মিহিকল্প
সা’দ সাইফ
ভোরের আলো ফুটতে তখন অনেক দেরি। সাড়হীন গাছপাখিগুলো কিচিরমিচির রবে কণ্ঠমধু ঢেলে দেয়নি প্রকৃতির কানে। কিন্তু রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন বাতির কুহেলী ভেদ করা আবছা আলোক, পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলছে এস.কে পরিবহনের দূরপাল্লার পরিবহনটি। দোদুল দুলছে। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে চালক যেন নিজের সাথে নিজেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে। পঁয়তাল্লিশ আসন বিশিষ্ট গাড়ির যাত্রীদের সবাই হয়ত গভীর ঘুমে মগ্ন । দুইজোড়া চোখ তখনো নিদ্রাহীন, ছন্নছাড়া। চোখের পাতাগুলো চাইলেই এক করা যায়না। মাঝেমাঝে চিত্ত দুর্বল করা গাড়ির ঝাঁকুনি আরও দুর্বল করে দিয়ে যাচ্ছে চারপাশের নিস্তব্ধতা।
স্বর্ণা তানভিরের কাঁধে মাথা রেখে ঢুলছে। এলোচুল তানভিরের নাক-মুখে বিড়বিড় করে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কিন্তু তানভিরের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। থাকবেই বা কী করে!
বিশাল এক পাহাড় কেটে ওপরে ওঠা নিদারুণ-ই না কষ্টের ফেরা। যে কষ্ট সবাই না পারে নিতে না পারে সহ্য করতে।
তানভিরকে যে সেই কাজই করতে হচ্ছে।
‘এই, তুমি চিন্তা করছ কেন শুনি?’
তানভিরের মুখে স্বর্ণার কোমল হাতের কোমল পরশে কেঁপে ওঠল মুখটা।
‘কই নাতো!’
'ক্ষুধা লেগেছে, কিছু খাবে?’
নাহ।
তুমি তো সে কখন থেকে না খেয়ে আছো, ব্যাগের ভেতর কিছু খাবার আছে। বের করো।
এ যেন ঠিক টালিউডের ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ সিনেমার বাস্তব জেরক্স কপি।
তানভির যে কতবার এই সিনেমার দর্শক হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। অথচ আজ তাকেই সেই সিনেমার মত বাস্তব অংশ হতে হচ্ছে।
তানভির আফসোস করে বলে ওঠল, ‘হায়রে নিয়তি!’
এই নিয়তি তাদের পক্ষে থাকলে তাদেরকে আজ বাসা থেকে পালিয়ে আসতে হতোনা। বাবা-মা-ও কষ্ট পেত না। ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দিত যদি!
যদি শব্দটা আবার দীর্ঘশ্বাসে রুপ নিল তানভিরের কাছে। বুকের বাঁ পাশে তখন চিনচিনে ব্যথা।
আচ্ছা, এই সমাজের ভালোবাসার মানুষকে মেনে নিতে কেন এত ওজর-আপত্তি? মানুষ কেন বোঝেনা, নিজের পরিবারও কেন বোঝেনা? সুপাত্রে কন্যা দান করাটাই তাদের কাছে সব। তাদের সন্তান ভালো থাকার কিছু পাচ্ছে কিনা সেটা কি পরিবার দেখতে পায়না? নাকি সমাজই তাদের অন্ধ বানিয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর অজানা তানভিরের কাছে, ঠিক ততটাই স্বর্ণার কাছে।
গত কয়েক মাস ধরে যখন স্বর্ণার বাড়িতে বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসছিল, স্বর্ণা সাফসাফ তানভিরকে বলে দিয়েছিল, আর যাইহোক, বাড়ির পছন্দে সে বিয়ে করবে না। দরকার হলে পালিয়ে আসব আমরা।
ভীষণ ভালোবাসায় আবদ্ধ দুজনকে তাই বেছে নিতে হল উদ্দেশ্যহীন এই যাত্রা। কে জানে কোথায় হবে তাদের ঠিকানা!
ফুলস্পিডে চলন্ত গাড়ি হঠাৎই ঝাঁকুনি খেয়ে ব্রেক কষলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল কয়েকজন লোক। তানভির-স্বর্ণার সিট বরাবর এসে সোজা স্বর্ণার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে বের করে নিল সিট থেকে। গাড়ির যাত্রীরা ততক্ষণে সজাগ হয়ে গেছে। কিন্তু সবাই নির্বিকার। কারও কিছু করার ক্ষমতা নেই যেন। তানভির বাধা দিতে যাচ্ছিল,অমনি কুলা সাইজের একটা হাত সটান এসে পড়ল তানভিরের মুখ বরাবর। স্বর্ণা তানভিরের ব্যাথাহুত মুখ দেখে গলাছেড়ে চিৎকার করে ওঠল আ......আ....আ....। বাঁচাও.....
স্বর্ণার চিৎকারে তার মা পাশে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে মা? বলল আমাকে।
স্বর্ণার মুখে ভয়ের একটা আচ্ছন্ন ভাব যেন তখনো রয়ে গেছে। এতসময় ধরে সে স্বপ্ন দেখছিল তাহলে! ধুর ছাই! তাই বলে এত ভয়ংকর স্বপ্ন! কী এক বিচ্ছিরি অবস্থা।
‘মা, তানভির তোকে সেই কখন থেকে ফোন দিচ্ছে, না পেয়ে আমার কাছে ফোন দিয়েছে। দিনে-দুপুরে ঘুমাচ্ছিস বলে আর ডেকে দেইনি। জামাই বাবাজির সাথে একটু কথা বলতো মা। কী এক দরকারী কথা আছে নাকি।’
আজ তিনদিন হলো, তানভির-স্বর্ণার বিয়ে হয়েছে। লাভ ম্যারেজে। দুজন দুজনার আকাক্সিক্ষত মানুষকে পেয়ে স্বর্গসুখ বারবার ছুঁয়ে যাচ্ছে যেন তাদেরকে।
স্বর্ণা তখন মুখে একমিষ্টি হাসি নিয়ে তানভিরের কাছে কল দিল। ওপাশে তখন শব্দ পৌঁছে গেছে ক্রিং...ক্রিং......।
সরকারি এম এম কলেজ।
ইংরেজি বিভাগ।
অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ।