয়েগুলো সুখে থাক এটাই আমার চাওয়া, ওদের সুখ দেখতে দেখতে যেন আমি মরতে পারি এই প্রার্থনা সবসময় করি আল্লাহর কাছে। মোতাহার হাজী চিঠি লিখবে, এই জীবনে দুইখান চিঠি লিখেছে সে, আজ আনন্দে লিখবে, সুখ লিখবে চিঠিতে।

প্রিয় মতিহার,

সুখে আছো, শুনে খুব ভালো লাগলো। তোমরা ভালো থাকো এটাই ত আমি চাই। তোমাদের মা, যে বছর হজ্জ করে দেশে আসলাম সে বছর মারা গেছে, মনে আছে? মায়ের জন্যে দোয়া করো। কতটা কষ্ট করে তোমাদেরকে আমি লালন করেছি, আমি অচল হয়ে গেলে ফেলে দিও না, অবহেলা করবে? আমি চাই না, সবসময় চাই আল্লাহ যেন সবগুলো গুনাহ ক্ষমা করে অচল হওয়ার আগে পৃথিবীতে কম কষ্ট দিয়ে মৃত্যু দেন। তোমাদের দাদীজানকে ত তোমরা দেখেছো, কি কষ্ট পৃথিবীতে পেয়ে আমার গুনাগার মা মরলো, আমিই তাকে শেষপর্যন্ত লালন করেছি। ও হ্যা, পাতাবাহারের বিয়ে দিচ্ছি তুমি চাইলে আসতে পারো গাঁয়ে..তোমার ভাই আতাহার বিয়ে করে নি, আমিও জোর করি নি, আর করবোও না, তোমাদের বসয় হয়েছে, তোমরা এখন ভালোমন্দ দুই বুঝো। সরফরাজ আমাকে দাদাই ডাকে, আতাহারের ছেলে। আমার খুব ভালো লাগে, আমি ওর সাথে খেলি। ভালো থাকো। গাঁয়ে আসলে খবর দিও।

ইতি

তোমার বাবা


মোতাহার হাজী থ্রি ক্লাস পর্যন্ত পুরান গাঁয়ের পাঠশালাতে পড়েছে, লিখতে শিখেছে। 

মোফাজ্জল মেম্বারের বউ ছামিনা বোবা হয়ে আছে। আজ রাতে মনে হয় ভর করেছে বোবা ভূত, তাঁর ঘর থেকে ই,ই.. আওয়াজ আসছে। টর্চ লাইট নিয়ে মেম্বার তাঁর ঘরে গেলো। আলো পড়তেই ছামিনা তাকায় মেম্বারের চোখে, কি ভয়ানক লাল চোখ! মনে হয়, এই বুঝি বের হয়ে যাবে লাল চোখ। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ই,ই,ই... করে কি জানি বলে। মেম্বার বলে উঠে, শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো অনেক রাত হয়েছে, সকালে শুনবো। ঐ ঘরে শেফালী শুয়ে আছে ঘুমের ভান ধরে, মনে মনে বলে, ‘ইশ্শিরে..! বোবার লগে পিরিত দেখলে ঘুম ভাঙ্গে আমার’। ঘরে ঢুকে হারিকেনের বাতি একটু বাড়িয়ে দিয়ে মেম্বার বললে, ঘুমাই গেছো শেফু?? হ, শেফু ঘুমাইছে, এখন তুই ঘুমা, গায়ে হাত দিবি না, সোজা হয়ে শুবি, নাক ডাকবি না কইলাম.. এগুলো বলতে ইচ্ছে করতেছে শেফালীর আর রাগে তাঁর তামাম শরীর জ্বলতেছে। হারিকেনের আলো একটু কমাতে গিয়ে বন্ধ করে দিলেন মোফাজ্জল। তারপর কি জানি বলে শুয়ে পড়লেন।

খুব সকালে দরজা নাড়ায় ছামিনা। শেফালী ওঠে দরজা খুলে দেয়। শেফালী মনে মনে দেখতে পারে না ঠিক কিন্তু যখন ছামিনা ভালো থাকে ছামিনার ব্যবহারে সে তাঁর সাথে খারাপ কিছু করতে পারে না। আর ছামিনাও সবকিছু ভুলে যায়। তাঁরে খুব আদর করে। খুশি খুশি মুখ নিয়ে শেফালীরে বলে, দেখ, দেখ বইন, আমি মা হমু, অবশেষে আল্লাহ আমার দিক মুখ তুলে চাইছে। কথা গুলো কেমন জানি একটা বিকট আওয়াজের মতন শেফালীর কানে বাজতেছে। এ কি শুনলো সে। কিরে বইন তুই খুশি হস নাই?? সোনার মতন সুন্দর মুখখান এমন বেজার কেন? কি হইছে, শরীর খারাপ?? যাও, গিয়ে শুয়ে পড়ো। উনি ঘুম থেকে উঠলে বইলো আমার ঘরে একটু আসতে। ততক্ষণে মেম্বার সজাগ হয়ে গেছে, খবর শুনে মুখ না ধুয়েই খুশিতে নাচতে নাচতে বাজারে  মিষ্টি কিনতে চলে যান এই ভোর বেলাতে। শেফালী শুয়ে আছে। ছামিনা চলে গেল তাঁর ঘরে। মেম্বার খুশি হলেও তাঁর চিন্তার শেষ নাই।

বাজারে করিম গাজী আলু আর তিল নিয়ে যান। বিক্রি করেন, হাওলাদারের জন্যে ঔষধ আর ঘরের জন্যে কেরসিন কিনে রওনা দেন। পথে দেখা হয় লাবু মিয়ার সাথে। করিম ভাই আসসামুলাইকুম, কেমন আছেন? ভালো আছি, তুই কেমন আছস? ভালো আছি, আপনাগো দোয়া বরকতে। ভাই, মনিহার বু কেমন আছে, মনিহার বু আর সোহেল ভাইরে খবর দিছে হাজী চাচা, কইছে, বাজারে আপনার লগে দেখা হলে বলতে। আচ্ছা লাবু মিয়া, আমি খবর পৌঁছে দিবো। কি আনছিলা বাজারে? ভাই, আলু আনছিলাম। কথা বলতে বলতে পরাইন্নার বাগানের রাস্তায় ঢুকে দুইজন। কি জানি একটা পাখি ডেকে উঠলো, রাতের ঘরকুনো ব্যাঙ রাস্তায় ডাকছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আকাশে চাঁদ নাই, তারাদের আলোয় এসব রাস্তায় গাঁয়ের মানুষ চোখ বন্ধ করে হাঁটতে পারে।

করিম গাজী বাসায় আসে। বউরে ডাকে, ভাত খাবে, শুধু ডাল দেখে মেজাজ গরম করে জাল নিয়ে মাছ ধরতে গেলে.. বউ বলে, এতো রাতে যাওনের দরকার নাই, হাঁসের ডিম আছে ভাজি দি। কে শুনে কার কথা! আব্বার ঔষধ আনছি বিলকিস কে ডেকে দিয়া দিও, আমি আসতেছি.. এই বলে ঝাকি জাল নিয়ে মেঘনা নদীতে যায় মাছ মারতে। এর আগেও বহুবার মাছ ধরেছে সে, রাতের বেলায় মাছ ধরা খুবই সাহসের ব্যাপার। রাতে ভালো মাছ পাওয়া যায়। মাছেরা রাতের বেলায় চোখ বন্ধ রাখে?? আমি জানি না। নদীতে এখন ভাটা পড়েছে। পানি দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে যাচ্ছে, কি ¯্রােত..! কূল থেকে জোয়ারের পানি নেমে গেছে কিন্তু কচুরিপানা সহ আরো অনেক মরা গাছের ডালপালা, লতাপাতা, বোতল, ভাঙা হাড়ির টুকরা, প্লাস্টিক, পলিথিন ইত্যাদি পড়ে আছে, আবার জোয়ার আসলে ভেসে ভেসে চলে যাবে কোথাও। করিম গাজী হঠাৎ দেখে একটা মানুষ! হ্যা মানুষই ত, মরা নাকি!! প্রথমে ভয় পেলেও পরে ঠিকই কাঁধে করে তাকে বাড়িত নিয়ে আসে, তখনই ভরা পেটের পানি মুখ দিয়ে পড়ে ভিজে গেছে, করিম গাজীর পিঠ। সে বুঝতে পারে ভাসতে ভাসতে চলে আইছে, ভাটার টানে উঁচুতে আটকে গেছে, আর যাইতে পারে নাই, মনে হয় বাঁইচা আছে। উঠানে আগুন জ্বালিয়ে মানুষটারে নতুন জামা কাপড় পড়িয়ে বসিয়ে দেয় করিম গাজী। এতক্ষণে বাড়ির সবাই উঠানের লোকটাকে দেখে নিয়েছে..। হাওলাদার বলে উঠেন, উনারে সোহেল গাজী’র সামনের ঘরে রাখো, জ্ঞান ফিরলেও কোন কথাবার্তা বলার দরকার নাই, ঘুমাইতে দাও, ভোরে সবকিছু জানতে পারবা সকলে, এখন চিল্লাপাল্লা না কইরা সবাই ঘুমাতে যাও।

গাঁয়ের নাম মালতীমালা, উত্তরে দিনাজপুর জেলায় বাড়ি। লঞ্চে করে বরিশাল যাওয়ার পথে ডাকাতের হাতে লঞ্চ ডাকাতি হলে সবাইকে মেরে নেংটা করে নদীতে পেলে দিয়ে লঞ্চ নিয়ে যান। উনার নাম শ্যামল কান্তি দে। দিনাজপুর অঞ্চলের একজন বড় ব্যবসায়ী লোক। ব্যবসার কাজে বরিশাল আসলে ডাকাতের হাত থেকে কোন মতে জীবন নিয়ে লাফিয়ে পড়েন, তারপর ভাসতে ভাসতে কখন যে জ্ঞান হারালেন সে জানতেই পারেন নি। তাঁর দ্বিতীয় জীবন পাওয়া তে লোকটা খুবই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলো। বিনয়ী হয়ে তারপর বললো, আমি সারাজীবন আপনাদের মনে রাখবো, কিছু মনে না করলে আমি সামান্য উপহার আপনাদের পাঠাবো, যদি আপনারা তা গ্রহণ করেন, আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো আপনাদের চরণে। আর করিম গাজীকে সে নিয়ে যেতে চায় তাঁর সাথে করে। মনে মনে করিম গাজীও চায় দিনাজপুরের চারপাশ দেখে আসতে আর মানুষটাকে তার পরিবারের কাছে ঠিক মতন পৌঁছে দিতে।

মেম্বার অনেক চিন্তা ভাবনা করে সিন্ধান্ত নেয় তুলা গাছটা সে কেটে ফেলবে। তাঁর বড় বউ পোয়াতি, আর শেফালীর মনের খবর তাঁর জানা। বাজার থেকে মিষ্টি কেনার পথে গাছটা বিক্রি করে দিয়েছে, বিকেলে এসে গাছ কেটে নিয়ে যাবে। মেম্বার অনেকটা চিন্তা মুক্ত হয়ে ঘরে ফিরে।

রাস্তায় দেখা হয় বড় হুজুর আর ইসমাইল খনকারের সাথে। কুশল বিনিময় করে তিনজনে যায় হাজী বাড়ি।

মোতাহার হাজীর সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে, চা বিস্কুট খেয়ে রওনা দেয় ইসমাইল খনকার সাথে বড় হুজুর। 

কার্তিক মাসের ১৫ তারিখ বিয়ে হয়। মসজিদের পাশে নতুন ঘরে নয়া সংসার রফিকউল্লাহ হুজুরের।

কয়দিন যাবৎ ছামিনা আর পাগলামি করছে না। তবে কি গাছ কাঁটার সাথে সাথে বোবা ভূত উড়াল দিছে? শেফালী বাপের বাড়িতে গেছে। অঘ্রাণ মাসে ছামিনা এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। তার দুইদিন পর লবাগাজী হাওলাদার মারা যায়।

অনেক বছর পর মতিহার গ্রামে এসেছে সঙ্গে তাঁর বউ আর দুই ছেলে মেয়ে। মোতাহার হাজী অসুখে পরেছে, মনে হয় না, এই যাত্রায় আর সেরে উঠবেন। মতিহারের ছেলে মেয়ে এর আগে কখনও গ্রাম দেখে নি। বড় মেয়ে নিপুণ স্কুল পাশ দিয়ে কলেজে উঠেছে, তাঁর কাছে গ্রামখানি স্বর্গের মতন লাগছে। স্বর্গের কথা সে বহুবার শুনেছে, বইতে পড়েছে কিন্তু কখনও দেখেনি, এই যাত্রায় সে ঠিক করেছে স্বর্গেই থেকে যাবে, বাবা মার সাথে সে আর শহরে ফিরবে না।

পরশু রাতে ভোরের আজানের আগে মোতাহার হাজী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আকাশে চলে গেলেন। একে একে সবাইকে যেতে হবে। কেমন সহজ ভাবে চলে গেলেন মোতাহার হাজী, ছেলে মতিহার হয়তো পকেটে রাখা চিঠিটা আরেকবার পড়েছে, তাঁর পাষাণ হৃদয় চোখে জল এনেছিল কিনা আমি জানি না! কত বছর বয়সে মারা গেলেন হাজীসাব? গ্রামের মানুষ জীবনের হিসাব রাখে না। তার সপ্তাহ খানেক পর মতিহার ঢাকায় যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। 

এতো তাড়াতাড়ি সময় চলে যায় নিপুন এই প্রথম বুঝতে পারলো। সে মনকে শক্ত করে বাবাকে গিয়ে বলে, আমি গ্রামে থাকবো, শহর আমার ভাল্লাগে না, বাবা, প্লিজ, তুমি না করো না। মতিহার রেগে গিয়ে বলে, না, গ্রামে থাকতে হবে না, কি আছে গ্রামে! চারপাশে মানুষ থাকে নাকি! গরু, ছাগল দিয়ে ভর্তি মূর্খের দল সব, না, তোমাকে এখানে থাকতে হবে না, তাড়াতাড়ি রেডি হও। সে ও বলে দিছে সে শহরে যাবে না, মানে যাবে না, আর যদি যেতে হয় তাঁর লাশ যাবে। মেয়ের এমন বাড়াবাড়িতে মতিহার জিদ করে স্ত্রী আর পুত্র কে নিয়ে ঢাকায় চলে গেল।

নিপুণ ঠিক করেছে এখানকার কলেজে ভর্তি হবে। বাকি জীবন সে গ্রামেই কাটাবে। তাঁর কাকু আতাহার একজন কৃষক, কখনও স্কুলে গেছে কিনা সে জানে না। কিন্তু কত সুন্দর ব্যবহার, কত সহজ সরল জীবন যাপন। একমাত্র ছেলে সরফরাজ জেলা শহরের কলেজে অর্নাসে পড়াশোনা করছে। নিপুণ তাঁর জীবন সঙ্গী ঠিক করে নিয়েছে, যদি সরফরাজ ভাই রাজি থাকে। 

দাদার মৃত্যু সংবাদ শুনে জেলা শহর থেকে সেও গ্রামে আসে। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই সে তাঁর বাবাকে সবকিছুতে সাহায্য করেছে। প্রথম দেখায় সে ধরেই নিয়েছে নিপুণ শহরের মেয়ে তাঁর মতন গাঁয়ের ছেলের সাথে সে কি আর কথা বলবে!

কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কি হলো..! আজ তাদের বিয়ে..। সে কথাও লিখে রাখি। উপজেলা শহরের হাজী মোতাহার মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল সরফরাজ বিন আতাহার এখন কৃষিকাজ অনেকটাই ভুলে গেছে।


আতাহার রয়ে গেল গাঁয়ে। শত চেষ্টা করেও তাকে উপজেলা শহরে নিয়ে যেতে পারলো না সরফরাজ বিন আতাহার। মার মার করে গাঙ ভাঙ্গছে, আতাহারও ভাঙ্গছে..



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট