বিপ্লবী চেতনার রোমান্টিক কবি

 

     বিট্রিশ কবি পার্সি বিসি শেলি, জন্ম : ০৪ আগস্ট ১৭৯২, মৃত্যু : ০৮ জুলাই ১৮২২


পার্সি বিসি শেলি

বিপ্লবী চেতনার রোমান্টিক কবি

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


পার্সি বিসি শেলি ছিলেন কাব্য সাহিত্যে উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক কবি এবং ইংরেজি কাব্য সাহিত্যে অন্যতম প্রধান কবি। তিনি ছিলেন কাব্য সাহিত্যে স্বল্পপ্রাণ এক ক্ষণজন্মা। মাত্র ২৯ বছরের জীবনেই রচনা করে গেছেন অমর কাব্য-সম্ভার। তার কাব্যের আবেদন আজও সমুজ্জ্বল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুগ্ধ হয়ে আছে শেলির কবিতায়। কাব্য প্রেমিদের পছন্দের তালিকায় এখনও শেলির নামটি শীর্ষে থাকে। রোমান্টিক ধারার এই কবি ইংরেজী কবিতার ছন্দের জাদুকর হিসেবেও স্বীকৃত। তিনি, জন কিটস এবং লর্ড বায়রন মিলে ইংরেজী সাহিত্যে রোমান্টিক ধারার সূচনা করেছিলেন। তারা তিনজনেই ইংরেজী কাব্য সাহিত্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখে গেছেন। ১৭৯২ সালের ৪ আগস্ট ইংল্যান্ডের সাসেক্সে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বাবা মিস্টার টিমথি শেলি ও মা এলিজাবেথ পিলফোর্ডের ঘর আলো করে তিনি জন্মে ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি তার প্রতিভা ও বুদ্ধিদীপ্ততার পরিচয় দিতে থাকলেন। তার লেখা, নিজস্ব আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা দিয়ে খুব কম বয়সেই তিনি খ্যাতিমান হয়েছেন। লিখে গেছেন এডোনাইস, ওড টু দা ওয়েস্ট ওয়াইন্ড, ওড টু এ স্কাইলার্কের মতো বিখ্যাত সব কবিতা। যার লেখায় রয়েছে বিপ্লব, বিদ্রোহ ও আদর্শের ছোঁয়া।


অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ঘটে যায় এক বিপ্লব। যেটি প্রজাদের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘোষণা করার বিপ্লব। বুর্জোয়াদের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পোলেতারিয়াতদের জেগে ওঠা এবং ধনী-গরিবের মাঝে ভেদাভেদ দূর হওয়ার বিপ্লব। যেখানে সৃষ্টি হয়েছিল মানবপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা। এ বিপ্লবে ধ্বংস হয়ে যায় রাজতন্ত্র। তৈরি হয় পার্লামেন্ট নির্ভর শাসনের প্রয়োজনীয়তা। সবার মাঝে ফিরে আসে সাম্য। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিপ্লব ফরাসী বিপ্লব নামে পরিচিত। যে বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে তৎকালীন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। সমাজ এবং মানুষের জীবন-মান, চিন্তা-চেতনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই লেগেছিল এর ছোঁয়া। তেমনি সাহিত্যেও লাগে এর ছোঁয়া। ফরাসী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া রুশো ও ভলতেয়ারের কথাগুলো প্রভাবিত করে সাহিত্যিকদেরও। সাহিত্যিকরাও তখন চিন্তা করলেন শুধু উচ্চবিত্তদের নিয়ে সাহিত্য রচনা না করে সাধারণ ও নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের নিয়েও সাহিত্য রচনা করতে হবে। তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবিও ফুটিয়ে তুলতে হবে। সে জন্য সাহিত্যের ভাষাও হতে হবে সহজ ও সাবলীল এবং সবার জন্য প্রযোজ্য। তাই ১৭৯৮ সালে কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ ‘প্রিফেইস টু দ্য লিরিক্যাল ব্যালাডস’ (চৎবভধপব ঃড় ঞযব খুৎরপধষ ইধষষধফং) নামক একটি বই লিখে সূচনা করেন সাহিত্যের নতুন একটি বিপ্লবী যুগের। যাকে রোমান্টিক যুগ নামে আখ্যায়িত করা হয়। যে যুগের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন শেলি নিজেও। তার লেখার মাঝেও ফুটে উঠেছে এই যুগের বৈশিষ্ট্য।


ছেলেবেলা থেকেই তার চারিত্রিক রূপে ফুটে উঠত সেগুলো। ১০ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ছিলেন সিয়ন হাউস একাডেমিতে। এরপর ১৮০৪ সালে ভর্তি হন ইটন কলেজে। এখানেই প্রথম তার বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ পায়। ইটনের পুরনো প্রথা অনুযায়ী সিনিয়ররা জুনিয়রদের দিয়ে তাদের কাজকর্ম করিয়ে নিত। এ ছাড়া বিভিন্ন ফরমায়েশ খাটাত। শেলির সঙ্গে এসব করতে এলে শেলি এর তীব্র বিরোধিতা করেন। এমনকি এক ছেলের হাতে পেন্সিল কাটার বসিয়ে দেন। তারপর থেকে সবাই সাবধান হয়ে যায়। তার সাথে আর কেউ এমন আচরণ করার সাহস পায় না। সেখানে থাকা অবস্থায় তার লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। এর মধ্যে ১৮০৯ সালে একটি লেখা ছাপিয়ে তিনি প্রকাশকের কাছ থেকে ৪০ পাউন্ড পুরস্কার লাভ করেন। ১৮১০ সালে ভর্তি হন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি কলেজে। তার মাথায় তখন সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা ও ধর্মচিন্তা সম্পর্কে বিরূপ চিন্তাভাবনা কাজ করে। তখনই বন্ধুত্ব হয়ে উঠে টমাস জেফারসন হগের সঙ্গে। দু’জনের চিন্তাভাবনা প্রায় একই রকমের ছিল। তাই কিছু দিন পর দু’জন মিলে লিখে ফেলেন ‘দি নেসেসিটি অব এথেইজম’ বা ‘নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা’ নামে একটি গ্রন্থ। তখনকার সময়ে ধর্মবিরোধীদের প্রচুর শাস্তি দেয়া হতো। তাই এই গ্রন্থ প্রকাশ করার কারণে ১৮১১ সালে শেলি ও হগ দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হলেন। শেলির বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। পরিবার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। ফলে জীবনের বাকি সময়গুলো খুব সংগ্রাম করে কাটাতে হয়। শেলির চিন্তাচেতনায় একাত্মতা পোষণ করার কারণে সবার বারণ সত্ত্বেও ১৮১১ সালের আগস্টে হ্যারিয়েট তাকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে চার্লস নামে এক পুত্রসন্তান জন্মলাভ করে। যদিও সে বিয়ে সুখের হয়নি। ১৮১৬ সালে অজ্ঞাত কারণে হ্যারিয়েট আত্মহত্যা করেন। সে বছরই শেলির বিয়ে হয় গডউইনকন্যা মেরির সাথে। যিনি শেলির সহচার্যে ও অনুপ্রেরণায় একজন বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক হয়ে উঠেন। যাকে আমরা মেরি শেলি নামেই চিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অটুট ছিল।


শেলি ব্যক্তি জীবনে খুব অগোছানো থাকলেও তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকায় সাহিত্য রচনায় মগ্ন ছিলেন। যত দিন বেঁচে ছিলেন, সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। তাঁর রচিত কাব্যগুলো হচ্ছেন ‘কুইন ম্যাব’ (১৮১৩), ‘অ্যালাস্টার’ (১৮১৫), ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ (১৮১৮-১৯), ‘দি চেনসি’ (১৮১৯),, ‘জুলিয়ান অ্যান্ড ম্যাড্ডালো’ (১৮১৮), ‘দি মাস্ক অব এনার্কি’ (১৮১৯), ‘দি উইচ অব এটলাস’ (১৮২০), ‘এপিসাইচিডিয়ন’ (১৮২১) এবং ‘এডোনাইস’ (১৮২১)। তাঁর রচিত সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ হচ্ছে ‘দি ডিফেন্স অব পোয়েট্রি’ (১৮২১)। এ ছাড়াও তিনি বেশ কিছু গীতিকবিতা লিখেছেন। তাঁর লেখায় নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণাধারা, ফুল-লতাপাতা, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতি জীবন্ত রূপলাভ করেছে। ‘ওড টু দ্য ওয়েস্ট ওয়াইন্ড’ কবিতার মতো কখনো কখনো তাদেরকে আহ্বান করতেন ধরার সব অশুভ শক্তি জরাজীর্ণতা সব কিছু যাতে ধ্বংস হয়ে নতুন ও শুদ্ধ প্রাণে চারিদিক ছেয়ে যায়। সেখানে তিনি পশ্চিমা বায়ুকে বলেছেন, ঙ, রিহফ, ওভ ডরহঃবৎ পড়সবং, পধহ ঝঢ়ৎরহম নব ভধৎ নবযরহফ?’ এখানে শীত বলতে বুঝিয়েছেন পৃথিবীর জরাজীর্ণতাকে আর বসন্তকে নবজীবন এবং জরাজীর্ণতামুক্ত পৃথিবীর সূচনা হিসেবে। সত্যিই তো, শীতকাল এসে গেলে বসন্ত কি দূরে থাকতে পারে? আবার ‘টু স্কাইলার্ক’ কবিতায় কবি স্কাইলার্কের গাওয়া গান শুনে বিস্মিত হন। স্কাইলার্ক চড়ুইয়ের মতো দেখতে এক ধরনের পাখি। কবি এর গানকে চাঁদের আলোর সঙ্গে তুলনা করেন। এর গান থেকে কবি নিজ আত্মার প্রেরণা নেন। মনে ইচ্ছা পোষণ করেন এই পাখিটির অর্ধেক আনন্দও যদি তিনি লাভ করতে পারতেন! কিন্তু পাখিটির মতো মানুষের মন এতটা প্রাঞ্জল নয়। শত দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও মানুষ হাসে। তবে তার পেছনে যেন মনের লুকানো বেদনাই প্রকাশ পায়। তাই তো কবি বলেছেন, ‘ঙঁৎ ংবিবঃবংঃ ংড়হমং ধৎব ঃযবংব ঃযধঃ ঃবষষ ড়ভ ংধফফবংঃ ঃযড়ঁমযঃ...


 

তার রচিত ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ গীতিনাট্যটিতে ঈশ্বর জিউসের সঙ্গে দেবতা প্রমিথিউসের বিদ্রোহ দেখা যায়। গ্রিক পুরাণের ঘটনা অনুযায়ী, আদিম যুগে আগুন শুধু স্বর্গের দেবতারাই ব্যবহার করতেন। পৃথিবীতে আগুন ছিল না। জিউসের বারণ সত্ত্বেও দেবতা প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন বয়ে এনেছিলেন পৃথিবীতে মানব কল্যাণের জন্য। তার শাস্তিস্বরূপ জিউস তাকে শেকলে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। সেই বিদ্রোহের ঘটনা শেলি দারুণভাবে ছন্দের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছেন।


‘জুলিয়ান এ্যান্ড ম্যাড্ডালো’ তে যেন নিজের চরিত্রের রূপই বর্ণনা করেছেন। ‘দি চেনসি’ নাট্যের নায়িকার নাম হচ্ছে বিট্রাইস। মেয়েটি নিজের বাবার কুপ্রবৃত্তির কারণে সতীত্ব হারায়। পরে পিতাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণতা যেন শেলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘এপিসাইচিডিয়ন’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন একটি মেয়ের কাহিনী। শেলি তখন ইতালির এক তরুণীর প্রেমে পড়েছিলেন।


সে সময়ের অন্যতম রোমান্টিক কবি কিটসের মৃত্যু হলে তিনি ‘এডোনাইস’ নামে একটি বিশাল এলিজি বা শোকগাথা লিখেন। সেখানে তিনি কিটসের প্রশংসা করেছেন। প্রকৃতি যেন কিটসের মৃত্যুতে শোকাহত। সবাই শোকে কাতর হয়ে গিয়েছিল। দারুণ সব উপমার সাহায্যে এঁকেছেন শোকাবহ দৃশ্য। অন্যতম সেরা রোমান্টিক কবি বায়রনকেও হাজির করেছিলেন কিটসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়।


শেলি সারা জীবন অন্যায়-অত্যাচার, ধর্মের নামে শাসন-শোষণ, ভ-ামি, নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গেছেন। নিজের আদর্শকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে ত্যাগ করেছেন পরিবার ও পরিজন। প্রতিনিয়ত লড়ে গেছেন অভাব-অনটনের সঙ্গে। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার জ্ঞানসমৃদ্ধ সাহিত্য ভা-ার। মাত্র ২৯ বছর বয়সে ১৮২২ সালের ৮ জুলাই ইতালির পিসায় কবি বায়রন ও হান্টের সঙ্গে দেখা করার পর নৌকা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঝড়ের কবলে পড়ে এই মহান কবি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। পৃথিবীর অন্যায়, শোষণ ও অত্যাচারকে ঝড়ের মতো উড়িয়ে দিয়ে সেই ঝড়ের মাঝেই যেন মিশে যান চিরতরে। শেলি ছিলেন কাব্য সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। অকাল প্রয়াত এই তরুণ কবি পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আছেন।


কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক, আমেরিকা।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট