গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ্
নিরুপায় নীলঞ্জনা
শফিক নহোর
তখন আমার নিগূঢ় প্রণয় চলছে মৌমিতার সঙ্গে। মৌমিতা খুব আবদার করে বলতো, ‘তোমার দেশের বাহিরে যাবার কী প্রয়োজন? দেশেই ভালো একটা চাকরি করতে পারলে আমাকে রেখে তুমি যেও না। তুমি দেশের বাহিরে চলে গেলে বাবা, আমাকে অন্য জায়গায় পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিবে।
‘তোমাকে বিয়ে দিবে কেন, আমি আছি না?’
আমাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করতো। ওর আবদার ছিল একটু শিশুসুলভ। এত অভিমানী মেয়ে অল্পতেই চোখের কোণায় জল গড়িয়ে পড়ত। আমার উপর রাগ করে কখনো কখনো রাতে ভাত খেত না, সকালে খেত না। আমাকে মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিতো আজ সারাদিন না খেয়ে আছি; আমি বিভিন্ন অসিলায় মিথ্যা অজুহাতে ওর সঙ্গে দেখা করতাম। ওকে খাইয়ে দিতাম উষ্ণ আলিঙ্গনে। আমি অনেকটা লজ্জায় ওকে এড়িয়ে চলতাম। আমার নিজের কাছেই মনে হতো, আমি ভীষণ ছেলেমানুষ, লাজুক কোয়ালিটির মানুষ।
এক বছর পরে আমি মিডলইস্ট চলে আসি চাকরির জন্য। এখানে এসে নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন পরিবেশ, নতুন লোকজন। সবকিছু কেমন যেন অগোছালো অচেনা। আমার ফ্লাইট হয়েছিল এসবি-জিরো এইট। বিমানে আমার সফরসঙ্গী হিসেবে যিনি ছিলেন তিনি পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার। ওনার সঙ্গে আলাপচারিতায় জেনে নিয়েছিলাম অনেক কিছু। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছিলেন। অমায়িক একজন মানুষ প্রচন্ড মিশুক টাইপের। সাত ঘণ্টার জার্নিতে উনাকে অনেক আপন মানুষ মনে হয়েছিল। বিমান থেকে নামার পর উনি বললেন,
অযু করে নিন। আমরা নামাজ পড়ব।
একজন অ্যারাবিয়ান ছেলে অজুর সময় আমার চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম।
হায় আল্লাহ! এরা কোন ধরনের মানুষ? এদের ভদ্রতা বলতে কিছু নেই? একজন অতিথির সঙ্গে এরকম অভদ্রতা করে! এ দেশে শিক্ষার এই অবস্থা! আমার সফর সঙ্গী ডাক্তার আমার দিকে চেয়ে আছে। আমাকে ইশারায় বোঝাতে চাইলেন এদেশের তরুণ ছেলেরা একটু দুষ্টু। আমি খুব সহজে বিষয়টি মেনে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি ওদের ভাষা না বোঝায় অনেকটা নিরুপায় ছিলাম। নামাজের পর আমরা যথারীতি কাউন্টারে চলে গেলাম। বিশাল মনিটরে দেখছি কোন ফ্লাইট কখন কোথায় যাবে।
রিয়াদ এয়ারপোর্ট থেকে আভা প্রদেশ এক ঘণ্টা পনের মিনিটের ফ্লাইট। ডাক্তার আমাকে অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলেন।
‘‘যেমন, খুব সহজেই কারো সঙ্গে রেগে যাবেন না। খুব সহজেই কাউকে আপন মনে করবেন না। কেউ কিছু খাওয়াতে চাইলে সহজেই খাবেন না। মানুষকে দেবেন বেশি নেবেন কম। এবং না বলাটা শিখতে হবে। অপরিচিত কারও সঙ্গে খুব বেশি আন্তরিকতা, অভদ্রতা দেখানোর প্রয়োজন নেই। এদেশের স্থানীয় ভাষা দ্রুত শেখার চেষ্টা করবেন। এ দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। অন্যায় করবেন না, সৎ থাকার চেষ্টা করবেন। প্রবাস জীবনটা আপনার ভালো কাটবে। তাছাড়া আপনি তো ভালো হাতের কাজ পারেন। আশা করছি আপনার তেমন কোন সমস্যা হবে না।’’
আভা বিমানবন্দর থেকে আমরা খামিছ মোশায়েত চলে এলাম। তারপরে এখানকার লোকাল বাজার থেকে উনি আমার জন্য আপেল, বেদানা, কলা, নাম না জানা বেশ কিছু ফল ফলাদি কিনে দিলেন। মোবাইল নাম্বারটা সেভ করে রাখলাম। যেহেতু আমার বাংলাদেশি সিম কার্ড ছিল। ওই দেশের কোন নাম্বার ছিল না। আমি উনার নাম্বারটা রেখে দিলাম। আমি ফোন নিয়ে আপনাকে কল দেবো। তারপর দীর্ঘদিন ডাক্তারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে যোগাযোগ হয়নি। বিভিন্ন সময় আলোচনা হতো, পরামর্শ দিতেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যে ডাক্তার আমার খুব ভালো একজন বন্ধু হয়ে গেলেন। বৃহস্পতিবার রাতে অফিস শেষ করে ডাক্তারের বাসায় চলে যেতাম। অ্যারাবিয়ান খাবার, রাত ভরে আড্ডা গল্প, ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে যেতাম, তারপর জুমার দিনে উঠে ব্রাশ করে নামাজ পড়তে চলে যেতাম। তারপর হোটেলের খাবার খেয়ে বিকেলে বাঙালি মার্কেটে গিয়ে বাঙালির ঝাল মুড়ি তারপর সন্ধ্যায় বিদায় নিয়ে চলে আসতাম। ডাক্তারের সঙ্গে একটা মিষ্টি সম্পর্ক ঠিক ভাইয়ের মতো।
নতুন কাজের পরিবেশে আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে মালিক পক্ষ আমাকে অন্য একটি জায়গায় নিয়ে গেল। সেখানকার ইকামা পাইনি বিধায় বাহিরে অনেক সময় পুলিশের ভয়ে বের হওয়া যেত না। পাসপোর্ট তখন আমার কাছে নেই, ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ ক্রমান্বয়ে কমে আসতে লাগল। আর যাওয়া হয়নি। ফোন দেবো দেবো করে অনেকদিন ফোন দেওয়া হয়নি। হঠাৎ করে একদিন ফোন দিলাম। অযাচিত একটি কণ্ঠস্বর! আমি একটু আঁতকে উঠলাম।
কে? ডাক্তার বলছিলেন?
আপনি কাকে চান?'
ওপাশ থেকে অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল। আমার মনের ভেতর সাতপাঁচ চিন্তা হতে লাগল।
ডাক্তার সাহেবকে চাচ্ছিলাম, এটা উনার নাম্বার না?
হ্যাঁ, এটা ডাক্তারের নাম্বার ছিল! উনি রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
‘ইয়া হাবিবি’ বলে পিছন থেকে একজন বেদুইন ডাক দিলো আমাকে। আমি চোখের জল মুছে দ্রুত তার নিকট গেলাম।
আমার মালিকের ছেলে মাঝেমধ্যে হাইলাক্স গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার আমার জন্য নিয়ে আসতো। গাড়ীর পিছনের সিটে বসা একজন বোরকা পরা সুন্দরী রমণী। চোখ দেখে মনে হচ্ছিল ফিলিপাইন অথবা ইন্দোনেশিয়ান। আমাকে খাবারগুলো দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মালিকের ছেলে গাড়ি নিয়ে আমার ওখান থেকে প্রস্থান করল। মেয়েটি হাতের ইশারা দিয়ে আমাকে কী যেন বুঝাতে চেয়েছিল। আমি কিছু বুঝে উঠবার আগেই গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
এখানে খামারের কাজ করছি অনেকদিন। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ধূ-ধূ মরুভূমি। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলে শুধু নীল আকাশ ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এর ভেতরেই বিনা তারে কথা হয় প্রিয় মানুষের সঙ্গে, কথা হয় মৌমিতার সঙ্গে। আমি বুঝতে পারি ও খেয়েছে কিনা, কি করছে; অনেক কিছুই কাকতালীয়ভাবে সবসময় মিলে যেত। আমাকে টিটকারি করে দৈবিক বলে ডাকত।
চলে আসবার দিন মৌমিতার হাত ধরে বলেছিলাম,
‘আমার আমানত তুমি এবং তা তোমার নিকট রেখে গেলাম, তাকে অবিশ্বাসের অনলে পুড়িয়ে নষ্ট করো না প্লিজ!’
চিঠির পর চিঠি দিয়েছি মৌমিতাকে, একটারও জবাব পাইনি।
‘চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়।’ কথাটি ধ্রুব সত্য। মৌমিতার প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ও অন্ধের মতো ভালোবাসা ছিল বোকামি। আমাকে সহজেই বিক্রি করে দিয়েছে বোকার আড়তে। আমি আর চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম না।
অতিরিক্ত স্বাধীনতার মূল্য মানুষ কীভাবে দেয়, তা আমি বুঝতে পারি এখন। মনে মনে ভেবে নিয়েছি, সে হয়তো এখন সুখের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
একদিন আমার কফিলের ছেলে এসে আমাকে বলল,
তোকে এখানে কাজ করতে হবে না। আমার সঙ্গে চল।
কিছুক্ষণ পর আমার লাগেজ নিয়ে বের হয়ে আসলাম। গাড়িতে বসে মারুর সঙ্গে আমার পরিচয়। মারু মালিকের বাড়ির হাউজ ওয়ার্কার। আমি মালিকের বাসার নিচের নতুন বাগালায় দোকানের কর্মচারী হিসাবে যোগদান করেছি। মারু মাঝেমধ্যে বাগালায় আসতো বিভিন্ন জিনিসপত্র নিতে। আমার চোখের দিকে চোখ পড়লে, মারুর মায়াময় চোখ হতে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত, যা আমাকে প্রচন্ড ভাবে ভাবিয়ে তুলতো। আমি ডিউটি শেষ করে, মারুকে নিয়ে ভাবতাম। মেয়েটি আমাকে দেখে কান্না করে কেন? মনে মনে ঠিক করলাম মারু আবার বাগালায় আসলে অনেক কথা বলব। মালিকের বউ বজ্জাত মহিলা, মারুকে প্রায়সময় বিভিন্ন কাজে আটকিয়ে রাখতো। ভোর হতে রাত দু’টা পর্যন্ত কাজ। ফজরের নামাজ পড়ে ছেলেমেয়ে মাদ্রাসায় যাবে; তাদের ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু, জামা কাপড় পরিষ্কার থেকে টয়লেট পরিষ্কার, কোন গাড়িতে যাবে সে ড্রাইভারকে ফোন করা, দুপুরে কী রান্না হবে তার বাজার লিস্ট করা, ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করা। তারপর ফিরে এসে দুপুরের রান্না করা। একই পর্ব চলে রাতের বেলা। সন্ধ্যায় মালিকের আত্মীয় স্বজন আসে। তাদের গাওয়া, বিভিন্ন পদের নাস্তা, বিভিন্ন দামি খাবার তৈরি করা। ঘরের মধ্যে চলে নাচানাচি, কেউ কেউ কুত্তার মত বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। জোর করে কেউ বুকে হাতও দিতে চায় মারুর। সেদিন বাগালায় মারুর সঙ্গে কথা বললাম,
হাবিবি ইন্তা মালুম?
ঈশ মালুম?
কফিল হায়ওয়ান, ওয়া ওয়লাদ হারামি কাবির।
লেশ?
লাহাম এমসিক, গুল মাফি মুশকিল। আনা মালুম হাদি হারাম?
মারুর সঙ্গে কথা বলে সব বুঝতে পারলাম। ওর সঙ্গে চলে যৌন নির্যাতন, শারীরিক অত্যাচার। নিরুপায় মারু কোনো প্রকার কথা বললে চলে বিভিন্ন হুমকি ধামকি। প্রবাস জীবন যারা কখনো পার করেনি, তারা কখনো বুঝবে না। সবকিছু মুখে বলে বুঝানো সম্ভব না। জ্বলন্ত নরকে সুখ খুঁজে মারু প্রতিনিয়ত।
খুব মিহি স্বরে আমাকে বলল,
ইন্তা হব্বোক আনা?’
আমি বোকার মত মারুর দিকে চেয়ে রইলাম। আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। স্মৃতিপটে ভেসে আসলো মৌমিতার ছলনাময়ী মুখ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা অনেক দূরের ব্যাপার এমনও হতে পারে মৌমিতা কখনো আমাকে মন থেকে ভালোই বাসেনি। তার কুটিল হৃদয় বুঝবে না সহজে। নিজের প্রতি আমার প্রচন্ড ঘৃণা হয়, এটা কোনো জীবন হলো? প্রবাসে কেমন একটা কুত্তার লাইফ কাটাচ্ছি; কাউকে কিছু বলতে চাইলে শুনতে চায় না। প্রথমেই বলবে কিছু টাকা ধার দে বন্ধু; ‘প্রবাসীদের সঙ্গে দেশের মানুষের সম্পর্ক শুধু একটাই, টাকার সম্পর্ক। তাছাড়া মনে হয় না কোনো সম্পর্ক আছে। বাড়ির পরিবেশ একই টাকা না দিলে বাবা দেখি মোবাইলে ফোন ধরায় কেমন যেন অলসতা দেখায়। সাত সতেরো মানুষের কাছে গল্প শুনি, মা আমার জন্য না খেয়ে থাকে, আমার পছন্দের আমসত্ত, আমি বিদেশ আসার পর মা মুখে দেয়নি। এরকম অনেক প্রিয় জিনিস মা না খেয়ে থাকে। শুধু এই মানুষটার সঙ্গে কখনো সম্পর্ক খারাপ হয় না আমার। মায়ের চাঁদের মতো মুখখানি ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
দৃষ্টি ফিরে তাকাতেই দেখি মারু আমার চোখের আড়াল হয়ে গেছে।
আবু সাদ আমার পুরনো কাস্টমার। তবে ইদানীং খেয়াল করলাম আমার দিকে তার অন্য রকম চাহিদা। আমি প্রচ- লজ্জা পেলাম! মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
আবু সাদ, আনা মুসলিম।
মালে, ইয়া রেজ্জাল।
মুখ মলিন করে বাগালা থেকে প্রস্থান করল।
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। আবু সাদ বিচ্ছিরি টাইপের মানুষ। তার কথা শুনে আমার বমি আসে।
একজনকে টাকা পাঠিয়েছি অনেকদিন হলো। ফোন দিয়েছি কয়েকবার, এখন ফোন ধরছে না। টাকা পেয়েছে কি-না তাও তো বলতে পারছি না। বাড়িতে বাবা আমার উপর মনে হয় রাগ করে আছে। প্রবাস জীবনে এসে না কাউকে সুখী করতে পারলাম, না কারো মন ভরাতে পারলাম।
আপন লোকজন সবসময় অভিযোগ দিয়েই গেল শুধু। কারো মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম না। তার বিশেষ কারণ হলো মানুষ যা চায় আমি তাদের মনের মতো কিছুই দিতে পারছি না। আমি এখন সবার কাছে অপ্রিয়। প্রতিদিন রাতে মায়ের ছবিখানা বুকে ধরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি বেমালুম তা ভুলে যাই। এ পৃথিবীতে মা ছাড়া কেউ নিঃস্বার্থ ভালবাসতে পারে না। মৌমিতা প্রায়ই স্বপ্নে আসে চুপিচুপি কথা কয়, আমারে জড়িয়ে ধরে। আমি ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে উঠি। রুমের লোকজন মনে করে আমার জিন অথবা পরীতে আছর করছে; পানি পড়া খাওয়ায়, দোআ দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয়। তারপরও কোনো কোনো রাতে মৌমিতার সঙ্গে কথা বলে চিৎকার করে উঠি।
গ্রাফিক্স : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ্মারু প্রতিদিন আমার খবর নেয়, বিশেষ দিনে আমাকে আগে থেকে জানিয়ে দেয়। আজ মার্কেটে যাবে অথবা ব্যাংকে যাবে। আমি যেন তার সঙ্গে যে করেই হোক দেখা করি। ঠিক প্রেমে পড়া নয়। এক ধরণের ভালোলাগা, অথবা খুব ভালো বন্ধুত্বের জের ধরেই আমি এগিয়ে যাই, মারু আমাকে তার সম্পর্কে সবকিছু বলে। আমার তার প্রতি বিশেষ কোনো দুর্বলতা ছিল না। একটা সময় আমরা খুব ভালো বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু মারু কখনো আমাকে বন্ধু মনে করেনি। মারু সত্যিকার অর্থে আমাকে প্রচ- ভালোবাসে বিয়ে করতে চাইত। তার বেতনের একটা অংশ আমাকে জমা রাখতে বলতো। আমার সঙ্গে এ নিয়ে অনেকবার মনোমালিন্য হয়েছে ।
একটা সময় মারু আমাকে চাপ দিতে থাকে তাকে নিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে।
ছয় মাস পরে!
মারু তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা পেটের বাচ্চা মারুর কফিলের না-কি তার ছেলের, এমন কঠিন প্রশ্ন সামনে এসেছিল মারুর। সে বাড়িতে মারু ছিল হাউজওর্য়াকার, শুধু তাই নয়; ছিল যৌনদাসী। অঢেল প্রাচুর্যের অহংকারে বাবা সস্তান মিলে অমানবিক, হৃদয়হীন বিবেকবোধ কাজ করেছে দিনের পর দিন। এখানে গরিব মানুষের জন্য কোনো বিচার নেই। নিরুপায় কোনো মানুষের কথা পুলিশ বিশ্বাসও করে না। বিবেকবোধ কখনো তারা করেনি অমানুষদের। নিরুপায় মারুকে তখন সাত পাঁচ বুঝিয়ে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
ওকে জানিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
চিন্তা করো না মারু, তোমার অনাগত সন্তানের পিতা আমি হব। আমি তোমাকে সারা জীবনের জন্য প্রেমের সুতোয় বেঁধে রাখতে চাই। সে কথাটি বলা হয়নি, তার আগেই আমি কারাবাস ভোগ করি, সুদূর প্রবাসে কফিলের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে। ঊনচল্লিশ দিন পর আমি দেশে চলে আসি, সঙ্গে কিছুই নিয়ে আসতে পারিনি। বিমানের ভিতরে মানুষের কাছে হাত পেতে দশ রিয়াল বিশ রিয়াল দিয়েছে, তা দিয়েই বাড়ির মানুষের জন্য কিছু কিনেছি, এতদিন বিদেশ থাকার পরে খালি হাতে বাড়ি গেলে মানুষ কী বলবে।
অলৌকিক ভাবে মৌমিতা আমাকে এয়ারপোর্ট রিসিভ করতে এসেছে, আমি নিজেই জানতাম না আজ আমি দেশে আসব। মৌমিতাকে দেখে পুলকিত হলাম। আমি কোনোভাবেই মিলাতে পারছি না কীভাবে মৌমিতা জানল, আমি আজ দেশে আসব। কেমন করে সে আজ এয়ারপোর্টের গেটে আমার অপেক্ষায়! কুটিল পরিবেশে মানুষ হয়েছে মৌমিতা, নিরুপায় হয়েই আমার থেকে দূরে ছিল। বিচ্ছেদের বেদনায় নীল পাথররূপে জন্ম হতো আমার হৃদয়ে তবুও তার গভীর আনাগোনা ছিল আমার হৃদয়ে, চোখ ভিজে উঠত সোনালি স্বপ্নে। আজ মারুকে খুব মনে পড়ছে, মারুকে আমি প্রথম দিকে নীলাঞ্জনা বলে ডাকতাম। বেচারি নিরুপায় ছিল সত্যি।
‘‘প্রবাসে সব মেয়েরা নিরাপদে থাকে না, সবাই থাকতেও পারে না। প্রবাসে কেউ কেউ থাকে নীলাঞ্জনার মত নিরুপায়।’’
মৌমিতার হাতে ফুল থাকার কথা, এতদিন পর আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে এসেছে; গায়ে কী বিচ্ছিরি গন্ধ! এমন লাগছে কেন?' আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে,
স্যার পাঁচটা টাকা দিন।
আমি অবাক! অপলক দৃষ্টিতে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আমি কিছুই মিলাতে পারছি না। মৃদু কন্ঠে বললাম,
আমি তোমার পারভেজ, আমাকে চিনতে পারছো না?
আমার অশ্রু সিক্ত দুচোখের জল ছিল দু’রকম। মৌমিতার টাইফয়েড জ্বর হয়েছিল, গ্রাম্য এক ডাক্তারের কাছ থেকে ভুল চিকিৎসায় এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে দৃষ্টি শক্তি ও কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে । নরম তুলতুলে হাত দিয়ে আমার মুখ ছুঁয়ে দেখছে অবুঝ বালিকার মত। অনাশ্রয় পরিবার কোথায়ও বিয়ে দিতে পারেনি। পাশের বাড়ির মানুষের দৃষ্টি ছিল মৌমিতার শরীরের দিকে। নিজেকে বাঁচাতেই একদিন রাতে পালিয়ে শহরে চলে আসে। মানুষ আসলে জীবন থেকে পালিয়ে ভালো থাকতে পারে না। জীবনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে বেঁচে থাকার নামই বেঁচে থাকা।