মাওলার সান্নিধ্য...

 



মাওলার সান্নিধ্য

সুলতান আহমদ 


আনমনে বসে আছি পুকুর পারে। ধান ক্ষেতের সবুজ। নীলাভ আকাশ। মেঘের লুকুচোরি। হিমেল বাতাস। প্রাণ জুড়িয়ে দেখছি আকাশ। অশান্ত হৃদয়। কিসের যে বড্ড অভাব! 

মনে হলো সুহাসের কথা। আহা! পাহাড়সম ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছে। তার চেয়ে তো আমি হাজার গুণ ভালো। আল্লাহ আমায় ভালো রেখেছেন। সেদিন হঠাৎ বাজারে দেখা। উদ্ভ্রান্ত, উদাস। সুহাস, তুই বেঁচে আছিস? কোনো খুঁজ-খবর নাই। অনলাইন-অফলাইন কোথাও পাওয়া যায় না। ব্যাপার কি?

চল, চা খেতে খেতে গল্প করি। বাজারে আমার পরিচিত এক রেস্তোরাঁ আছে, নিরিবিলি। একপাশে গিয়ে বসলাম। এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। তার মন খারাপ। ভিষণ খারাপ। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ওয়েটার এসে ফেন চালিয়ে দিল। মিষ্টি হেসে বললো কিছু দেব ভাই? দু’কাপ কড়া চা-নিয়ে আয়। সাথে দুটো সিঙ্গাড়া। চলে গেল। সুহাস বল কি হয়েছে? ইদানীং তর গতিবিধি কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। সেই যে চাকরির খবর দিয়ে লাপাত্তা হলে। দেখা নেই, কথা নেই, নেই আমাদের আগেকার সে আমেজ। কারণ কি? চোখে পানি টলমল করছে। বুঝতে পারলাম তার সাথে কিছু হয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা যাকে বলে। যে ছেলেটা দেখলেই বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরত। হাজার কথায় হাসাতো। সে আজ নিরব। কত ব্যাদনা তার অন্তরে। হৃদয়ে হারানোর শোক।

দুস্ত বলে আর কি হবে। যা ঘটার ঘটেই গেছে। কি হয়েছে বল? জানিস, মা-বাবাকে নিয়ে সুখেই ছিলাম। চাকরিটাও চলছিলো ভালো। বেতন ও কম নয়। একদিন আব্বা বললেন, সুহাস একটা জিনিস বলবো, শুনবে বাবা? জি, বলুন। মেয়ে দেখেছে তর মা । পরিবার ভালো। দ্বীনদার। মেয়েটিও খুব ভালো। সুন্দরী, গুণবতী। এবছর দাওরা সমাপন করেছে। তুই একদিন দেখে আয়। ‘মা’ এসে বললেন আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুই কবে দেখতে যাবে বল। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকুই বললাম তোমাদের পছন্দ হয়েছে আমি দেখে আর কি করবো। তা কি হয়? তুই যাকে নিয়ে সারাজীবন সংসার করবে, তাকে না দেখে  আনবি? ‘মা’ তোমার পছন্দই তো আমার পছন্দ। না, তা হয় না বাবা। তুই কবে দেখতে যাবে এটা বল। আচ্ছা মা! তোমরা যেদিন বলবে সেদিনই দেখতে যাব। ঠিক আছে তুই পরশু গিয়ে দেখে আয়।

মেয়েটা মাশাআল্লাহ। যেন কোন হুর। সুন্দরে কোনো কমতি নেই। ‘লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি আহসানি তাক্বওয়ীম’। দেখলাম। চলে এলাম। ‘মা’ জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে মেয়ে কেমন লাগলো? ভালো, খুব ভালো। আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে তো কোন সমস্যা রইল না। এবার বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করি। সব কিছু ফাইনাল। বিয়ে আগামী মাসের দশ তারিখ। ভাবছিলাম বিয়েতে খুব আনন্দ করবো। তোদের সবাইকে বলবো। কেউ ওযর দেখালে জোর করে নিয়ে যাব। ভাগ্য- এসব কিছুই হতে দিল না। কি আর করা।

এদিকে চা-ঠান্ডা হয়ে জুস বনে গেছে। কোনো খেয়াল নেই। ভগ্নহৃদয়ে শুনছি তার কথা। চা-সিঙ্গাড়া কখন যে দিয়েছে খেয়াল করিনি। ওয়েটার এলো কাপ নিতে। এসে কাপ দেখে চোখ বড়সড় করে বলল ভাই, চা! 

অহ, তুই কবে চা-দিলি? সেই কখন দিয়ে গেলাম আপনারা খেলেন না? আচ্ছা, যা ভাই আরো দু’টা কড়া চা-দেয়। এগুলো নিয়ে যা। চলে গেল।

বল সুহাস তারপর? হঠাৎ মায়ের শরীর খারাপ হলো। নিয়ে গেলাম ডাক্তারে। ডাক্তার দেখে হতবাক! কি যেন আশংকা করছেন। টেস্ট দিলেন লিখে। ফাইল পত্র নিয়ে সন্ধ্যা পর আবার চেম্বারে। ডাক্তার নীরবে রিপোর্ট গুলো দেখছেন। কপালে ভাঁজ পড়ল। যেন খুব চিন্তিত। আমার হৃদয় নাড়া দিল ডাক্তারের অবস্থা দেখে। মনে মনে আল্লাহকে বললাম, ‘ইয়া  শাফিয়াল আমরাদ’ ভালো কিছু শুনাও। ডাক্তার বললেন বাবা দেখ, হায়াত মওত আল্লাহর হাতে। তিনি যতদিন যাকে হায়াত দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, এর একদিন এক সেকেন্ট বেশি কেউ বাঁচবে না। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি ওগুলো সেবন করাও। আল্লাহকে বলো। জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে আমার মায়ের? বললেন কিছুই হয়নি। কমে যাবে। আল্লাহ কমিয়ে দিবেন। চলে এলাম। মন দুরুদুরু করছে। আম্মা বললেন কিরে ডাক্তার কি বললো। কিছুই বলেননি। বললেন ‘ইনশাআল্লাহ’ সেরে যাবে। বাড়ি ফেরার পথে মোবাইলটিও চোর নিয়ে গেল। কি করবো, ভাবলাম আরেকটা কিনে নিব। বাড়িতে এসে মায়ের অসুস্থতা বেড়ে গেল। ওষুধ কোন কাজ করছে না। বিয়ের মাত্র আট-দশদিন আছে। কাউকে দাওয়াত দেয়া হয়নি। মাকে নিয়ে আবার গেলাম ডাক্তারের কাছে। তিনি সব খুলে বললেন। ওষুধ কিছু বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আল্লাহ আল্লাহ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। হতাশ আমি। কি করবো। নিরাশার চাদর সরিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আম্মাকে কিছুই জানাইনি। বাড়িতে গিয়ে আব্বাকে সব বললাম। তিনি তো পড়ে গেলেন মহা চিন্তায়। আমি বিপাকে কি করবো, একদিকে বিয়ে আরেকদিকে ‘মা’। ভাবলাম কাউকে বলব না। দু’চার জন গিয়ে নিয়ে আসবো। আব্বার সাথে পরামর্শ করে এটাই ফাইনাল। আজ বিয়ে। মায়ের অবস্থা একেবারেই নাজুক। ভুলে গেলাম বিয়ের কথা। শুক্রবার দিন। জুমআ পর বের হওয়ার কথা। নামাজ পড়ে বাড়িতে এসে দেখি ‘মা’ মুখে কালিমা জপছেন। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। বললেন কাঁদিস না বাবা। যা বৌমাকে নিয়ে আয়। আমি কি যাবো? না, পাশেই বসে থাকলাম। আস্তে আস্তে চোখ ছোট হচ্ছে। চোখের পলক নড়ছে। কালেমার আওয়াজ ক্ষিণ হচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। জমিন সরে গেল পা থেকে। যখন আব্বা বললেন বাবা তর মা নেই। এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে মাওলার সান্নিধ্যে....!





শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট