ক্লেদজ কুসুম

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


ক্লেদজ কুসুম

আবদুল্লাহ আল-হারুন


দু সপ্তাহ আগে বিকেল পাঁচটায় পাশের শহরে হজপিসের একটি আঞ্চলিক সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল। আমি যখন (১৯৯৭) হজপিসের কর্মী হিসেবে এ সংগঠনে যোগদান করি সে সময় সদস্য-সদস্যাদের গড় বয়েস ছিল পয়ষট্ট্রি কাছকাছি! যে গ্রুপে আমি প্রশিক্ষন নেই সেখানে আমিই ছিলা সে সময় সর্বকনিষ্ঠ (৫২)। কর্মীদের মধ্যে মহিলাই ছিলেন শতকরা ৯০/৯৫ জন! বিধবা, নি:সঙ্গ বা স্বামীর সাথে বিচ্ছিন্ন প্রৌঢ়া-বৃদ্ধারা মৃত্যুসঙ্গ দিয়ে হয়ত নিজেদের একাকি জীবনে কিছু কর্মচাঞ্চল্য বোধ করতেন। ইউরোপে রিটায়ার করার পর বয়স্ক-প্র্রজন্মটি সমাজের মূল স্রোত থেকে সরে যান বা সরে যেতে বাধ্য হন। এখানে জীবনের মূলমন্ত্র, ’গাহি যৌবনের গান’! যে কাজ করে না বা পেনশনের টাকায় অবসর জীবন যাপন করে, তাদের দিকে বাঁকা চোখে চেয়ে যারা এখনও কাজ করছে, তারা ইংগিত করে, ’তোমরা তো পরগাছার দল’। কথাটা কিছুটা সত্যি। তাদের পেনশন টাকা যারা এখন কাজ করছেন তাদের বেতনের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ’পেনশন-বীমার’ টাকা থেকেই আসে। এটাই জার্মানির গত শতাব্দীর বিসমার্ক কৃত বিখ্যাত ’প্রজন্ম-চুক্তি’ (এবহবৎধঃরড়হ- ঠবৎঃৎধম)। যার অধীনে বর্তমান কর্মরত প্রজন্ম, গত প্রজন্মের অবসর জীবন যাপন নিশ্চিত করে। এক সময় এরাও পরের প্রজন্মের বাঁকা চোখের শিকার হবে। এটাই নিয়ম। ঢিলটি মারিলে পাটকেলটি----, জেনেও কেউ গা করে না!

পেনশনভোগীদের মধ্যে যারা সুস্থ বা কর্মক্ষম (এদের সংখ্যা মোটেও কম না), তারা হজপিস বা এ ধরনের অনেক সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশগ্রহন করে, সমাজে যে এখনও তারা ’প্রয়োজনীয়, পরগাছা নন’, তা প্রমান করেন। এ শতকে হজপিসে বেশ কিছু তরুন তরুনীও এসেছে। মৃত্যু সম্পর্কে ধ্যানধারনা দিন দিন বদলে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আলাপ আলোচনা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, টিভি ডকুমেন্টারী (এমন কি ছবিও) হচ্ছে। বলা যায়, মৃত্যু-প্রসঙ্গ এখন ইউরাপে ’সযতনে এড়িয়ে যাবার সনাতন ধারাটির’ টাবু উত্তীর্ণ  

হয়েছে। মৃত্যু নিয়ে টিভি রেডিওতে নিয়মিত টক শোও হচ্ছে। 

আলোচনা শেষ হতে রাত আটটা হয়ে গেল। শনিবারের সন্ধ্যা। তিন-চারজন তরুন-তরুনী সভাভঙ্গের পরেই

তড়িঘড়ি উঠে গেল। আজ সর্বত্র ডিস্কো নাইট। ভাবখানা, মৃত্যু নিয়ে তো অনেক ভাবনা হলো, এবারে জীবনভোগের পালা! প্রবীন-প্রবীনারা কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে যুত করে বসে গল্পগুজবে মেতে উঠলেন। আমিও তো এখন তাদেরই দলে। বাড়ীতে তো আর কেউ দরজার দিকে তাকিয়ে নেই। নিরম্বু একা বসবাস!

আমিও সবার সাথে গলাবাজি করে তাবত বিশ্বের সমস্যা সমাধানে লেগে গেলাম। 

রাত দশটা বাজার পর খেয়াল হল, সপ্তাহান্তে বাসের সংখ্যা রাতে কমে যায়। ছোট্ট শফস্বল শহর। কে জানে এখন বাস পাই কিনা। তা নাহলে ঝাড়া দশ কিলোমিটার হাটতে হবে! অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে পড়লাম। 

কয়েক মিনিট হাটার পরই বাস স্ট্যান্ড। বাসের টাইটেবল একটি লোহার থামে দৃষ্টি সীমায় টানানো থাকে। 

দুর থেকেই নজরে এল বিদ্যুতালোকে উদ্ভাসিত বাস স্টপে থামটিতে গা লাগিয়ে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নভেম্বরের রাত। হেমন্ত শেষ, শীত এলো বলে। সকালে-সন্ধ্যায় কুয়াসায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে থাকে।

ও কেন থামটির সাথে গা সেঁটে দাঁড়িয়ে আছে, তা বুঝতে পরলাম। গায়ে একটা পাতলা জ্যাকেট, যা দিয়ে এখনকার শৈত্যটি ঠেকানো সম্ভব না। থামের উপরেই শেড এবং এর সাথেই একটা ছোট হিটার ফিট করা। মিউনিসিপালিটি থেকে অপেক্ষারত রাতের বাসযাত্রীদের ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা। মেয়েটি তার স্বল্প কাপড়ের ঘাটতিটি হিটারে পুরন করার জন্য থামটিতে গা ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে। বেঞ্চে বসে নেই। ওটি হিটার থেকে একটু দুরে। আমার গায়ে মোটা জ্যাকেট। ঠান্ডার বিরুদ্ধে ভালো ব্যবস্থা করেই ঘর থেকে বেরিয়েছি। 

আমি থামের কাছে গিয়ে বললাম, সরে দাঁড়াও প্লিজ, বাসের সময় দেখবো। এখানে শিশু, কিশোর- কিশোরীদের বয়স্করা প্রথম থেকেই তুমি করে বলে। যা আবার পচিয় নেই এমন তরুন-তরুনীদের বা অন্য বয়স্কদের বলাটা সখ্ত বেয়াদবী। এর বয়েস কোনমতেই ১৪/১৫র বেশী না। মেয়েটি আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, কোথায় যাবে তুমি? সেও বিনা দ্বিধায় আমাকে তুমি বলল। আমি বেশ আশ্চর্যই হলাম। ওর বয়সী কেউ আমাকে প্রথমে তুমি বলে না। শুধুমাত্র শিশুরাই এ নিয়ম মানে না। কিন্ত ওতো শিশু নয়। বুঝলাম কিছু গড়বড় আছে। এ বািলকার ব্যবহারটি আর দশজনের মত নয়। আমি আমার শহরের নাম নিতেই ও বলল, এখনও চল্লিশ মিনিট আছে বাসের। আমিও ওদিকেই যাবো। তার কথায় স্পষ্ট ইংগিত, ’আমার থাম থেকে সরার দরকার নেই। তোমার এখানে যা জানার, তাতো জেনেই গেলে।’

এবারে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু শিউরে উঠলাম। চোখে মুখে প্রসাধনের যে চিহ্ন ততে কোন যতœ নেই। মনে হয় সব লেপ্টে আছে। বেশ লম্বা চুল। রং বোঝা যায় না। কবে যে শেষ কেশচর্চা করেছিল, তা বলার কোনই উপায় নেই। চুলগুলি বেশীর ভাগ খড়ির মত উঁচিয়ে আছে। তেল বা শ্যাম্পু কোনটাই যে এ এলাকায় দীর্ঘদিন পড়ে না, তা সুস্পষ্ট। মুখের চামড়া কোঁচকানো। কিশোরীর মত নিষ্পাপ দুটি চোখ। ভুঁড়– আর পাঁপড়ীতে কালো রং। তারপরও চোখের মণিতে শিশুর কৌতুহুলের আনাগোনা। বুঝলাম, মুখে যে তার বয়সের ছাপ তা একান্তই চাপিয়ে দেয়া। প্রসাধনে সৌন্দর্যচর্চা নেই, আছে শিকার ধরার পাঁয়তারা। মেয়েটি নিজে শরীরের প্রতি কোনই খেয়াল করে না। আরেকজনের দৃষ্টি তার দিকে আকর্ষন করাই তার প্রধান কৌশল। এক কথায় মেয়েটি বারবণিতা। এ বয়সে? কত হবে ওর বয়েস?

আমি বেঞ্চে বসার কিছুক্ষন পরে ও দেখলাম একটু দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে থামটি ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, আমি কি তোমার পাশে বসতে পারি?

স্বচ্ছন্দে। আমি বুঝলাম, ও শুধু বসতেই চাচ্ছে। আমি যে তার মক্কেলদের মধ্যে পড়ি না, তা ও জানে। ওর চাউনীতে শিকারীর মনোযোগ নেই।

তোমার নাম কি? জিজ্ঞেস করলাম। মারিয়া। মানে মেরী, মাতা মেরী। যীশুখৃষ্টের মা। মনে কোথায় যেন একটা ব্যাথার খোঁচা! সারা দুনিয়ার ত্রাণকর্তা, মহান যীশুর মার নাম ওর। উনি তাহলে রাস্তার জীবন থেকে ওকে রক্ষা করেন না কেন? 

তোমার নাম কি? তুমি কি এই শহরে থাকো? আমার উত্তর শুনে বলল, তুমি কি আমার বাসের টিকিটটি কিনে দেবে? আমার আজও কোন রোজগার হয় নি। টিকিট ছাড়া অনেক সময় ড্রাইভার বাসে উঠতে দেয় না।

আমার সাথে আজ যদি তোমার দেখা না হতো, তুমি কিভাবে বাসে যেতে? আমি জিজ্ঞেস কললাম।

ড্র্রাইভার রাজী না হলে বা কোন যাত্রীর দয়া না হলে, এখানে শহরের মধ্যে গিয়ে কিছু ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হতো। তবে এ শহরটা ছোট। সম্ভাবনা কম। কিছুই না হলে, রাতটি কোথাও কাটিয়ে সকালে আবার বাস ধরার চেষ্টা করতাম। 

থাকো কোথায় তুমি? এ শহরে এসেছো কেন?

আজ দুপুরে একজন এখানে নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যায় বিনা নোটিশে ওর বান্ধবী এসে পড়াতে আমার চলে আসতে হল। আমি বললাম, তোমার বন্ধু তোমাকে কোন টাকাপয়সা দেয় নি? বন্ধু নয়, ফ্রায়ার (মক্কেল)। শয়তান একটা। বান্ধবী আসার পর আমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিল। ভান করলো, যেন আমাকে চেনেই না। বলে একটা লম্বা হাই তুললো। গত দুরাত ধরেই ঘুমানোর জায়গা পাচ্ছি না। হাই তোলার একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা ওর। তুমি স্কুলে যাও না? স্কুলে গিয়ে কি হবে? ঐ সব স্কুল পাশ করে চাকরী করে মাসে যা রোজগার হবে, তা কোন কোন সময় আমি এক রাতেই পেয়ে যাই। পড়াশুনার বিরুদ্ধে অকাট্য যুক্তি!

তোমার বয়স কত? সত্যিটা বলব না, আইডি কার্ডের? এতক্ষনে মারিয়া বেশ সহজ হয়ে এসেছে। দুটিই। সামনের মাসে পনরোয় পড়ব। কিন্ত এই দ্যাখো আমার কার্ড, উনিশ বছর। আমার ধারনাই ঠিক। ফলস-কার্ড কোথায় পেলে? আমার এক বন্ধু ছিল, রাশিয়ান। ও করে দিয়েছে। তোমার বাবা মা? বাবাকে তো মাই চেনে না, আমি চিনবো কি করে? সেকি? হ্যাঁ, মা এক উৎসবে সারাদিন মদটদ খেয়ে রাতে কার সাথে জানি শুয়েছিল। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড। আামি পেটে আসার পর আমার নানী অনেক বলে কয়ে মাকে গর্ভপাত করা থেকে নিবৃত্ত করেছিল। বুড়ি কট্টর ক্যাথোলিক। গর্ভপাতকে মহাপাপ মনে করে। আমি হবার পর থেকেই নানীর কাছে থাকি। তোমার নানী এখন কোথায়? গতবছর থেকে ফ্রাংকফুর্টে এক ওল্ডহোমে থাকে। হার্টের শক্ত অসুখ। মনে হয় এবারে ক্রীসমাস (ছয় সপ্তাহ পরেই) বেচারীর কপালে নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে কোন রকম চিন্তাভাবনা না করেই বলল। মনে হল, মৃত্যুভয়কে সে কোন হজপিস-প্রশিক্ষন ছাড়াই জয় করে ফেলেছে! তুমি কোথায় থাকো? নানীর একটা ছোট্ট বাড়ী আছে গ্রামে। ওখানে মাঝে মাঝে বেড়াতে যাই। থাকি এক এক রাত এক এক একজনের সাথে। এ শহর ও শহরে। মাঝে মাঝে আন্ডারগ্রাউন্ড ষ্টেশানেও রাত কাটাই। সব রাতই তো আর সমান না! বলে হেসে ফেলল। ও নিজেও জানে না, ওর এসব কথার মধ্যে অনেক গভীরতাও আছে। কোন লেখক এটা লিখলে নতুন দর্শনও হয়ে যেত হয়ত! 

নানীকে দেখতে যাও না? প্রতি সপ্তাহে একবার যাই। মনে হয় শীঘ্রী এ যাতায়াতটিও বন্ধ হয়ে যাবে।  

তোমার মা কোথায় ? দু বছর হলো বার্লিন থাকে। কি করে? এক মুহুর্তও না থেমে বলল, বেশ্যাাবৃত্তি! আরও বললো, মাই তো আমাকে শিখিয়েছে, স্কুলে গিয়ে সময় নষ্ট না করে সরাসরি রাস্তায় নেমে টাকা কামাতে। মার সাথেই তো আমি প্রথম রাস্তায় নামি। বুুঝলাম, তাকে এ বিদ্যাদানটি তার মাই করেছেন। সংসার করে নি। বিয়ে,স্বামী বা প্রেম ও নিজেও জানে না। সন্তান-¯েœহ, মাতৃত্ব তার কাছে অজ্ঞাত। মেয়েকেও তাই তারই পথে নিয়ে এসেছে।

বললাম, এভাবই কি সারাটা জীবন কাটাবে? জানি না, বলে চুপ করে গেল। পরিবেশটা বেশ থমথমে হয়ে গেল। ১৫/২০ মিনিট ধরে আলোচনার স্বচ্ছন্দ ধারাটি আমার এ প্রশ্নে যেন কোন বাঁধে আটকে গেল। দেখলাম, মুখে একটু বিষন্নতা। কি একটা চিন্তাা করছে। ২/৩ মিনিট পরে বলল, কিছু টাকা জমাবো। তারপর গ্রামে নানীর বাড়ীতে গিয়ে থাকবো। বুড়ী আমাকে লিখে দিয়েছে। বাগানে শাকসব্জির চাষ করবো। নানীর কাছে এসব শিখেছি। একটা গাই পুষবো। টাটকা দুধ খাওয়া যাবে। বলে খিল খিল করে হেসে উঠলো। বুঝলাম, স্বপ্ন দেখার অধিকার আন্তর্জাতিক, বিশ্বের সর্বত্র এর উপস্থিতি। কোন ভুগোল বা ইতিহাস দিয়ে এর সীমারেখা টানা যায় না। বর্ণ, ধর্ম, দেশ-কাল-পাত্রের উর্ধে স্বপ্নের পরিসীমা। বললাম, শুধু শাকসব্জীর চাষ আর গরুর দুধ খেয়ে কি জীবন কাটানো যায়? মনে হল একটু হুচোট খেল! ওর এই একান্ত স্বপ্নটিতে যে এতবড় একটা ফাঁক আছে তা সে হয়ত কোনদিন ভাবে নি। বলা যায় না, হয়ত একটা পেশা শিখবো। কি পেশা? 

কিন্ডার গার্ডেনে টিচার বা কোন শিশুসদনে বাচ্চাদের কেয়ার টেকারীর। আমার সাথে ফ্রাংকফুর্টের একজন সমাজকর্মীর ভালো পরিচয় আছে। ও বলে, আমি চাইলে তিনবছর একটা স্কুলে পড়ে এবং পরে একবছর শিক্ষানবীশি করে বাচ্চাদের দেখাশুনার পেশায় ঢুকতে পারবো। কয়েক বছর পরে ওদের টিচারও হতে পারবো। ওর নানীর গ্রামের বাড়ী ফ্রাংকফুর্টের পাশে। ও এ শহরেই বেশীর ভাগ থাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি তো ফ্রাংকফুর্টে থাকো। এখন আমার শহরে যাচ্ছো কেন? যাবার ইচ্ছা তো ফ্রাংকফুর্টেই ছিল। কিন্ত এত লম্বা রাস্তা বাসে বা ট্রামে বিনাভাড়ায় যাওয়ার খুব অসুবিধা। তোমার শহরে মিউনিসিপালিটি ভবনের নিচে গাড়ী রাখার জায়গায় কোনমতে রাতটা কাটিয়ে সকালে দেখি ফ্রাংকফুর্ট যাওয়া যায় কিনা। কপাল ভালো থাকলে হয়ত কোন গাড়ীর দরজা খোলা পাবে। তাহলে রাতটা ভাল কাটবে। বলেই আবার সেই শিশুর মত হাসি! পরে আমাকে অবাক করে বলল, তোমার সাথে আলাপ করার পর আজ রাতে আর মক্কেল ধরতে ইচ্ছা করছে না। আজ রাতটা বিশ্রাম নেবো। আজ আমার ছুটি। বলেই হো হো করে হেসে উঠলো। 

বাস এসে গেলো। আমি বললাম, যাও উঠে সিটে বসো। আমি দুজনের টিকেট কিনে আসছি। হাসিমুখে ধন্যবাদ বলে সে বাসে গিয়ে পেছনের একটা জায়গায় বসলো। বাসে দু একজন মাত্র যাত্রী। 

আমি ওর কাছে গিয়ে পাশে বসে ওর হাতে টিকেট দিয়ে বললাম, এটা ফ্রাংকফুর্টের টিকেট। ড্রাইভার বললো, এ বাসটি সোজা সুদ-বানহোফে যাবে। ওখান থেকে এস-বানে তুমি ফ্রাংকফুর্টে রাত এগারোটার মধ্যে পৌছে যাবে। তারপর ইচ্ছা হলে এ টিকেট দিয়েই বাসে তোমার নানীর বাড়ী যেতে পারবে। ড্রাইভার বলেছে রাত বারোটা পর্যন্ত ওখানকার বাস আছ্।ে এই নাও ছয় ইউরো, ফ্রাংকফুর্টে সামান্য কিছু খেয়ে নিও। সব মিলিয়ে দশ ইউরোর মত লাগল আমার। আমি নিজেও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। থাকলে হয়ত আরো কিছু দিতে পারতাম। সারাজীবনই আমার ইচ্ছার সাথে সঙ্গতির বিরোধ! মারিয়ার অবাক হওয়া দৃষ্টিতে বিরাট এক শুন্যতা। মনে হল আমার কোন কথাই সে শুনে নি। সে আবার স্বপ্ন দেখছে। কিন্ত চোখের চাউনিতে রাজ্যের অবিশ্বাস। এ বয়সে তাকে কেউ এমনিতে কোন টাকা পয়সা দেয় নি। পিতুøেহ কি তা সে জানেনা। এক নানী আদর করত। সেও এখন মৃত্যুশয্যায়! মা সুদুর বার্লিনে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। 

বাস ছেড়ে দেবার পর আস্তে আস্তে বলল, আমি তো শুধু তোমার শহর পর্যন্ত টিকেট চেয়েছিলাম। তোমার এতগুলি টাকা খরচ হলো। আমি হয়ত পরে তোমাকে ফেরত দিতে পারবো। কিন্ত আমি তো জানি না তুমি কোথায় থাকো। আমি বললাম, আমি কোথায় থাকি তা তোমার জানার দরকার নেই। তবে পৃথিবী এখন খুবই ছোট। আবার হয়ত পথিমধ্যে কোথাও তোমার সাথে দেখা হবে। তোমার নানীর বাড়ীতে শাকসব্জীর চাষ শুরু করে গরু কেনার পর, যখন তুমি বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য একটা পেশা শিখবে, সেদিনই আমার এ সামান্য টাকাটা পুরো সুদসহ শোধ হয়ে যাবে। ভালো থাকার চেষ্টা কর। বেস্ট অব লাক। টেক কেয়ার।   

নয়ে-ইজেনবুর্গ, জার্মানি 






শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট