সেদিন বর্ষাকাল
আহাদ আদনান
টানা বৃষ্টিতে উঠোনের মাটি মাখোমাখো হয়ে আছে। পা পড়লেই ছোট মত গর্ত হয়ে যায়। পাশের জল এসে সেই গর্ত আবার ভরিয়ে দেয় এক নিমিষে। বিকেল থেকেই আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। সূর্য লুকিয়েছে। কেমন যেন রাত রাত মনে হচ্ছে। সেই ক্ষীণ আলোতে উঠোনে আমি পদচিহ্ন আঁকছি। ‘পানি পাড়াসনে। ঠা-া লেগে যাবে’। মায়ের হাঁকে শেষ করে দিই খেলা।
দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। বিদ্যালয় বন্ধ। সেটা না হলেও সমস্যা ছিল না। এমন বর্ষার সন্ধ্যায় বৃষ্টি মানেই ছুটি। কবিগুরু শিখিয়েছেন, ‘মেঘের কোলে রোদ’ এসে ‘বাদল গেছে টুটি’ দেখলেই ছুটি। আমার জন্য যে কোন সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলেই ছুটি। আমরা বসে আছি রসুইঘরে। মা, চার বছরের ছোট বোন আর আমি। বোন আর আমি মিলে এখন নতুন একটা খেলা খেলছি। ‘কাগজ কাগজ খেলা’। ছোট ছোট কাগজ কেটে আমি পেন্সিলে ছবি আঁকছি। মুখের ছবি, ফুলের ছবি, নদীর ছবি। সেই কাগজটা পানিতে ভিজিয়ে সেঁটে দিতে হবে হ্যারিকেনের চিমনিতে। একটুপরে নাকে আসবে পোড়া পোড়া গন্ধ। কাগজ শুঁকিয়ে তখন মচমচ করবে।
মা বসেছেন চিংড়িগুলো নিয়ে। দুপুরে বাবা বের হয়েছিলেন ডিঙি নৌকা করে বিলে। জালে ধরা পড়েছে অনেকগুলো টেংরা, বেলে, পুঁটি আর গুড়া চিংড়ি। দুপুরে আলু আর বেগুন পাতলা করে কেটে মা করেছিলেন চিংড়ি বাদে বাকি মাছগুলোর ঝোল। উপরে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন সবুজ সবুজ ধনেপাতা। সেই গন্ধে আমরা বাসন নিয়ে ছুটে এসেছিলাম রসুইঘরে। ‘তোদের বাজান গোসলটা করে আইলেই ভাত দিমু। পুরান চাল সেদ্ধ হইতে দেরি হবে’। হেসে বলেছিলেন মা। খেতে বসে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছিলাম, চিংড়ি গেল কই?
কুপি’র সলতেটা মা একটু নেড়ে দিলেন। জেগে ওঠা আলোতে দেখলাম পাটায় মা চিংড়ি বাটছে। সাথে লাল লঙ্কা, রসুন। চিংড়ি ভরতা হবে। খুশিতে মন লাফিয়ে উঠছে। কিন্তু ভরতা’তো মা করে দুপুর বেলায়। সাথে আর কিছু থাকবে? ‘ব্যাঙ, ভাইজান’ বলে চেচিয়ে ওঠে বোন। তিনটা ব্যাঙ ঢুকে পড়েছে বেড়ার নিচ দিয়ে। ওদের চিনি আমি। রোজই আসে। টুকটুক করে লাফ দেয়। আমরা ধরতে গেলে পালিয়ে যেতে চায়। এক দুইদিন ভয়ে পেশাব করে দেয়। বড্ড নিরীহ বেচারা এই ব্যাঙগুলো।
পাটাতে এখন ভিজিয়ে রাখা চাল আর ডাল। পাশে একটা বাসনে কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, পেয়াজ। আমার যেন চাঁদরাতের আনন্দ পেয়ে বসে। চাপটি হবে, আজ চাপটি বানানো হবে। এগুলো একসাথে মেখে তাওয়ায় দিয়ে ঢেকে দিবেন মা। একটু পর রুটির মত হলুদ মচমচে চাপটি। চিংড়ি ভরতা দিয়ে মজা করে খাব। আমার চোখের ভাষা পড়ে ফেলেছেন মা। ‘তুই তো চাপটি খাবি না, তাই না’? আমি ছুটে আসি, ‘ইশ, আমি দশটা চাপটি খামু। আর কত দেরি হইব মা’? ‘এই হইল বইলা। ছাতা আর হ্যারিকেনটা লইয়া তোর জ্যাঠাদের বাড়িতে যা তো বাপ। তোর বাজান গেছে রেডিও শুনতে। স্বাধীন বাংলা বেতার। গিয়া ক, মা’য় খাইতে ডাকছে’।
সেদিন বর্ষাকালের সন্ধ্যারাত। পানি-ভরতি উঠোনে পা ফেলছি মেপে মেপে। একটু এদিক সেদিক হলেই আলুর দম। রসুইঘর আর গোয়ালঘরের মাঝখান দিয়ে ছোট একটা সরু রাস্তা। সেটা পার হলে জ্যাঠাদের পালান। পালানের পানিতে আমার গোড়ালি ডুবে ডুবে যাচ্ছে। হঠাৎ আসা বাতাসে আমার ছাতা হাত থেকে যেন পড়ে যেতে চাচ্ছে। এইতো জ্যাঠাদের জোড়া কাঁঠাল গাছ। বাহির বাড়িতে আজ কেও নেই? বাড়ির ভিতরে ঢুকতে গিয়ে রেডিওতে শব্দ ভেসে আসে। একটি বজ্রকন্ঠ। ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়’। এই কণ্ঠস্বর আমার চেনা। এই ভাষণ আমার মুখস্ত হয়ে গেছে।
সবাই ছিল একটা ঘোরের মধ্যে, তাই বুঝি আমাকে খেয়াল করেনি। বাবাই প্রথমে দেখেন। ‘আরে বাজান এই বাদলার মধ্যে কেমনে আইলা? হায়, হায়, ভিজে কাক হয়ে গেছে দেখি। ঠা-া লাইগা যাবে। আসো, বাড়িতে যাই। আমি আইজ যাই ভাইজান’। আমাকে কোলে করে দশ মিনিটে আসা পথটা বাবা দুই মিনিটে পার হয়ে এসে পড়লেন।
গরম গরম চাপটি আর ভরতা বাসনে বাসনে। ছোট বোনটাও খাচ্ছে মজা করে। চোখে আমাদের খুশির ঝিলিক। ‘মিলিটারি ঢুইকা পড়ছে মোস্তফাপুরে। বাড়িঘর পুড়ায়া দিতাছে। গুলি কইরা সব শেষ করে দিতাচ্ছে। আর জোয়ান’, বাবার কণ্ঠ থেমে আসে। হয়ত খাদ্যনালীও চেপে আসে। বাবা মুখে দিতে পারেননি একটা টুকরোও। ‘রমিজ, হাসু, সিদ্দিক ওরা মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাইছে। এইভাবে ভীরুর মত বাঁচা যায় না। বঙ্গবন্ধু ঠিক কথা কইছে। আমাগোর যা কিছু আছে তাই নিয়াই মোকাবেলা করতে হইব’।
‘তুমি গেলে আমাদের কি হইব? আমরা যামু কই’? মা’র চোখে জল টলমল করছে। আমারও কেন যেন ভয় লাগছে।
‘আল্লাহ দেখব তোমাদের। দেশ স্বাধীন না কইরা আমি ফিরব না’।
সেদিন বর্ষাকাল। বেড়ার চালে বৃষ্টি পড়ছে ঝপঝপ করে। একটা হ্যারিকেন আর একটা কুপি জ্বলছে আমাদের রসুইঘরে। জলের ছিটা পড়ছে আমাদের গায়ে। তিনটা ব্যাঙ লাফাচ্ছে। কালো বিড়ালটাও খাবারের লোভে ঘাপটি মেরে আছে। ছোট বোনটা ঘুমিয়ে গেছে। আমাদের তিনজনের সামনে বাসন। গরম চাপটি ঠা-া হয়ে গেছে। আমরা কিছুই খেতে পারছি না। আমাদের চোখে অনিশ্চয়তা, ভয় আর অসহায়ত্ব ভর করেছে। কুপিটার সলতের মত আমরা যুদ্ধ করছি মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে।
মাতুয়াইল, ঢাকা।