সাবিনা পারভীন লীনা
সত্য দেখার কথক
মাহমুদ নোমান
বইয়ের নাম ‘সম্পর্ক’ শুনে যে কেউ নিজেতে দাঁড়িয়ে ভাবতে বাধ্য; কতো ভাব গতি প্যাঁচ পোঁচ আর মোচড়- তবুও কী ‘সম্পর্ক’ ব্যাপারটি বুঝাতে সক্ষম! সম্পর্ক শব্দটি চোখের সামনে এলে ভাবি চোখের দেখায় শেষ না-হওয়া একটা সাঁকো, হাত ধরাধরি করে পার হচ্ছে...সত্যি কী সাঁকো, সাঁকো তো দৃশ্যমান আর সম্পর্ক কেউ দেখাতে পারে? সম্পর্ক ব্যাপারটিতো বুঝানো যায় না। ‘সম্পর্ক’ আত্মস্থ করার, উপলব্ধি করার, একটা টানের, একটা গায়েবি রেখার...
সাবিনা পারভীন লীনা কবিতা লিখতো জানতাম, ‘দেয়াঙ' পত্রিকাতেও কবিতা ছেপেছি ; কবিতার বই পড়ার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু বই হিসেবে পড়েছি গল্পের! কেন জানি মনে হয় গল্প লিখতে সৎ সাহসের প্রয়োজন। চরিত্রকে কথা বলাতে গিয়ে অনেক কথা নিজের আবার যদি ধরে নিই- একেবারে বানানো গল্প, সেখানেও নিজের মতামত ভাব-বোধের পুরোপুরি দাবি থাকেই; এখানে এসে একজন নারী গল্প লেখিকা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজের মতামতকে দাঁড় করিয়ে গল্প যখন লিখে সেটি বেশ শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠে। আমি এই কথা বিশ্বাস করি- একজন নারীর জীবনটা বলা আর না-বলা অনেক গল্পের স্তুপ; সাবিনা পারভীন লীনার গল্প পড়ে মনে হয়েছে এই স্তুপ তিনি রাখেননি সচেতনে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করার অভিযানে ফলিয়েছেন নিজের ভাব বোধের চমৎকার ফুল, তেমন সুবাসিত করার প্রয়াস না থাকলেও সৌন্দর্যে আকর্ষণ করে সত্যি...
সাবিনা পারভীন লীনার গল্প পরিশীলিত বোধের চমৎকার মঞ্চায়নে ভাষার দ্বিধা পাবেন না, চরিত্রের প্রয়োজনে চরিত্র এখানে কথা বলে ভাব-গাম্ভীর্যে;
‘সম্পর্ক’ বইটি গল্পকারের প্রথম গল্পের বই হলেও কথক বা লেখক তো আজকের নয়; অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে অনেক দিনের পুঞ্জীভূত পাথর সরানোর মতো এই বইয়ের ভাষ্য... এই বইয়ে মোট ৮ টি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে, প্রতিটি গল্পের মুহূর্ত একেকরকম পরিস্থিতি তৈরি করে, মিহি সুতোয় গাঁথা গল্পমালা যেন;
সাবিনা পারভীন লীনার গল্পের বয়ন মেদহীন, সোজাসাপ্টা এবং পরিমার্জিত মনে হবে। ডায়ালগ ডেলিভারিতে সরাসরি হানে, তবে এক্ষেত্রে কিছু কথা বলতে হয় - কিছু মেদ সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয় বরঞ্চ যথাযথ গড়ে তোলে; অতিরিক্ত ব্যাপারটি কেবল সৌন্দর্য বিনষ্ট করে অর্থাৎ সাবিনা পারভীন লীনা গল্পকে বিভিন্ন মতে-পথে অতো যাচাই করতে চায় না, যা দেখেছে সেটি বলতে পারদর্শী অথচ দেখক- কথক এরপরে লেখকের একটা ভূমিকা থেকেই যায়; সাবিনা পারভীন লীনার গল্পের বই ‘সম্পর্ক’ পড়ে দীলতাজ রহমানের গল্পের কথা মনে এলো, যেভাবে দীলতাজ রহমান নিজের বক্তব্যকে অর্থপূর্ণ করে চরিত্রকে পুরোপুরি প্রাধান্য দিয়ে সেটি পথ দেখাবে... এরকম সাহসের বড়ই অভাব, এটির দায় সমাজ-রাষ্ট্রকে দেওয়া জরুরি মনে করি না, আমি এটুকু বলি - কোন সমাজ -রাষ্ট্র অর্থাৎ এসবের হর্তাকর্তারা কখনও একজন লেখককে লিখতে বলে? বরঞ্চ লেখককে তাঁর ভাবনায় হস্তক্ষেপ করেনি দেখাতে পারবেন?? যদি নারী হয় তাহলে আরো চাপাচাপি, এসবেও সাবিনা পারভীন লীনার গল্প পাঠককে ভাবায়- মনোযোগ কাড়তে সক্ষম, ভবিষ্যতে আরো ভাবাবে আশা করি...
এই গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটির নাম- ‘একটা ফ্যান্টাসি গল্পের খোঁজে’, এই গল্পটির সারমর্ম হলো- আমরা যে যান্ত্রিক যুগে, মান অভিমান মিইয়ে যাওয়ার সময়ে যেকোনো ঘটনাকে শুনতে/জানতে গিয়ে বর্ণনার মধ্যে ফ্যান্টাসি খুঁজি মানে ভেতরে সমস্যাটাকে আড়াল করার জন্য একটা ফ্যান্টাসির পর্দা বা দেয়াল তৈরি করে দিই অর্থাৎ সত্য ঘটনা ক’জন জানতে পারে?? - এই প্রশ্ন এবং উত্তর এই গল্পে, সরাসরি বললে এখনকার এই দেশের অস্থিরতার খন্ডচিত্রের সফল রূপায়ণ....
০২.
এই গল্পগ্রন্থে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে সাম্প্রতিক সময় নানানভাবে তুলে ধরা। এমনকি করোনার অস্থিরতা, দুঃসহ স্মৃতির আবহ এই গল্পগ্রন্থের পরতে পরতে; এই বইয়ের নামগল্প ‘সম্পর্ক’- এখনকার সময়ের শহুরে শিক্ষিত দম্পতির সাংসারিক নানান টানাপোড়েন পাঠকের চোখের সামনে এমনভাবে তুলে ধরেছেন যেন সুনির্মিত চলচ্চিত্র-
‘তোমার কাছে কি আমাদের ক্লোজড ছবি আছে ফেইসবুকে পোস্ট দেয়ার জন্য? অনেকদিন কোনো পোস্ট দেওয়া হয় না’ এটুকু লিখে মনোয়ার বাথরুমে ঢোকে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখে এখনও সানজিদা রেসপন্স করেনি। মনোয়ার সানজিদাকে কল করা ঠিক হবে কিনা ভাবে। ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ে। মানুষের সম্পর্কগুলো কেমন অদ্ভুত! একটা সময় ছিল কল করার জন্য সময়- অসময় ছিল না, আর এখন কল করা যাবে কিনা এ নিয়ে দ্বিধা কাটে না।
- সম্পর্ক; ১৭ পৃ.)
গল্পের নায়ক নায়িকার বিয়েটা কিন্তু প্রেমঘটিত অথচ কয়েক বছর যেতেই সম্পর্ক কেমন পাল্টে যায়! তিক্ততা নিয়েও কেমন সুখের অভিনয় করে চলতে হয়, এটি বোধহয় বেশিরভাগ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত দম্পতির সংসারের বাস্তব চিত্র...
‘সম্পর্ক’ গল্পগ্রন্থটি মানুষের সাথে মানুষের নানাবিধ সম্পর্কে টানাপোড়েন, ভালো কিংবা খারাপ লাগার সূক্ষ্ণ অনুভূতির ব্যাপারগুলো স্মার্ট শব্দে মৃদুস্বরে বলেছেন। ‘চেনা অন্ধকার’ গল্পে যেমন এক বৃদ্ধার জবানবন্দি-
‘হোসনে আরার সময় কাটে এখন জায়নামাজে। কখনও কুরআন শরিফের সামনে, কখনও তসবি হাতে। শরীর আর আগের মতো নেই, এ কয়দিনে আরও কুঁজো হয়ে গেছে। সারাক্ষণ বিছানাতেই থাকে। ভাবে, খাট থেকে নিচে নামলেই ময়লা লেগে যাবে। নিজের ছেলেমেয়ে কাউকে বিছানায় বসতে দেয় না, শুধু সুমনা বসতে পারে। ধুলোবালি না ঢোকার জন্য দরজা জানালা বন্ধ করে রাখে সারাদিন। তার ঘরে আলোর চেয়ে অন্ধকারের দাপট যেন বেশি
- ৩৫পৃ.)
তেমনি ‘দ্বিতীয় জন্ম’ গল্পে প্রেমিক- প্রেমিকার নির্ভেজাল আকুতিভরা টলটলে জলে আবাহনের দলিল-
‘ভাইব্রেশনের গোঙানি বন্ধ করতে বালিশের পাশে হাতড়াতে হাতড়াতে শেষ পর্যন্ত মাথা তুলে বসে মীরা। মিনহাজ পাশে নেই, সানাইও বাজছে না। ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে শোঁ শোঁ করে। পর্দার ফাঁক গলে আসা হালকা আলোয় মেয়ের মুখটা দেখে ভীষণ কান্না আসে। ভালোবাসার সঙ্গে কান্নার একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে। ধ্বনি দিলে যেমন প্রতিধ্বনি হয়, ভালোবাসলে কাঁদতে হয়।
- ২৯ পৃ.)
এছাড়া এই বইয়ের প্রতিটি গল্পে সাবিনা পারভীন লীনার সৃষ্ট মুহূর্তগুলো কল্পনাপ্রসূত নয় শুধু, গল্পকারের আশপাশে দৃশ্যাবলী, প্রেমের আবহে সাবলীলভাবে বেশ জটিল সব ভাব-বোধের মীমাংসা দিয়েছেন; তবুও কী যেন বাকী রয়ে গেলো, ঝেড়ে নিজেকে হয়তো লিখবে, এক দাপুটে গল্পকার পাবো অচিরে এই প্রত্যাশা করতেই পারি...
ভালো আলোচনা। সাবিনা পারভীন লীনা’র বইটা পড়ার আগ্রহ তৈরি করে।
Reply