অঘোর ফাগুন

 



অঘোর ফাগুন 

আহাদ আদনান


(চিঠিটা তার পকেটে ছিল,

ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা। মাগো ওরা বলেঃ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ)  


শীতটা এবার পড়েছে জাঁকিয়ে। ভোরের কুয়াশায় দুনিয়াটা সেজে থাকে ভীষণ এক ঘোলা পুকুর। রানু’র নিজেকে মনে হয় মাছ। পুঁচকে পুঁটি। ভেজা ভেজা সরিষা খেতের আইল ধরে যখন সে বের হয় মক্তবের দিকে, সাথে জুটে যায় আরও কয়েকটা মাছ, বুলি, সেতু, আনু; হেঁটে নয়, ওরা যেন সাঁতরে সাঁতরে এগুতে থাকে। উঠতে গিয়ে মিহি সূর্যটা হেরে যায় পলাশপুর গ্রামের প্রতিটা দিনে।

কুয়াশা মাখা সূর্যটা মাথায় করে রানু ফিরে আসে। ‘মা, কুমড়ো গাছে ফুল আইছে। পিচ্চি হলুদ একটা ফুল’। ‘আইতে দে। হাত দিবি না। তাকাবি না বারবার। নজর লাগব। কায়দা’টা রাইখা হাত মুখ ধুইয়া আয় রসুইঘরে। পিঠা বানাইছি’। মাটির সানকিতে ছোট একটা গোল পিঠা। ধোঁয়া উঠছে গরম গরম। ছোট আঙুল দিয়ে পিঠাটার মাঝখানে একটা চাপ দেয় রানু। নারকেল, চালের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে বেয়ে পড়ে তরল গুঁড়ের ধারা। সেই পিঠা মুখে দিয়ে রানু বলে, ‘ ভাইজান কবে আইব, মা? গেল বিষ্যুদবার চিঠি আইছিল। আবার কবে চিঠি আইব? বড় আর মেঝ আপাও তো আসে না। বেড়াইতে আইতে লেখো না। চার ভাইবোন মিলা পিঠা খাই না কতদিন’। ‘হ, তোর ভাইজানের তো আর কাম নাই। সামনে পরীক্ষা। রাত জাইগা পড়ালেখা করতে হয়। কইলেই আসা যায়’? ‘আবার নাকি কি মিটিং করে? পোস্টার বানায়’? ‘পাগলের কথা কি বুঝি সব? সেই বছর কী বলল? পশ্চিম থেকে কোন গাধা আইসা নাকি বলেছিল, এখন থেকে আর বাঙলায় কথা বলা যাবে না। সবাইকে উর্দুতে কথা বলতে হবে। ফুলের গন্ধ, নদীর জল, পাতার রঙ, মায়ের ভাষা, বদলে দেবে সব। তোর ভাইজান ছিল সেদিন। ওরা বন্ধুরা মিলে চেঁচিয়ে উঠেছিল না, না বলে। গত বর্ষায় কি বলল মনে নেই? পশ্চিমারা আমাদের আলাদা জাত মনে করে। আসলেই আমরা আলাদা। মায়ের ভাষা ভিন্ন। এই ভাষার অধিকারের জন্য যা দরকার সব করতে হবে’। 

দুপুরের আগেই ফিরে আসে রানু’র বাবা। সারারাত লঞ্চ চালিয়ে ভোরে তার ছুটি। হাতে বাজারের থলে। নিশ্চয়ই মাছ এনেছেন আজ। বাবাকে দেখেই দৌড়ে জড়িয়ে ধরে রানু। মায়ের সাথে মাছ কুটতে বসে যায় তারপর। বেল গাছটার ডালে বসে কয়েকটা ময়না পাখি ডাকতে থাকে। মাছের গন্ধে কা কা করতে করতে জুটে যায় গোটা দশেক কাক। উনুনের আগুনটা উসকে দিয়ে মা কড়াইয়ে চড়িয়ে দেন সবুজ কলমি। ‘ভাইজান, কুমড়া ফুলের বড়া পছন্দ করে, না, মা’? ‘করে তো। আর আলু, টমেটো দিয়া টেংরা মাছের পাতলা ঝোল। উপরে বেশি করে ধনে পাতা। কালাইয়ের ডাল দিয়ে বড়ি, ছোট ছোট বড়ি। বেগুন দিয়ে নলা মাছের তরকারিতে এই বড়ি থাকতেই হবে। শেষে সজনে ডাটা দিয়া মসুর ডাল’।

আনুদের বাড়িতে আজ মহা হইচই। ওদের কালো গাই’টা এক বাছুর দিয়েছে। মায়ের মতোই কুচকুচে কালো। রোদে চিকচিক করছে। সেই উঠোনে দাঁড়িয়েই পোস্টমাস্টার কাকুকে দেখে ফেলে রানু। ‘কাকু, ও কাকু, চিঠি আইছে, ভাইজানের চিঠি’? ‘এমনি এমনি তো কওয়া যাইব না, রানু বিবি। মুখ মিঠা করাইতে হইব’। হাসতে হাসতে থলে থেকে একটা হলুদ খাম বের করে কাকু। ‘ভাইজানের চিঠি, ভাইজানের চিঠি’, সুরে ঈদ নামে পলাশপুরের বিকেলে। 

‘ঢাকার অবস্থা ভালো না। দানা বাঁধছে ক্ষোভ। মিটিং করছি আমরা রোজ। লুকিয়ে ছাপিয়ে। দেখলেই পুলিশের ধরে নিয়ে যায়। ছিঁড়ে ফেলে পোস্টার। তবে আমরা কি ভয় পাবার ছেলে? ভেবে দেখো, কত বড় সাহস! সবার কথা কেড়ে নিতে চায়। মা’কে মা বলে ডাকতে দিবে না। মায়ের ভাষায় গল্প শুনতে দিবে না। ভাষাই যদি না থাকল, তবে জীবনের কি আর মূল্য থাকে? দাঁড়াও, আমরাও বসে থাকার ছেলে না। মাগো, তুমি দেখে নিও, তোমার জন্য এবার কি আনি। ভাষা আনব, কথা আনব, এত্ত বড় এক ঝুড়ি কথা। তাই তো দেরি হয়ে যাচ্ছে, মা। রাগ করোনা, লক্ষ্মী মা। এই তো কয়েকটা দিন আর। কেটে যাবে দেখতে দেখতে’। মা পড়ে, আর হাসে। চোখে তার জল। 



শীত কমতে শুরু করেছে। সূর্যটা জ¦লতে শুরু করেছে বেলায় বেলায়। উঠোনে বসে মা নারকেলের চিড়ে কুটছেন। মিহি মিহি সাদা নারকেল। খেতে মিষ্টি মধুর মত। কায়দা’টা রেখে রানু মুড়কি চিবুতে চিবুতে এসে পড়ে। উড়কি ধানের মুড়কি। ‘এই মুড়কি তোর ভাইজানের জন্য রাখছি। আর ধরবি না। একসাথে পরে খাবি’। ‘কুমড়ো গাছ তো হলুদ হইয়া গেছে। ফুল আর ফুল। সজনে গাছটাও ঝুঁইকা পড়ছে। ডাটাগুলান ডাগর হইয়া গেছে। পুঁই গাছে বীচি গুলান কালা কালা। তুমি না কইছিলা, আইজ চিঠি লেখবা ভাইজানের কাছে। এগুলার কথা লিখবা না, মা’? ‘লেখুম তো’।    

ফাল্গুনের আট তারিখ। বৃহস্পতিবার। গনগনে দুপুর। রানু দাঁড়িয়ে আনুদের উঠোনে। চুপচাপ কাঁদছে দু’জন মিলে। কালো বাছুরটা মরে গেছে। কি একটা অসুখ করে দুম করে মরে গেলো প্রাণীটা। মা একা বসে আছেন রসুইয়ের দাওয়ায়। হাতে তার খোকার চিঠি। সেই চিঠিটা। কথা নিয়ে ফিরে আসার আশ্বাসে মা আশায় বুক বাঁধেন, প্রতিদিন, কয়েকবার করে। হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠেন মা। আকাশে ঘুরঘুর করছে কয়েকটা শকুন। আনুদের বাড়ি যাবে বোধহয়। এখানে কেন উড়ছে মরার শকুন। একটা ঢিল নিয়ে ছুড়ে মারেন মা, ‘বালাই ষাট’। 

শকুনিদের নাকি তখন প্রজননের ভরা মৌসুম। বাঙলার আকাশে আকাশে খাদ্যের গন্ধে উড়তে থাকে অপয়া পক্ষীকুল।  

মাতুয়াইল, ঢাকা। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট