কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, জন্ম : ০২ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৯, মৃত্যু : ১৫ নভেম্বর ২০২১, ছবি : নূর এ আলম
কথাশিল্পের চারুপিতা, বিদায়....
মো. আরিফুল হাসান
মধ্যহেমন্তের একটি করুণ নি¤œচাপবৃষ্টির রাত। রাতটা চাঁদের সাথে ভেসে গেলে কিংবা অন্ধকারের অপর পৃষ্ঠায় মুখ লুকালে তখন রাজশাহীতে ঘড়িতে নয়টা বেজে কিছু মিনিট। হিমকণার মতো কিছু ছায়াছায়া জলবিন্দু শোকাকুল হয়ে ঝরে পড়তে দেখে দুর্যোগপ্রবণ বাতাস কি মনে করেছিলো কে জানে? তবে পাতাদের ঘুম ছিলো না। ঘুম ছিলো না বিহাসের বাড়ি উজানে। কোনো এক নক্ষত্রের পতন হবে, এ জন্যেই বোধয় সাগরে সাগরে শীতার্থ হাওয়া হুহু করে কেঁদে গেলো। তখন একটি দিকহারা বিষণœ বাতাস ঘুরতে ঘুরতে, ঘুরতে ঘুরতে এলোচুলে এসে আছড়ে পড়লো বর্ধমানের যবগ্রামে। হায় জন্মভিটে, তোমার আরতি আজি, প্রণাম লহ হে মাতাবীজ।
৩০ কার্তিক ১৪২৮, ইংরেজি নভেম্বরের পনেরো তারিখ সন্ধ্যায় যে বিষণœতা দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো রুগ্নশয্যায়, হাসান আজিজুল হক কি তখন শুনতে পেয়েছিলেন কোনো এক বিভ্রান্ত কবির নিমগ্নপংক্তির অন্তর্যাস? “যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়;/ যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে....।” জানি না, জানি না তিনি শুনতে পেয়েছিলেন কিনা। তবে ম্লান চোখ আরও বেশি ঝাপসা হয়ে এলে শোকাকূল ধরণী বললো, হায় ২০২১, তুমি আর কতো বলো নিঃস্ব করবে এই বাংলার রতœভা-ার?
তখন একটি নিশাচর পাখি সদ্য তার খোঁড়লের আঁধার কেটে জ্যোৎ¯œা ভেবে মেঘছায়া শিশিরের ভেতর পালক থেকে খুলে ফেলে শ্রান্তি। কিন্তু ডানায় তার নতুনের রেখাপথ তৈরি না হলে সে ভাবলো, এ আঁধারটাকে হয়তো সে গচ্ছিত রেখে দেবে কোনো এক নিমগ্নরেখার অন্তরপথের অভ্যন্তরে কিংবা তার মনের বেদনার সাথে ভাগাভাগি করে নেবে এ আঁধারটাকে। আচ্ছন্নতা তাকে পেয়ে বসলো। ডানার বিরামচিহ্নভুলে সে উড়ে গেলো পশ্চিমবাংলার দিগন্ত-বিস্তৃত বিলে হাহাকার হয়ে। একটি শৈশব ও কৈশোরের স্বপ্নঘেরা সে নিশুতি বিল পরম পরশে তার পালকের ভেতর থেকে খুলতে লাগলো হিমকণার মতো বিরহ। আহ, হাসান আজিজুল হক! যৌবনে দেশ ত্যাগের আগ পর্যন্ত নিত্যসহচর, নিত্যকর্মে তার সঙ্গে হয়েছে চেনা-জানা।
পাখিটির পালক থেকে হিমকণাগুলি ঝরে পড়তে পড়তে একটি একটি বরফ পাহাড়ের আকৃতি নিলো। ¯্রােতের গতির চেয়েও অধিক একটি ঘন নীল আঁধার তখন পালকের বিলাপ নিয়ে হাজির হলো খুলনার ফুলতলায়; তার দ্বিতীয় আবাসে। যে ঝড়টি উঠেছিলো রাজশাহীতে, সেই নীরব, নিস্তব্ধ ঝড়টি অশ্রুধারার ফোয়ারা বয়ে নিতে নিতে বিএল কলেজের ছাত্ররাজনীতিতে কী উত্তাপ, কী হীম-শীতলতা ছড়াতে থাকে? তখন মর্মররেখারা ফিরে আসে রাজশাহীতে আবারও, সরকারী কলেজে। দর্শনের বারান্দায় রোনাজারিতে পাষাণের চোখে কান্না।
পাহাড়ের চূড়ো থেকে একখন্ড পাথর গড়াতে গড়াতে বড় একটি ধ্বস নামিয়ে দিলে ছুটন্ত হরিণির পায়ের ক্ষুরায় আটকে গেলো মহাকাল। দিগন্তছুঁয়ে এক বিস্তৃত কথাপরিধি তখন সামনে এসে দাঁড়ালো খোদাই করা ভাস্কর্যের মুখাবয়বে। তখন সেখানে তারাফুল ঝলমল করে উঠলো যে আঁধার কেটে গিয়েছিলো তা যে অত্যাসন্ন আবার সে কথা কি কেউ তখন বলেছিলো? সন্ধ্যায় শকুনটা নেমে এসেছিলো ধূসর প্রান্তরে, বালকদের খেলার গুটির উপমারূপে। আসলে শকুনটা ছিলো ভেতরে, ভেতরের গোপন নরকে।
উৎসাহী বালকেরা একেকটা পালক খুলে ফেললে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলো পুঁজিমানসের বিভৎসতা, বেরিয়ে আসতে থাকলো সমাজের নিষ্পেষিতের দ্রোহ ও খুনের টকটকে লাল। আর তখন একজন হাসান আজিজুল হক বিশীর্ণতার ভেতর থেকে তুলে ধরলেন তৃতীয়বিশ্বের অপরিণত শিশু। আর দেখালেন কাদু শ্যাখের রাঁঢ় বোনটিকে, “দিনের চড়া আলোয় অদ্ভুত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে মরা শকুনটার মতোই।” তাই জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানের সময়টা মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, বেঁচে থাকার জন্য যে প্রয়োজন, তা মেটাতে চায় জীবনের দামে। একটু একটু করে কুপির সলতের মতো তাই নিঃশেষ হতে থাকে ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিক বাশেদ। তৃষ্ণা, ও তৃষ্ণা তোমার জলচাবি! দাও মুখে দাও অমৃত মম, দাও অন্তরে জ্বালা-বিষ।
অচরিতার্থ যৌনবাসনা আর উদরের উদগ্র জ্বালা মিলে মিশে এক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি, তখন রাতের অন্ধকারে বেকারার চলতে চলতে “একটা তীক্ষè তীব্র মৃত্যুর মৃত্যুর মতো অমোঘ প্রবৃত্তি গড়াতে গড়াতে চলল ঢালু বেয়ে, তার মৃতুর দিকে।”
আগুনপাখি একটি নদীর নাম। দুই পাড়ে প্রবাহিত জীবন, ও জীবনের প্রকোষ্ঠে জমে থাকা বিষস্মৃতি। দেশভাগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আখ্যানে দেখা যায় একটি প্রান্তিক রমনী তার যাপনের পরাকাষ্ঠা খুলে ভাঁজে ভাঁজে সাজিয়ে রাখছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধকালীন আর্থ-রাজনৈতিক দেউলেপনা, কলেরা মহামারী আর ফসলহানির জীবনচিত্র। ভাঁজে ভাঁজে প্রজ্জ্বলিত শিখা এক সময় আপন আলোকে উস্কে দিতে দিতে বিশ্বচিত্রের প্রতিভূ হয়ে সামনে আসে। তখন ভ্রাতৃত্ববোধের দায়, প্রতিবেশিকতার আন্তরিকতা, কিংবা সহচল বন্ধুর হাত সহচলের জন্য হয়ে উঠে যমকুঠার। নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে একটি সাজানো বাগান ভেঙেচুড়ে তছনছ হয়ে গেলে শেকড়গেড়ে বসেন রাঁঢ় রমনী। নিজের ভেতর দ্রোহের আগুন ফুল হয়ে ফুটতে থাকলে জন্ম নেয় নবতর ফিনিক্স। ফলে চিরব্রতা প্রান্তরমনীও হয়ে উঠেন প্রাজ্ঞ আগুনের কোলাজ।
আগুন এরপরে ফুটতে থাকে গল্পে গল্পে তিলোত্তমার পদাকীর্ণ করে। শঙ্খে বাজে নিনাদ, আর মনোসমীক্ষণের ভুমিকার বিপরীতে বেজে উঠে বাস্তবতার রেখায়ন। তবু “মন তার শঙ্খিনী।” নানা ভাবে প্রেমের ব্যাকরণে পরাপাঠের গারদে আবদ্ধ রাখে প্রেমিক হৃদয়। হামিদার বরপালা দেহ, আর মনপালা অভিসার শাদুর শাদাসিদে জীয়নজয়ন্তীর এজলাসে উঠে, “হয় স্বামীর ঘরে যা, নইলে তাকে তালাক দিয়ে আমাকে বিয়ে কর।” ভাতের যে মুরোদ নেই, তার আবার ঘর! ও ঘরে পাখির কান্না হয়ে নিরন্ন হাওয়া খেয়ে দোল খাবে কি হামিদা? আবার দোলাও লাগে মনে, ডাকেÑ “আজ রেতে আসিস আমাদের বাড়িতে, মনের জ্বালা জুড়োব তোর কাছে।” তখন হয়তো বায়ুবনে নানারৈখিক তরঙ্গের উৎপত্তি ও বিকাশ সমান্তরালে বয়ে চলে তাই দেহপতির বাড়িতে গেলেও দেহের ভেতর বাস করে প্রেমিকের বীজ।
প্রেমের বীজ থেকে সিরিয়ার আদুনিস আগুনের গাছ উত্থিত হতে দেখলেও কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক জ্বালান “জীবন ঘষে আগুন।” দেশলাইয়ের কাঁঠিটি টুপ করে জলে পড়ে গেলেও বুকের চিতায় জ্বালিয়ে নেয়া যায় দিব্যি মশাল। ও হাত যদি হয় মিছিলের, ওই হাত যদি হয় শোষণের বিরুদ্ধে অধিকারের। বাগদীদের রক্তের ভেতর তখন একযোগে জ্বলে উঠে ভিসুবিয়াসের সবগুলো শিখা। এমনি ভাবে শোষিতের পক্ষের ঋণ, আপামর জনতার প্রাণের আকুতি, জীবনকামী মানুষের স্বপ্নের শক্তি প্রতিভাত হয়ে উঠে দক্ষশিল্পীর যাদু-কারিশমায়। তখন, কথাবৃক্ষে ফুল ফোটে, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘পাতালে হাসপাতালে’। প্রান্তের বাইরে ও শেকড়ের অভ্যন্তরে ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, উদ্দেশ্য একটাই, ‘রোদে যাবো।’
তবু রোদের পথে যে যায়, অমাবস্যার দমবন্ধবৈরিতায় তাকে সয়ে যেতে হয় অন্ধকারের ঘাত। আর রাত আরো বেশি দীর্ঘতর হতে থাকে, আরও বেশি বিপন্ন হতে থাকে জাগরুকের অস্তিত্ব। তখন কুয়াশার একটি নীল চাদর ঢেকে দেয় রাজশাহীর উজান ভিটেতে শির উঁচু করে থাকা একটি মহিরুহকে। আর তাবৎ পাংশুতার ভেতর পড়ে থাকে ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘মা মেয়ের সংসার’; কিংবা ঢেকে যায় কার্তিকের মেঘে ‘অপ্রকাশের ভার।’ তবু এ চলে যাবার, ছেড়ে যাবার আদি পর্বে প্রশ্ন জাগে, ‘কে বাঁচে কে বাঁচায়?’ বিদায় হে কথাশিল্পের চারুপিতা, চির বিদায়....
কুমিল্লা, বাংলাদেশ