হাওরপারের জীবন ও জীবীকা

 

     ছবি : জি এম ফ্রাজের ।

সুনামগঞ্জ হাওরপারের জীবন ও জীবীকা 

ওবায়দুল মুন্সী 


কথিত আছে, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের একটি বড় অংশ এক সময় ‘কালীদহ সাগর’ নামে বিশাল জলরাশিতে নিমজ্জিত ছিল। পরবর্তীতে ভূপ্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে তা পিরিচ আকৃতির নিম্ন সমতলভূমিতে পরিণত হয়, এই সমতলভূমিই এখন হাওর। হাওর শব্দটিও সাগর শব্দের অপভ্রংশ। সাগর থেকে সায়র, সায়র থেকে হাওর।

সুনামগঞ্জ জেলার মোট হাওর সংখ্যা প্রায় ৯৫টি । অপূর্ব সুন্দর এক জনপদের নাম হাওর! হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশ খুবই নাজুক। যেখানে বছরে প্রায় ছ’মাস থাকে জলের নীচে। তখন হাওরকে দেখা যায় বিশাল সমুদ্রের মতো। গ্রামগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট দ্বীপ। বাকি ছয় মাস শুকনা মৌসুমে হাওর হয়ে ওঠে সবুজ গালিচা বিছানো মনোরমা আর; সোনালি ফসলের  মাঠ। 

ভৌগোলিক কারণেই সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলের জীবনযাত্রা ভিন্ন। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা এই অঞ্চলের মানুষদের একটু ভিন্নভাবে পরিচয় বহন করে। মূলত দুই ধরনের পেশার ওপর এই হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবিকা নির্বাহ হয়। সেটা হলো কৃষি এবং মৎস্য শিকার। দুটি পেশার সাথে এই অঞ্চলের নারী-পুরুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বেঁচে থাকার তাগিদে ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই সবার শ্রম দিতে হয়। সামাজিক প্রথার কারণে গৃহস্থলির সার্বিক কাজটা সামলে নিয়ে নারীরাও কৃষিকাজে শ্রম দেয়।

     ছবি : জি এম ফ্রাজের ।

হাওরের নারী শ্রমিক একাধারে একজন গৃহিণী এবং কৃষাণীও। মাঠে ধান আর গলায় গান বৈশাখ মাসে হাওর অঞ্চলে এ যেন এক মধুময় দৃশ্য। কালের পরিক্রমায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বর্তমান হাওর অঞ্চল এক অনিশ্চয়তা আর হতাশার নাম। মাঝে-মাঝে হাওরের প্রকৃতি ভয়াবহ রূপ নেয়। বর্ষাকালীন ঝড় এলে হাওরের পানি ফোঁসে ওঠে। এসময় হাওরে চলাচলকারী নৌকাগুলোকে নিরাপদ স্থানে এসে আশ্রয় নিতে হয়। নৌকাগুলো হিজল অথবা করচ গাছের সাথে বেঁধে রাখতে হয়।

বাতাস দীর্ঘস্থায়ী হলে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে গ্রামগুলোর ওপর। এ সময় বাড়িঘর ভাঙতে থাকে। হাওরের লোকেরা এ দুর্যোগকে বলে ‘আফাল’। এই ‘আফাল’ থেকে ঘরবাড়ি রক্ষার জন্য রীতিমতো লড়াই করতে হয় হাওরবাসীকে। ভাঙন প্রতিরোধে বাঁশ, কচুরিপানা ও বিভিন্ন প্রকার জলজ উদ্ভিদ দিয়ে বাড়ির চারপাশে নির্মাণ করতে হয় শক্ত বাঁধ।


 হাওরাঞ্চলকে বাংলাদেশের খাদ্য গুদামও বলা হয়ে থাকে। সুনামগঞ্জ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। শরতে ধবধবে সাদা কাশফুল, হেমন্তের শুকনো মৌসুমে চারদিকে ফসলি মাঠ, গাঁয়ের আকাঁবাঁকা মেঠোপথ, শীতে দুর্বাঘাসে শিশির ফোঁটা মুক্তার মতো হাসে। কবিমন ভাবনায় ডুবে যায় হাওরের অপরূপ এই রূপ দেখে! তখন হাওরপারের কৃষকদের  কলরবে সারা মাঠ মুখরিত হয়ে ওঠে। পৌষ-মাঘে শীতের পিঠা খাওয়ার উৎসব শুরু হয় কৃষকের ঘরে  ঘরে। বসন্তে গাছে গাছে নতুন পাতা ও ডালপালা গজায় আর সবুজ সমারোহে ভরে যায় হাওরের প্রকৃতি। কোকিলের কুহু কুহু ডাকে জানান দেয় বসন্তের আগাম বার্তা। তখন কী যে অপরূপ দৃশ্যপট তা হাওরবাসী মাত্রই জানে। আবার যখন বৈশাখ মাসে পাকা ধানের সোনালি রঙে সারা মাঠ ভরে ওঠে। হাওরপারের কৃষাণ কৃষাণীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে শুধু কাজ আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটায়। মাঝেমধ্যে চৈত্র মাসে ভারতীয় পাহাড়ি ঢালে, বছরের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সব সময় কৃষকদের তাড়া করে। কোনো কোনো সময়  ফাল্গুন মাস এলে সুনাগঞ্জের অনেক হাওরে পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয়।

চারদিকে খাল বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। এঁটেল এবং দো-আঁশ মাটির এসব এলাকায় মাটি ফেটে ধানক্ষেতে গর্তের সৃষ্টি হয়। খাল এবং বিলে পানি না থাকার কারণে বিপাকে পড়েন বিভিন্ন উপজেলার হাওরবাসী কৃষক। 



দেশের বৃহত্তম মৎস্য ভান্ডার সুনামগঞ্জের নলোয়ার হাওর, দেখার হাওর, মইয়ার হাওর, করচার হাওর, শনির হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর সহ প্রায় সবকটি হাওর। অত্র অঞ্চলের ভাষায়- লাছো মাছ ও গইন্না মাছ’ একমাত্র টাঙ্গুয়ার হাওরেই জন্মে। এই দুই প্রজাতির কার্পজাতীয় মাছ এখান থেকেই সারা দেশের হাওরাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। 

এ জেলায় প্রচুর বিল-বাদাল, ডুবা-নালা, জলাশয় থাকার ফলে অনেক মাছ উৎপন্ন হয়। যা দেশের অমূল্য সম্পদ। প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টিতে জীবনের মায়া উপেক্ষা করে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে জেলেরা বেরিয়ে পড়ে মৎস্য শিকারে। কেউবা পালতোলা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে আর কেউ ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে। ভয়-ভীতি কিছুই  নেই! তাদের শুধু একটা চিন্তা মাছ শিকার।

জীবন ও জীবিকার খুঁজে এভাবেই বিরূপ  প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে হাওরপারের মানুষের জীবন কাটে। 


হাওর গবেষণা, চর্চা, সংরক্ষণ এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সব কিছুই আজ কালের গর্ভে হারাতে বসেছে। হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন, হাওরের (আফাল) ঢেউয়ের সাথে হাওরবাসীর মানিয়ে নেওয়া জীবন-জীবীকা, শৈল্পিকতা, হাওরের সংস্কৃতি, গান, বিচিত্র পেশা, হাওরের মৎস্য সম্পদ, হাওরের সোনালি ধান, হাওরের সম্ভাবনা, হাওরাঞ্চলের জলেভাসা দ্বীপ ছোট ছোট গ্রাম, ঢেউয়ের গর্জন, হিজল-করচের বাগ, হাওরে জোছনা উদযাপন প্রভৃতি আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার কৃষ্টি-সভ্যতার অংশ।


জীববৈচিত্র্েযর আধার ও সৌন্দর্যের জলকন্যা টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটনের নামে যে পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যক্রম চলছে তা অচিরেই বন্ধ করতে হবে। হাওরের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে  সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলন নামে একটি সক্রিয় সেচ্ছাসেবী সংগঠন নিরলসভাবে কাজ করছে। শুধু সরকারি  আইন করে হাওরের পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। এ জন্য হাওর উন্নয়নমূলক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং  হাওরপারের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে  হাওরের পরিবেশ রক্ষা করতে। যদি হাওরের পরিবেশ রক্ষা করা যায়,তখনই নিরাপদ থাকবে  হাওরপারের মানুষ; সুন্দর ও সুখময় হবে তাদের জীবন ও জীবীকা। 


লেখক: হাওর বাঁচাও আন্দোলন কর্মী, সুনামগঞ্জ। 



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট