অনিঃশেষ অন্ধকার
আবুল কালাম আজাদ
[গত সংখ্যার পর]
২১.
দু’চোখে প্রবল অন্ধকার মেখে কতটা সময় কেটে গেছে তা সে খেয়াল করেনি। সে দেয়ালে তাকিয়ে দেখল ঘড়ির কাঁটা বারোটা পার হয়ে গেছে। তখন আবার সেই গোখড়া সাপের ফোঁস ফোঁস। সে সিদ্ধান্ত নিল, ফোনটাকে আছড়িয়ে ভেঙে ফেলবে। তাহলে হয়তো গোখড়া সাপটা মরে যাবে।
সে গোখড়া সাপের কাছে গিয়ে দেখল আসাদ স্যার ফোন করেছেন। কেমন একটা শান্তির ¯্রােত তার হৃদয়ের কিনার ঘেষে বয়ে গেল। একটু হলেও সহানুভূতি মিলবে নিশ্চয়। সে বলল, স্লামালিকুম স্যার।
অলাইকুমস্লাম।
স্যার, আপনি ফোন করবেন আমি তা ভাবতে পারিনি।
কেন ?
আপনি তো কখনো ফোন করেন না আমাকে।
ফোন করলাম তোমাকে একটা খবর দিতে।
কী খবর স্যার?
তোমাকে বলেছিলাম না আমি একটা উপন্যাস লিখবো, নাম হবে-স্মার্ট ফোন।
জি স্যার, বলেছিলেন।
এই মাত্র সেই উপন্যাসটার প্রথম লাইনটা লিখলাম-সে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। কেমন হয়েছে লাইনটা?
ভালো হয়েছে স্যার।
কিন্তু উপন্যাসটার নাম স্মার্টফোন রাখবো না-সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছি।
কী রাখবেন স্যার?
নাম হবে, অনিঃশেষ অন্ধকার। কেমন হয়েছে নামটা?
খুব সুন্দর হয়েছে স্যার। যুক্তিসঙ্গত একটা নাম।
তুমি কি আলবেয়ার কাম্যু’র নাম শুনেছো ?
জি না স্যার। কে তিনি?
তিনি একজন বিখ্যাত লেখক। তিনি লেখক ছিলেন না। লেখক হবার ইচ্ছাও ছিল না তাঁর মধ্যে। ঘটনাক্রমে লেখক হয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন আলজেরিয়ার্স ফুটবল টিমের গোলকিপার। একবার খেলতে গিয়ে তাঁর হাতের আঙুল ভেঙে যায়। তিনি খেলতে পারেন না কিছু দিন। এই অবসর সময়ে তিনি একটা উপন্যাস লেখেন, নাম-দ্য আউটসাইডার। এই উপন্যাসেই তিনি নবেল প্রাইজ জিতে নেন। উপন্যাসটা আমার খুব প্রিয়। তুমি কি গলস্ওয়ার্দির নাম শুনেছো?
জি না স্যার। তিনিও নিশ্চয় লেখক, নবেল প্রাইজ পেয়েছেন।
তিনি ১৯৩২ সালে সাহিত্যে নবেল প্রাইজ পান ‘ফর সাইট সাগা’ লিখে। তিনি অক্সফোর্ডে আইন শাস্ত্র পড়েছিলেন। সামুদ্রিক আইন তাকে টানতো খুব। সামুদ্রিক আইনে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বের হন সমুদ্র পথে বিদেশ ভ্রমণে। জাহাজে দেখা হয় যোশেফ কনরাডের সাথে। আলাপচারিতা। তারপর বন্ধুত্ব। এরপর সামুদ্রিক আইন শুধু নয়, আইনের জগতেই তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাকি জীবন তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখেন সাহিত্য চর্চায়। তাই ঘটনাক্রমে..........।
স্যার, আপনিও ‘অনিঃশেষ অন্ধকার’ উপন্যাসটার জন্য সাহিত্যে নবেল পেয়ে যেতে পারেন।
না, তা পারি না।
কেন স্যার ?
কারণ, নবেল কমিটিতে সরাসরি বাঙলা ভাষায় লেখা কোনো গ্রন্থ জমা দেয়া যাবে না। সেখানে চারটি ভাষা চলে। ১. ইংরেজি। ২. সুইডিস, ৩. স্প্যানিস ৪. জার্মান।
স্যার, আপনি ইংরেজিতে অনুবাদ করে..........।
সেটা সম্ভব নয়।
কেন স্যার? আপনি এত ভালো ইংরেজি জানেন।
সেটা তোমার কাছে। আমার ধারণা রবীন্দ্রনাথের মতো ইংরেজি জানলে মানিক, বিভূতীভূষণ, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক এবং বাংলা ভাষার আরও কেউ কেউ নবেল পেতেন। রবীন্দ্রনাথ অনেক ইংরেজ পন্ডিতের চেয়েও বেশি ইংরেজি জানতেন। আর আমি তো পুরস্কারের জন্য এটা লিখছি না। আমি লিখছি এই জন্য যে, আমার উপন্যাসটা এ দেশের মানুষ পড়–ক।
এটা প্রকাশ হবার পর আমিও পড়বো স্যার।
শোন, যা হবার হয়েছে। তুমি আবার নতুন করে প্রস্তুতি নাও।
কিন্তু স্যার......।
কিন্তু কি আবার? মানুষ কি ফেল করে না? এই দেশে কি তুমি একাই ফেল করেছো?
স্যার কিন্তু.....।
কোনো কিন্তু নেই। ফেইলর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস। অন্ধকার না থাকলে আলোর কোনো দাম আছে? রাত যত গভীর হয়, ভোর তত নিকটে আসে। ফর এভরি ডার্ক নাইট, দেয়ার ইজ এ্যা ব্রাইটার ডে।
স্যার, কোনো কোনো অন্ধকার বোধহয় কিছুতেই সরানো যায় না। কোনো কোনো রাত যেন কিছুতেই ভোর হয় না।
কী বলছো তুমি! একটু খুলে বলবে কি হয়েছে?
খুলে বলার কোনো দরকার নেই স্যার। আমার বিশ্বাস, আপনি এই অন্ধকারকে ঠিকই অনুমান করতে পেরেছেন। তা না হলে আপনি উপন্যাসের নাম ‘স্মার্ট ফোন’ থেকে ‘অনিঃশেষ অন্ধকার’ রাখতেন না। ‘অনিঃশেষ অন্ধকার’ মানে, যে অন্ধকারের কোনো শেষ নেই, আমি তা বুঝতে পেরেছি স্যার।
পেটের মধ্যে আবার সেই নড়াচড়া। আবার সেই বমি বমি ভাব। আবার সেই মাথা ঘোরা। এ অবস্থায় আসাদ স্যার ফোন কেটে দিলেন। সে ফোনটা ছুড়ে ফেলে দিলো দূরে। আবার সেটা গোখড়া সাপ হয়ে গেল। আবার সেটার বেজে ওঠার শব্দ হয়ে যাবে গোখড়া সাপের ফোঁস ফোঁস। একমাত্র আসাদ স্যার ফোন করলেই সেটা সুললিত রিংটোন হয়ে যাবে, না হলে নয়।
সে ভালো করেই জানে, আসাদ স্যার আর তাকে ফোন করবেন না। কেন করবেন? এক ভালোবাসার নাম করে তাকেও তো কম অপমান করা হয়নি। তার ভেতর সেই কান্না ভেজা কন্ঠে কে যেন গেয়ে উঠল-এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে আমার পৃথিবী থেকে।
গানটা মা শোনেন মাঝে মাঝে। এতদিন গানটা তার বিন্দুমাত্র ভাল লাগেনি। কোনো অর্থ-টর্থও বুঝতে পারেনি। গানটা বাজলে সে প্রায়ই বিরক্ত হতো। কিন্তু এখন..............!
[সমাপ্ত]