পঞ্চবরের জীবন
মূল: মার্ক টোয়েইন
অনুবাদ : রেজা কারিম
১.
জীবন প্রভাতে এক স্বর্গীয় পরী এলো এক যুবকের কাছে। মাত্রই তার প্রাণবন্ত যৌবন শুরু হয়েছে। স্বর্গীয় পরীর কাছে একটা ঝুড়ি ছিল। পরী যুবককে বললো, তোমার জন্য এখানে পাঁচটি উপহার রয়েছে। এদের মধ্যে যে কোনো একটিই তুমি বেছে নিতে পারো। আর হ্যাঁ সাবধান! ভেবে চিন্তে পছন্দ কর। খুব ভালো করে ভাবো। মনে রেখো, এদের মধ্যে কেবল একটিই মূল্যবান।
উপহারগুলো হলো- খ্যাতি, ভালোবাসা, সম্পদ, আনন্দ ও মৃত্যু।
যুবক অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বললো, এত ভাবার কিছু নেই। সে আনন্দকে প্রাধান্য দিলো ও আনন্দকেই বেছে নিলো।
সে পৃথিবীর মাঝে ডুব দিলো। আনন্দ আর আনন্দ তালাশ করে চললো। প্রচুর আনন্দে সে নিজেকে জড়িয়ে নিলো। দুনিয়ার চাকচিক্যের মাঝে সে নিজেকে আমোদে ভাসালো।
কিন্তু প্রত্যেকবার সে হতাশ হলো। এগুলো ছিলো স্বল্প সময়ের জন্য ও অত্যন্ত হতাশাজনক। অন্তঃসারশূন্য ও নিরস। এসব আনন্দ তাকে ছেড়ে চলে যায় ও তাকে উপহাস করে। শেষে সে একদিন বলে, আমি জীবনের বহু বছর অপচয় করেছি। যদি আমি আবার উপহার বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতাম তবে বুদ্ধি খাটিয়ে বাছাই করতাম।
২.
স্বর্গীয় পরী আবার আসে। সে বলে,
চারটি উপহার বাকি আছে। যে কোনো একটি বেছে নাও। আর হ্যাঁ, মনে রেখো- সময় বয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেবল একটিই মূল্যবান।
লোকটি দীর্ঘক্ষণ ভাবে। তারপর ভালোবাসাকে বেছে নেয়। এদিকে পরীর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু লোকটির নজরে তা পড়েনি।
অনেক অনেক বছর পরে, লোকটিকে দেখা যায় একটি শূন্য ঘরে। একটি খাটিয়ার পাশে বসে আছে। সে নিজের সাথে কথা বলছে। রীতিমতো বিলাপ করছে।
‘একে একে সবাই আমাকে ছেড়ে গেছে। এখন আমার প্রিয়তমাও আমাকে ছেড়ে গেলো। আমার ভালোবাসার মানুষ। সে আজ চিরতরে ঘুমিয়ে গেলো। সে ছিলো আমার শেষ ভালোবাসা। একের পর এক প্রিয় মানুষের বিয়োগ ব্যাথায় আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। জনশূন্যতার পর জনশূন্যতা যেন ভাঁটার মতো করে আমার সব নিয়ে গেছে। সুখের প্রতিটি মূহুর্ত যেন বিশ্বাসঘাতক বণিক। একটু ভালোবাসার বিনিময়ে আমি হাজারো দুঃখের মূহুর্ত ক্রয় করেছি। ভালোবাসা আমাকেই বিক্রি করে দিয়েছে। আমার হৃদয়ের কোথাও এমনকি হৃদয়ের বাইরেও ভালোবাসার আর কোনো জায়গা নেই। আমি একে অভিশাপ দেই।
৩.
আবারো স্বর্গীয় পরীর আগমন। পরী বললো, ‘পুনরায় বেছে নাও। বিগত বছরগুলো তোমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। এমনটাই হওয়ার ছিল যেমনটা তুমি বেছে নিয়েছিলে।’
পরী পুনরায় বলে,
‘আরো তিনটি উপহার বাকি আছে। এদের মধ্যে একটিই কেবল মূল্যবান। মনে রেখো এটা। আর হ্যাঁ, খুব সতর্কতার সাথে পছন্দ করো।’
লোকটি দীর্ঘক্ষণ ভাবলো। তারপর খ্যাতিকে বেছে নিলো। এটা দেখে স্বর্গীয় পরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর নিজের পথ ধরলো।
অনেক বছর পর। স্বর্গীয় পরী আবার এলো। দিনের শেষে ম্লান আলোয় লোকটি একাকি বসে আছে। ভাবনায় ডুবে আছে সে। পরী তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সে জানে লোকটি কী ভাবছে। তার ভাবনাটা ছিল এমন;
সারাবিশ্বে আমার সুনাম ছড়িয়ে গেছে। সবার মুখে মুখে আমার নামের জয়গান। কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্যই আমার এ সুনাম অব্যাহত ছিল। আর এ সময়টা কতই না দ্রুত ফুরিয়ে গেলো। তারপর আমার জীবনে একে একে কত কিছুই না এল। হিংসা, নিন্দা, অপবাদ, ঘৃণা এমনকি নিগ্রহ। আর শেষের শুরুটা ছিল উপহাসে ভরপুর। সবার শেষে এলো সমবেদনা। যা আমার খ্যাতির দাফন। আহ, খ্যাতির কী তিক্ততা! কী দুঃখ!
৪.
আবারো স্বর্গীয় পরীর কন্ঠ শোনা গেলো। ‘আবার একটা বেছে নাও। দুটো উপহারের একটা বেছে নিতে হবে। হতাশ হয়ো না। মূল্যবান উপহারটা শুরু থেকে এখন অব্দি রয়ে গেছে।’
লোকটি কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর সম্পদকে বেছে নিলো। সে বললো, ‘এটা নিঃসন্দেহে সম্পদ। কারণ সম্পদই শক্তি। সম্পদই ক্ষমতা। এতদিন আমি কতই না অন্ধ ছিলাম। এখন জীবন হবে গতিশীল। প্রাচুর্যময়। এখন আমি প্রচুর ব্যয় করবো। টাকা ওড়াবো। মানুষকে বিমোহিত করবো। এসব ব্যঙ্গকারী, উপহাসকারী আমার সামনে মাটিতে হামাগুড়ি দেবে। আর আমি তাদের হিংসা দিয়ে আমার ক্ষুধার্ত হৃদয়ের ক্ষুধা মেটাবো। পৃথিবীর সব বিলাসিতা আমার। মনের আনন্দ, আত্মার বিনোদন ও শরীরের জন্য উপভোগ্য সবই আমার থাকবে যা মানুষের পক্ষে সম্ভব। আমি শুধু কিনবো আর কিনবো। আমি মানুষকে আমার বশ্যতা স্বীকার করাবো। সম্মান, মর্যাদা, আরাধনা এমনকি জীবনের ছোট বড় নগন্য প্রশংসাটুকুও কিনে নেবো। আমার জীবনের সবকিছুই নতুন করে সাজাবো আমি। আমি আমার জীবনের প্রচুর সময় হারিয়ে ফেলেছি। ইতপূর্বে আমি ভুল কিছু পছন্দ করেছিলাম কিন্তু সে সবই এখন যন্ত্রণাদায়ক অতীত। আমি অজ্ঞ ছিলাম। তাই আমার অনভিজ্ঞতার কারণে সঠিক জিনিস বেছে নিতে পারিনি।’
তিন বছর কেটে গেলো। একদিন লোকটাকে একটা জরাজীর্ণ চিলেকোঠায় বসে থাকতে দেখা যায়। সে প্রচন্ড কাঁপছিলো। সে ছিল রোগাটে, বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে চোখের অধিকারী। পরনে ছেঁড়া পোশাক। সে শুকনো খড়ি চিবাচ্ছিলো আর মিনমিন করে কিছু বলছিলো।
‘পৃথিবীর সব উপহারকে অভিশাপ দিচ্ছি। কারণ এরা উপহাস। চাকচিক্যময় মিথ্যা দিয়ে মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। এরা মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যায়। এরা কোনোভাবেই উপহার নয় বরং অভিশাপ। এরা মারাত্মক ঋণ। আনন্দ, ভালোবাসা, খ্যাতি, ধন-সম্পদ সাময়িক সময়ের জন্য ছদ্মবেশে আসে। কিন্তু এরা দীর্ঘ বাস্তবতা রেখে যায়। তা হলো- দুঃখ, দুর্দশা, অপমান ও দারিদ্র্য। স্বর্গীয় পরী সত্যই বলেছিলো; তার পাঁচটি উপহারের একটাই ছিলো মূল্যবান। কেবলই একটা যা কখনোই মূল্যহীন নয়। কতই না সস্তা ও মূল্যহীন ছিলো যেগুলো আমি পছন্দ করেছিলাম। আমি এখন তাদের সবগুলো জানি। আর সেই মূল্যবান একটার সাথে সবগুলোর তুলনা করতে পারি। সেই একটা উপহারই মূল্যবান উপহার। এটা এমন এক উপহার, যা দুনিয়াবি বস্তুর প্রতি স্বপ্নহীনতা এনে দেয়। এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী ঘুম। এটা এমন বেদনা যা শরীরকে যন্ত্রণা দেয়। এটা এমন লজ্জা যা অন্তরকে কুপ্রবৃত্তির জন্য লজ্জিত করে। এটা এমন দুঃখ যা হৃদয়কে শূন্য করে দেয়। আমার ওটাই চাই। আমি খুব ক্লান্ত। আমি বিশ্রাম নিতে চাই।’
৫.
স্বর্গীয় পরী আবারো সেই চারটি উপহার নিয়ে আগমন করে। কিন্তু এবার কেবল মৃত্যুই অবশিষ্ট আছে। স্বর্গীয় পরী বললো,
‘আমি এটা এক মায়ের ছোট্ট শিশুকে দিয়েছিলাম। যে তখনো কোলের শিশু। শিশুটি ছিলো এ ব্যাপারে অজ্ঞ কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করেছিলো। সে এটা আমার কাছ থেকে পছন্দ করেছিলো। কিন্তু তুমি এটা বেছে নেওয়ার জন্য আমাকে জিজ্ঞেস করোনি।’
লোকটি বললো, ‘হুম! আমার পোড়া কপাল। আর কী আছে আমার জন্য?’
স্বর্গীয় পরী উত্তরে বললো, ‘যা তুমি কখনোই প্রত্যাশা করোনি। শেষ জীবনের ভোগান্তি।’
(উপরোক্ত গল্পটি আমেরিকার বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়েইনের ঞযব ঋরাব ইড়ড়হং ড়ভ খরভব নামক ছোটগল্পের অনুবাদ। মার্ক টোয়েইনের আসল নাম স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স। অবশ্য তিনি মার্ক টোয়েইন ছদ্ম নামেই বেশি পরিচিত। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ নভেম্বর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে জন্মগ্রহণ করেন। ৭৪ বছর বয়সে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেডিংয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তার জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম হচ্ছে ‘অ্যাডভেঞ্চারস অব টম সয়্যার’ ও ‘অ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবেরি ফিন’। এই উপন্যাসদ্বয় বিশ্বসাহিত্যে ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করে। তিনি প্রচুর গল্প লিখেছেন। টোয়েইনকে তার সময়ের শ্রেষ্ঠ রম্যকার হিসেবে অভিহিত করা হয়। উইলিয়াম ফকনার টোয়েইনকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘আমেরিকান সাহিত্যের জনক’ হিসেবে।)
৪১১/এ, খিলগাঁও, ঢাকা -১২১৯