ছায়ার দিকে তাকিয়ে কায়া!
হাসনাত আসিফ কুশল
১.
এরপর আর কখনো দেখে নি তাকে কায়া। সেই যে একবার ধমকে বিদায় করে দিয়েছিলো তাকে আর আজ এই বৃষ্টিভেজা বিকেলবেলায় জবুথবু হয়ে সে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু সন্দেহ হলো তার। হঠাৎ পুরনো কোনো ফাইলে ছেলেবেলায় লেখা কোনো কবিতা পেলে যেমন অনুভূতি সঞ্চারিত হয় সে খেয়াল করলো অবিকল অনুভূতি সে অনুভব করছে। এক মিনিট সে এভাবেই তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। এক মিনিট পর কায়ার মনের বিপ্লব যেন শিহরণ জাগালো। আপাত অপরিচিত লোকটি বললো, ভাবছো তোমার ধমকে আমি কিছু মনে করেছি কিনা। কায়া কিছু মনে না করে দরজা খুলে দিলো। কায়া তার শয্যাকক্ষে চলে গেল। আপাত অপরিচিত লোকটি এসে বৈঠকখানায় বসে থাকলো। টিভিটা অনবরত চলছে। দেখার কেউ নেই আবার বন্ধ করার কেউও নেই। লোকটি সোফায় একঘেঁয়ে বসে থাকলো। কায়াও আসছে না। অবশ্য লোকটির মনের মধ্যে কোথাও কায়ার অস্তিত্ব আছে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু তাহলে কেন এসেছে সে ? সোফায় যেখানে সে বসে আছে তার সামনেই একটা আয়না। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে। আয়নায় তার প্রতিবিম্ব বলে উঠলো, কেন এসেছো এখানে ? ভালোবাসো কায়াকে ? সে মনে মনে উত্তর দিলো, না তো। তখন তার প্রতিবিম্ব বলে উঠলো, তাহলে কেন এসেছো ? সে বললো, এসেছি...কারণ, উম। উম। আসলে কারণ সে জানে না। সেই যে ২০০৯ সালে অফিসার্স ক্লাবে কায়ার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল কি একটা কারণে। এখন পর্যন্ত সে ভুলতে পারছে না। অথচ কায়া বোধহয় তাকে বেমালুম ভুলে বসে আছে। মনে মনেই বললো সে। প্রতিবিম্ব তখন জানালো, কায়া তোমাকে ভোলে নি। শয্যাকক্ষে গিয়ে দেখ ও কি মনে করে কাঁদছে। এবার লোকটি অবাক হলো। এটা কি কোনো দিবাস্বপ্ন ? একটু ইতঃস্তত করলো। আড়ষ্টভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো সে। পারলো না। এভাবে দরজার সামনে গিয়ে টোকা দিলো। এরপর আরও অবাক হলো যখন সে কান্নার শব্দ শুনতে পেল। সে ভাবলো, যাবো কি যাবো না। শয্যাকক্ষের চৌকাঠ থেকে দুই পা এগোতেই কায়া তার দিকে তাকালো। তারপর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তুমি ক্ষমা করো আমাকে। সে বললো, আচ্ছা ঠিক আছে। এরপর সে বললো, তোমার জন্য আমি দশ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। কায়া কি মনে করে আলমারির দিকে গেল। কি যেন খুঁজছে ও। কি খুঁজতে পারে ও। প্রশ্ন আসলো লোকটির মনে।
কায়া আবার খালি হাতেই ফিরে আসলো। লোকটি বললো, কি খুঁজছিলে তুমি ? কায়া কিছুই বললো না। তারপর লোকটি বললো, তোমার শয্যাকক্ষে আসার জন্য দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করো। আমি লজ্জিত। কায়া তাকালো একবার তার দিকে। তারপর বললো, তোমার যেতে ইচ্ছে করলে চলে যাও। আমি এখানেই অপেক্ষা করবো। সে বৈঠকখানায় গেল। টিভি চলছে। সে টিভির রিমোট হাতে নিলো। টিভির দিকে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করলো। নাহ। টিভির দিকে মন যায় না। একটু পর কায়া আসলো তার কাছে। বসলো তার সামনে। তারপর বললো, আগামীকাল তার বিয়ে। পাত্রপক্ষ তড়িঘড়ি করছে বিয়ের জন্য। পাত্র নাকি লন্ডনে চলে যাবে। সে বড় মাপের আর্টিস্ট। গান করে। কিন্তু এই বিয়েতে সে রাজি না। ফ্যামিলি তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে। লোকটি সব শুনলো। তারপর তাকে বললো, দেখ আমার এখানে কি করার আছে ? কায়া তাকে বললো, তুমি আমাকে বিয়ে করে ফেল। লোকটি এবার বিব্রত হলো। বললো, দুঃখিত বুঝতে পারি নি। আবার বলো। কায়া বললো, তুমি আমাকে বিয়ে করে ফেল। লোকটি বললো, নাহ। এই মুহূর্তে আমার পক্ষে বিয়ে করা পসিবল না। কায়া এবার আর কোনো কথা বললো না। লোকটিও চুপ। অনেকক্ষণ পর কায়া বললো, আমার কোনো কিছু ভালো লাগছে না। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা প্রয়োজন। লোকটি বললো, আমি তো তোমাকে ক্ষমা করেই দিয়েছি। কায়া বললো, না আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। অন্তত আমাকে বাঁচানোর জন্য বিয়েটা করো। লোকটি বললো, ভেবে দেখছি। তারপর উঠে দাঁড়ালো লোকটি। লোকটি দেখলো, এখানে থাকলে সে নিজেও পাগল হয়ে যাবে। তারপর তার জন্য কত অর্থ খরচ হবে পরিবারের। দ্রুত প্রস্থান করলো সে। কায়াও ছুটলো বারান্দার দিকে। বারান্দায় এসে ডাকছে তাকে। কায়া কিছুতেই তাকে হাতছাড়া করতে চায় না। কিন্তু লোকটি এমন দ্রুত প্রস্থান করলো কায়া তার নাগাল পেল না। কিন্তু কায়ার তাকে প্রয়োজন খুব। কারণ লোকটি যে কায়ার খুব ভালো বন্ধু আয়ুশ। কায়া ওকে ভালোভাবেই চেনে। কিন্তু দশ বছর আগের একটা ভুল সিদ্ধান্ত এখন কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। এখন তার মনোজগত ভেঙে পড়েছে। সে বারান্দায় আরামকেদারায় বসে পড়লো। একটু কিছুক্ষণ বসে থাকলো। তার পথের দিকে সে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে আরম্ভ করলো। একটি সিদ্ধান্তে সে অটল থাকলোই। তাকে ওর সাথেই বিয়েটা করতে হবে। যেমন করেই হোক।
২.
স্বভাবত কায়া কখনো হুটহাট সিদ্ধান্ত না নিলেও এই প্রথমবার সে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলো। সে আয়ুশকেই বিয়ে করবে। কিন্তু বাসায় বলতে পারছে না। কি করবে ভেবে পেল না। এমন সময় সে ভাবলো সিধায়াকে ফোন করলে হয়তো লাভ হবে। সিধায়া আয়ুশের এক বন্ধু। ওর সঙ্গে আয়ুশের সূত্রেই পরিচয়। আয়ুশের সঙ্গে তার পরিচয় ২০০২ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে। এরপর একসাথে ওরা কলেজ এবং ইউনিভার্সিটি পাস করেছে। ইউনিভার্সিটিতে পরিচয় সিধায়ার সঙ্গে। তখন থেকেই সিধায়ার সঙ্গে খাতির তার। সিধায়াকেই তাই সে বেছে নিলো আয়ুশকে বিয়ের ব্যাপারে বলার জন্য। কায়ার সঙ্গে ওই ভাবে আয়ুশের খাতির না থাকলেও সিধায়ার সঙ্গে গলায় গলায় ভাব।
‘সিধায়া ?
‘হ্যাঁ বল।
‘আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।
‘কি কাজ ?
‘আয়ুশের সঙ্গে তোর সম্পর্ক কি এখনো আছে ?
‘হ্যাঁ। কেন ?
‘আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। সেদিন বাসায় এসেছিলো। আমি ওইদিন বলেছিলাম। তারপর কি মনে করে ও আমার সঙ্গে কথা শেষ না করে পালিয়ে গেল।
‘পালিয়ে যাবে কেন ? তুই কি ওকে সামনাসামনি প্রপজ করেছিস ?
‘হ্যাঁ।
‘আরে, ও তো ব্রহ্মচর্য নিয়েছে। ও কখনো বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছে। (হুট করে সিধায়া মিথ্যা কথা বলে ফেলল।)
‘বলিস কি ?
‘হ্যাঁ।
‘আচ্ছা তাহলে...।
ফোন রেখে দেয়।
আসলে সিধায়া ওকে ভালোবাসে। কিন্তু বলতে পারেনি। একারণেই কায়াকে এ কথা জানাতে চায় নি। কিন্তু সে ভাবলো আয়ুশকে এ কথা বলা খুব জরুরি। না হলে আয়ুশকে অন্য কেউ বিয়ে করে ফেলবে। আজ কিংবা কালÑবিয়ের কথা বলবেই।
৩
কিন্তু আয়ুশ যে কোথায় গেছে তা কেউ বলতেই পারছে না। আয়ুশ ওই দিন থেকে তার বাড়ির লোক থেকে লাপাত্তা। কেউ জানে না কোথায় গেছে সে। সিধায়া ফেসবুকে নক করলে দেখলো সে অনলাইনে নেই। অপেক্ষা করতে থাকে সিধায়া। আবার কায়াও বটে। কারণ কায়া জানে আয়ুশ কখনো এমন কোনো ব্রত নিতে পারে না।
আয়ুশের বাবা জিডি করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। পুলিশের সন্দেহ হলো কোনো জঙ্গিসংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লো কিনা। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ওর বাবা বলে উঠলো, ও কখনো ওদিকে যাবে না। ওকে আমরা চিনি।
তবে কায়া ভীষণ মুষড়ে পড়লো। বাসায় বিয়ে। তাকে লাল পাড়ের শাড়ি পরে বসে থাকতে হচ্ছে। শুনেছে যার সাথে ওর বিয়ে হচ্ছে তার নাকি একটা গিটার ও একটা ভায়োলিন আছে। মোহরানা হিসেবে সে ওকে ওই গিটার ও ভায়োলিনটাই দেবে। কিন্তু গিটার-ভায়োলিন কোনোটাই ওর পছন্দ না। এর মধ্যে একটা কা- হলো। আয়ুশ কোত্থেকে এসে কোনো মতে কায়ার ঘরে ওকে একা পেয়ে বললো, আমি বুঝতে পেরেছি তোমার ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ের কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি তখন তোমার কথায় রাজি ছিলাম না। এখন রাজি আমি। তোমার বাবাকে আমি বলছি। কায়া বললো, তুমি না ব্রহ্মচর্য নিচ্ছো ? আয়ুশ তখন বললো, কে বলেছে এসব কথা। কায়া বললো, সিধায়া বলেছে। আয়ুশ বললো, ও মিথ্যে বলেছে। কায়া শুনে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লো। কিন্তু কায়ার মামী এই মুহূর্তে এসে দেখে ফেললেন ওদেরকে। তারপর সে বললেন, তোমরা এখানে কেন ? আয়ুশ তখন বললো, কায়ার সঙ্গে যার বিয়ে হচ্ছে তাকে কায়ার বিয়ের ইচ্ছে নেই। মামী তখন বললেন, সেটা আমাদের ব্যাপার। কিরে কায়া সত্যিই কি তোর ইচ্ছে নেই ? কায়া বললো না কিছুই। মামী এবার ধরতে পারলো কায়া কি চায়। তারপর মামী বললেন, এ ছাড়া কিই বা করার আছে ? কিন্তু ছেলেটা তো ভালোই। পড়াশুনায় উচ্চশিক্ষিত, গানও পারে। তাহলে ?
কায়া কিছুই বললো না।
কারণ সে জানে এসবকিছুই স্বপ্ন তার। আর তাই আয়ুশ তার জীবনে এসেছে এটাই তার জন্য বড় কথা। আয়ুশের ছায়ার দিকে তাই তাকিয়ে সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল।