পদাবলি

 

      অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


মুখোশ

অলোক আচার্য


ঈশ্বর, তুমিও আজ ঢেকেছো মুখ মুখোশের আড়ালে

চিনতে পারিনি মন্দিরে তাই, হেঁটে গেছি যতদূর 

ফিরেছি আবার ফুটপাত ধরে, নগ্ন পায়ে

প্রার্থনার করুণ সুরে

আমিও চেষ্টা করেছি তোমার কৃপা পেতে।

আমিও তো পরেছি মুখোশ, তোমাকে দিয়েছি যতটা

অনেক বেশি নিয়েছি চেয়ে। ভেবেছি পেয়েছি সব

ওদিকে শূণ্যের পাহাড় জমে জীবনের একপাশে। 

মুখোশের দল আজ সবখানে, সব রাস্তায়, বিজ্ঞাপনের আড়ালে

বাজারের অলি-গলিতে মুখোশের বেচাকেনা-

লাভ যত হয়, ভাবি তার চেয়ে বেশি

সেই ক্রেতার ভিড়ে বুঝি তুমিও আছো! আমারই পাশে?

 


মায়ানগর

রহিম উদ্দিন 


পৃথিবীতে নেমে আর যা যা দেখলাম

অদ্ভুত সুন্দর!  ছন্নছাড়া কিছু আত্মার সংগ্রাম

অবিরাম বয়ে চলা আর ভেঙ্গে যাওয়ার গল্প

স্বপ্নিল মানুষেরা উড়ে উড়ে হয় কুৎসিত দাঁড়কাক

যেখানে ভুল গলিতে ঝুলে প্রেমের রঙিন কাগজফুল 

সাপুড়িয়ার বীণ শুনে ঘরের বাইরে এলেই

চোখে পড়ে— হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

মুখ ও মুখোশের মায়ার নগর।



স্বপ্নছায়া হাঁটে 

রজব বকশী 


হাঁটছি ঘড়ির কাঁটা জীবন প্রবাহ 

কত কথা বলি লিখি কিংবা এঁকে যাই 

আসলে তো এই জীবনকেই খুঁজে ফিরি 


অনন্ত হে অতলান্ত ভাবনার ঢেউ 

ভাঙচুরের বিচূর্ণ নিয়ে জেগে ওঠো অহর্নিশ 

বহুমাত্রিক বৈভবে দৃশ্য দৃশ্যান্তর 


প্রতিটি ভোরের বুকে শুয়ে থাকে 

আঁধার রাত্রির 

উপাখ্যান 


একফোঁটা শিশিরের মধ্যে খুঁজি সমুদ্রের ঢেউ 

আলোজলের আয়না জীবনকেই প্রস্ফুটিত করে

ধূলি¯্রােতের আবহ শূন্যতার ডানা মেলে ওড়ে


জানি হৃদয় বিছানো পথ ও প্রান্তর 

দুহাত বাড়িয়ে ডেকে যায় 

বিদগ্ধ প্রাণের স্পর্শে 


সবকিছুর ভেতর বাইরে স্বপ্নছায়া হাঁটে

প্রত্যাশার হাতে হাত ধরে দূরে কাছে

চৈতন্যের পাশ ঘেঁষে হৃদ্যতার ব্রিজ তৈরি করে




চড়ুই

রায়হান কিবরিয়া


যে চড়ুই

ঘরের চাঁলে বাঁধে প্রাণ প্রতিদিন।

সেও যায় উড়ে -

যখন জানতে পারে

ফুঁটো হয়ে গ্যাছে ঐ ঘরেরও টিন।


সেও খোঁজে ঘর, হয়ে যাযাবর।

নতুন ঘর যদি পেয়ে যায়-

ফেলে আসে ঘর, হয়ে স্বার্থপর! 

নিজের জন্য বাঁচে! ভীন্ন বাসায়!



এ শহর ঘুমায় না 

জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


বুকের উপর ঘুম পাড়িয়ে শহরকে, তুমি যখন

একা একা বিড়ালটাকে খেতে দিয়েছ মাছ;

ডোরাকাটা রিকশাটা কি অভিমান করে চলে গেল

তারপর বৃষ্টি হলো- মাদার তেরেসা কাঁদছিল ভীষণ !


পায়ের উপর বৃষ্টির লাশ- দেহটা উষ্ণ উষ্ণ;

কি রকম এক সন্ধ্যে এলো গড়াতে গড়াতে; একই

রকম এক ডজন শেয়ালের ডাকে ঘুম গেল শহরের

তুমি নখ কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেললে আঙ্গুল;


ভাদ্রদিন- গলিরমোড়ে কুকুরের শরীরীয় প্রেমে শরীর হাসে-

আমি কি সস্তা দামে বেঁচে দেই জীবন,

আরেকটা শহর তোমাকে নিয়ে নষ্ট হলো; 

নষ্ট হলো আরেকটা জন্ম; উষ্ণ ওমে প্রভাতফেরীর নাম

তারপর যখন আমি তুমি পথে হাঁটতে নামি 

তখন এ শহর চেয়ে থাকে, হাসে- এ শহর ঘুমায় না !



মিউচুয়াল সেপারেশন

শম্পা মনিমা 


একটি ঘর থাকার কথা ছিলো। কথা ছিলো, কথা বলার লোক ছিল, অবশ্য শুনতে পেতো। মন্তব্য করতো ইচ্ছা হলে, অথবা বক্তব্য পেশ।

একটা রোদটানা দুপুর দড়িতে মেলা ছিলো, সন্ধ্যেবেলার হাওয়ায় গা-ধোয়া সিফনের ওড়াওড়ি ছিলো, মেঘেদের ফাগুন জলসীমায় জলন্ত সিগারেট ঠোঁট পেতে আদর দিতো! 

এসপ্ল্যানেট, যাদাবপুর, রাসবিহারী মোড় ছিলো; টিউশন ছিলো, ঘন্টাতিনেক পরিচয়ের গল্প ছিলো, কাব্য ছিলো, রঙ্গহাসি ছিলো, বেশ অর্ধেক জীবনের সঙ্গ ছিলো...

সবচেয়ে বড়ো কথা একটা ঘর ছিলো, চোখ কাছাকাছি মনের কাছে ঘরদোর ছিলো। অনর্গল ঘোরের শোর ছিলো, দিনের শেষে রাতের কাছে খোলামেলা শরীরের মন-গল্প ছিলো, হয়তো অজুহাত মাত্র, পুরোপুরি  ছিলো রাতযাপন। 


রাত উড়িয়ে, চোখেমুখে লেগে থাকে কালচে রক্তের দাগ। তাৎক্ষণিক আনন্দের অপেক্ষাগুলো চেপে ধরে, চলমান সময়রেখা উড়ে বেড়াচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি দেখতে পাচ্ছি বিদ্রুপের ভঙ্গিমা, 

রক্তচোষা মুখ নিয়ে বিচ্ছেদের হাত 


স্বাভাবিকভাবেই কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না এইসব সজীব প্রাণে। উত্তেজিত হয়ে নাড়িয়ে দিচ্ছো হাত, ফিরিয়ে নিচ্ছো মুখ, কিন্তু 


এদের নিয়েই একটা ঘর থাকার কথা ছিলো।



তবুও তুমি ভালো থেকো 

রাসেদুল হাসান রাসেল 


আমার এই শ্বাশত জীবনের-

একুশটা রঙিন বসন্ত তোমায় দেবো, 

দেবো বসন্তের বাসন্তী শাড়ি।


একুশটা বর্ষা দেবো তোমায়, 

কালো খোঁপায় গুঁজে দেবো বৃষ্টি ভেজা নরম কদম।


একুশটা শরৎ দেবো,

দুজনে মিলে ঘুরে বেড়াব কাশফুলের বনে।


আরো দেবো

একুশটা গোলাপ,

একুশতম বয়সের একুশ রকমের হাসি।


তুমি না হয়

তোমার একুশ বছরের একুশ রকমের দুঃখ গুলো আমায় দিও।


তবুও,

তুমি ভালো থেকো।




ধ্যানের বেদী

মাজরুল ইসলাম


চেতনায় নয়, শুধু ছাঁট মালে গাঁথলে

ধ্যানের বেদী।


নোনা এখন কুরে কুরে খায়

সেই ইমারতের ভিত।


দেওয়ালে ফাটল দেখা দিলে

মধুকর ফিরে যায়

মধুখালীর নব বনগাঁ।


বিদীর্ণ দেওয়ালের ফাঁক ঠিকরে বেরোয় এখন

বিরহের গুঞ্জন।


ছাঁট মালে ধ্যানের বেদী

গাঁথা শুধু সার ?    



জুয়ার তাস কিংবা প্রেমিক জীবন

যাহিদ সুবহান


হরতন-রুহিতন কিংবা ইস্কাবনের মারপ্যাঁচে

সাধক বনে যায় মাতাল জুয়াড়ী

আর চালের তাস হয়ে যায় টাকা

জুয়ার টাকা গাছের পাতার মতো


কী নেশায় মতে ওঠে জুয়াড়ী

কী রাজা, কী রাণী, কিইবা গোলাম

এ নেশা শুধু জয়ের নেশা


আমার সমস্ত নেশা তুমি জুঁই

আমি তোমার জন্য প্রতি মুহূর্ত 

বাজী রেখে খেলে যাই জীবনের জুয়া...   



নদীগুল্ম

দ্বীপ সরকার


যে নদী জরাগ্রস্তÑমনে করো তাকে নারী

নাব্যতার চরে হাসনাহেনা-

নৌকোর ছই, দুলদুল ঘোড়া

ঘাটের নৌকো-পড়ে থাকা কাঠ


ঘাটের কোণে ইটভাটার ধুঁয়ো

অথচ গেলো বছরে গনগনে সাঁতার এখানে

অথচ কী যে হয়ে যাচ্ছে

কী কী হতে হচ্ছে নদীকে

নদী কখনো নারী

কখনো হাসনাহেনা চাষের ভূঁই


এ দেশের নদীগুল্ম বুড়ো আঙুল দ্যাখায়

কে তাকে ঠ্যাকায়

শুকনো বালুচরে এখন রাখালরা রাজা

প্রজ্ঞার জল নেইÑআছে বাওড়ী বাতাস


তুমি যাকে নদী ভাবো-সে স্ত্রী

স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলে বোঝা যায়

ওখানে নদীর ইতিহাস কতো কতো আগের



আত্মহনন

শাদমান শরীফ


দীর মতো বেঁকে বসে আছে নারী

ঢেউয়ের জিভ বহন করে তাড়নার ক্ষুধা 

এ নারীর কোলে মৃতশোয়া জনৈক পুরুষ

তার দৃশ্যের ভেতর ঝুলে আছে দুপুরের রোদ

অথচ উঠোনজুড়ে হননের হাহাকার


সে ভেবেছিল-

বাগানে এক চিলতে রোদ টানিয়ে রেখে অবসরে যাবে

ভেবেছিল, গুটিকয়েক সমব্যথী আঙুল বাড়িয়ে দেবে

সঙ্গীনির বুকে মাথা রেখে শান্তি নেবে 

অতঃপর সংগীতের রিনিঝিনি, কামনার জলকেলি।


আর-

প্রিয়তমা তাকে বারবার ঠেলে দেবে

ঈশ্বরের ভয়ংকর আজাবের দিকে।



শ্রী সূর্য সেন 

নটরাজ অধিকারী 


শ্রী সূর্য সেন, আমার বাল্যবন্ধু।

তাড়াহুড়ো ছুঁয়ে 

বড্ড সাহসী ছেলেটা, ভীতুদের পাশে 

হারিয়ে গেছেন! 

বহুকাল একা উদাসীন ;

এইখানে ভিটা পড়ে আছে - ঘরহীন।


আমার মনঘরে সে, তবু আসে

যায় প্রতিদিন।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট