কালো সোনা

 

    অলঙ্করণ : জাহাঙ্গীর হোসেন বাদশাহ


কালো সোনা 

মোহাম্মদ আবদুর রহমান 


প্রিয়া কলেজের সেরা সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে একজন । সে সব সময় নিজের রূপ নিয়ে গর্ববোধ করে । তার রূপের আকর্ষনে প্রভাবিত হয় অনেকে। কেউ কেউ সমর্পন করে তার প্রতি ভালোবাসা। কিন্তু সে কোন দিন কারো ভালোবাসার ফাঁদে পা দেয়নি । সব সময় বট বৃক্ষের মত মাথা উঁচু করে থাকে ।


প্রিয়ার বাবা তার জন্য অতিসাধারণ পরিবারের একটি ছেলেকে পছন্দ করেন । ছেলেটির শরীরের রঙ কালো হলেও দারুন নম্র স্বভাবের। তাকে পছন্দ করার আরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ আছে। ছেলেটি জীবনে পড়াশুনার সময় ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি । তারপর ছেলেটি কলেজের নিয়োগের প্রাথমিক পরীক্ষায় সফল হয়েছে । ইন্টারভিউয়ের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছে । অর্থাৎ এই পরীক্ষায় সফল হলেই সে কলেজের অধ্যাপক হবে ।


  প্রিয়া ছেলেটিকে মোটেই পছন্দ করেনা। সে কত স্বপ্ন দেখেছে তার স্বামী হবে যেমন সুদর্শন পুরুষ তেমনি তার ভালো থাকবে আর্থিক অবস্থা। কিন্তু ছেলেটি তার বিপরীত । বাড়ির সকলের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয় প্রিয়া । কারণ তার তো কোন প্রেমিক নেই যে তার সাথে পালাবে । তার ভেতর ভেতর অনুশোচনা হয় যদি সে অহংকার না করে আগে থেকে একটি ছেলে খুঁজতো তাহলে এমন অবস্থা হত না । নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হচ্ছে । তার চোখের সামনে সব কিছু যেন ঘন কালো আবরন ঘিরে ধরেছে। স্মৃতির ছেঁড়া পাতা গুলি এলো মেল ভাবে ছড়িয়ে পড়ে মনের পর্দায়। আর তার মনের ভেতর প্রশ্ন জাগে- কি ভাবে মুখ দেখাবে বন্ধু বান্ধবীদের ? তার সব স্বপ্ন তাসের ঘরের মত এক মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেল ।


    বিয়ের প্রথম রাতে ছেলেটিকে কাছে দেখার পর তার মনের ভেতর যেন আগুন জ্বলে উঠে। আর সেই আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে চাই ছেলেটিকে এবং তার পরিবারকে । ছেলেটি প্রথম দিন কিছু মনে করে নি । ভেবেছে বাড়ি ছেড়ে এসেছে বলে সে এমন করছে। কিন্তু যতই দিন যায় যেন প্রিয়ার মনের ভেতর আগুন আরও অনেক গুণ বেশি হয়ে জ্বলতে থাকে । যেন পরিণত হয় এক ভয়ংকর জন্তুতে। 


  ছেলেটির ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বের হয় কিছু দিন পর । আর তাতে সে অসফল হয় । তা শুনার পর প্রিয়া আর সে বাড়িতে থাকার ইচ্ছা করেনা । কি দেখে থাকবে সে । কিবা পাওয়ার আছে ছেলেটির কাছ থেকে । তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল । যেন সে কারাগারে বন্দি। সে চাই মুক্তি সেই কারাগার থেকে। তাই তার জন্য ছেলেটির উপর করে অনেক অনেক নির্যাতন । কিন্তু সব নির্যাতন নীরবে  মাথা পেতে নেই ছেলেটি। তা ছাড়া কোন উপায় নেই । ছেলেটি তো প্রিয়ার বাহ্যিক কোন চাহিদা পূরণ করতে পারেনা টাকার অভাবে । তবে  সব সময় সে তার সাথে ভালো ব্যবহার করে । কোন দিন কোন ছোট কথাও বলেনি । কিন্তু এ সব প্রিয়ার মনের ভেতর প্রভাব ফেলতে পারেনি । অপরাধীকে তো শাস্তি পেতে হবে । একটা আয় নেই বিয়ে করেছে । একে বারেই অপদার্থ । এ সব মনে মনে ভাবে প্রিয়া ।

 

    ছেলেটির পরিবারের লোকজন বুঝতে পারে প্রিয়ার মানসিক অবস্থা কত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে । তাই তাকে তালাক দিতে বলে । কিন্তু সে  তার পরিবারকে বলে মানুষের বিয়ে একবার হয় । আমি মনে করি সে একদিন নিশ্চয় বুঝতে পারবে আমাকে । সে দিন থেকে আমরা নতুন ভাবে শুরু করব সংসার । আর যদি সে ছেড়ে চলে যায় তাহলে আমি একা থাকবো চিরকাল । কোন দিন অন্য কোথাও বিয়ে করবো না । যে সব কথা শুনার পর পরিবারের অপজনেরা তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। বলে তোর যা ইচ্ছা কর ।

 


     কয়েক মাস কোন রকম এভাবে  অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রিয়া ছেলেটিকে ছেড়ে চলে যায় তার বাপের বাড়ি । ছেলেটি যেন পাগলের মত ঘুরে বেড়াতে থাকে এদিক- ওদিক  । সব সময় প্রিয়ার প্রতিচ্ছবি তার চোখের সমানে দেখতে পায় । আর সে যেমন ধরতে যায় তখন  এক মুহূর্তে বিলিন হয়ে যায় । এই ভাবে কাটতে থাকে তার দিন। তার নিজেকে এত নগন্য মনে হয় যে তার বাড়ির পাশের রিক্সাওলার থেকেও থেকেই নগন্য । রিক্সাওলাও কিছু চাহিদা পূরণ করতে পারে। সে পারেনা তার স্ত্রীর সামান্য  চাহিদা পূরণ করতে। তখন সে ভাবে তার বেঁচে থেকে লাভ কি ? সে আত্মহত্যা করার জন্য মারিয়া হয়ে উঠেছে । যেন তার ভাগ্যের চাকা কাদায় আটকে গেছে যা শত চেষ্টার পরও নড়ানো যায়না। আবার মনে করে আত্মহত্যা করলে তো সব শেষ । পৃথিবীর প্রত্যেকটা উপাদান ধিক্কার দেবে আমাকে । বলবে কাপুরুষ তাই সে আবার জেগে উঠে।

  

    হটাৎ করে ছেলেটির বাড়ি যায় সোনালী। সোনালী তার ছোট কালের খেলার সাথী। সোনালি তার প্রতিবেশী ছিল। তারা এখন বড়  শহরে থাকে । ছেলেটির শরীরের অবস্থা দেখে বুঝতে পারে তার কোন না কোন সমস্যা হয়েছে । সে জানে তার কোন সমস্যা হলে তার একটা মানসিক অস্থিরতা দেখতে পাই। যা সে এখন দেখছে। সে জানতে চাই তার সমস্যা কি ? প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও পরে সব বলতে শুরু করে । চোখের জল গাল বেয়ে মাটিতে পড়ে। যেন তার দুঃখের বাঁধ ভেঙেছে যা তৎক্ষণাৎ মেরামত করা সম্ভব নয় । সোনালী সব কথা শুনার পর সে ভরাকান্ত হয়। আর তাকে অনেক  বুঝবার পর ছেলেটিকে তাদের শহরে নিয়ে যায় । যা খরচ হবে সোনালী দিবে । চাকুরী পেলে সব টাকা পরিশোধ করে দেবে । আসলে সোনালী তাকে কিছু দিন সময় দিলে সে সফল হবেই। আর সোনালি পরামর্শে সেখান থেকে সে আবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে । 


  অপর দিকে প্রিয়া তার বাড়ি যাওয়ার পর ভাবতে থাকে ফেলে আসা জীবন নিয়ে । সে কি কোন ভুল করেছে ? নাকি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে । উত্তর যায় হউক। বাড়িতে কেউ তাকে দেখতেই পারেনা । সবাই তাকে দায়ী করছে । ছেলেটি একবার অসফল হয়েছে বলে সে কোন দিন সফল হবে না তা তো আর ঠিক নয়। তাই সে বাড়ি থেকে তার দিদির বাড়ি চলে যায় । 


   ছেলেটি কিছু দিন পর আবার ইন্টারভিউ দিতে যায় । আর সে দেখতে পায় তার স্যার ইন্টারভিউ নিতে এসেছে । স্যার আশ্চর্য হয়ে যায় যে তার চাকুরী এখনো হয়নি । আসলে ছেলেটি ছিল ওই স্যারের প্রিয় ছাত্র। স্যার তার চাকরি না পাওয়ার করুন অবস্থা দেখে বলে বাড়ি যা। এবার তোর চাকুরী হবেই । আমি সব ব্যবস্থা করব ।

  

  সময় মত ফলাফল বের হয়। দেখে সে সফল হয়েছে এবং তার চাকুরি হয় পাশের কলেজে। তখন সে যেন বেঁচে থাকার পথ পায়। যেন সফলতার ঘাটে সুখের নৌকা লেগেছ । চোখের সামনে সুখের শহর দেখতে পাচ্ছে । সুখের পায়রা গুলি ডানা মেলে উড়ে আকাশের দিকে । ছুঁয়ে ফেলে যেন চাঁদকে । আর তার চিৎকার করে বলার ইচ্ছা হচ্ছে আমি আর ডাসবিনে পড়ে থাকা নোংরা আবর্জনা নয়। সফলতার উজ্জ্বল ইমারত । যেন তার আটকে থাকা ভাগ্যের চাকা চলতে শুরু করেছে দ্রুত গতিতে । সোনালী যেন তার ভাগ্যের চাকা চলতে সাহায্য করেছে । তাই সে সোনালীর কাছে চির কৃতজ্ঞ ।



 প্রিয়া কিছু দিন যাওয়ার পর দিদির বাড়ি থেকে ফিরে আসে । আসলে দিদির বাড়িতে তো আর বেশি দিন থাকা যায়না । মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে । তাই সে স্থির করে যে সে নিয়মিত কলেজ যাবে এবং ডিগ্রি শেষ করবে। সে তার বান্ধবীদের সাথে যোগাযোগ করে । সে জানতে পারে কয়েক জন নতুন অধ্যাপক নিয়োগ হয়েছে । তাদের মধ্যে এস.আই স্যার অনেক মেধাবী । সব কিছু যেন মন মত বুঝিয়ে দেয় । যেন বন্ধুর মত সব কিছু বলতে পারে সবাই । তাই কয়েক দিনের মধ্যে সকল ছাত্রছাত্রী তার ফ্যান হয়ে গেছে ।

  


    কয়েক দিন পর প্রিয়া কলেজে যায় । কিন্তু যেতে দেরি হয়ে যায় । দেখে তার ক্লাস শুরু হয়ে গেছে । তাই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আসতে করে বলে - আসতে পারি স্যার ।

তার কন্ঠ স্বর শুনার পর এস.আই স্যারের  বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরন জাগে । সে  তাড়াতাড়ি তার দিকে তাকায় । আর অপ্রস্তুত ভাবে বল -আসো । কারণ মেয়েটি আসলে তার স্ত্রী প্রিয়া । যেন সবার সামনে চিৎকার করে বলে দেখ আজ আমি আজ হয়েছি । এর পর তোমার সকল চাহিদা পূরণ করতে পারব । চলো বাড়ি চল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে তার স্ত্রী যদি মেনে না নেয় । সে তো তাকে স্বামী হিসেবে মানেনি কোনদিন। এমন কি  সে তাকে নগন্য ভেবে ছেড়ে চলে গেছে । তাছাড়া সে তো এখন স্যার । সুতরাং তাকে সংযত থাকা উচিত। তাই সে কোন রকম নিজেকে সংযত করে আবার পড়াতে শুরু করে ।


    স্যারের দিকে তাকিয়ে প্রিয়াও আশ্চর্য হায়ে যায় । স্যার তো তার স্বামী সফিকুল ইসলাম। আগে বুঝতে পারেনি এস.আই স্যার যে তার স্বামী যখন বান্ধবীদের মুখে শুনেছিল । আসতে আসতে সে ক্লাসের ভেতরে শেষ বেঞ্চে বসে । লজ্জায় যেন তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে । যাকে সে স্বামী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চাইনি সে আজ তার সকল বন্ধু বান্ধবের ফেবারিট স্যার। অথচ তার স্বামী কোন দিন একটিও ছোট কথাও বলেনি তাকে । যার পরিচয় বন্ধুদের সামনে কি ভাবে দেবে ভাবছিল সে তো আজ জনপ্রিয় অধ্যাপক ।

    

     প্রিয়ার এক এক বার মনের ভেতর গর্ব হচ্ছে । সে তো তার আমার স্বামী । আমাদের এখনও তালাক হয়নি । প্রয়োজন হলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব। কিন্তু আবার আশঙ্কা হচ্ছে সে যদি তাকে আপমান করে । না গ্রহণ করে । নানান প্রশ্ন মনের ভেতর বিচরণ করছে । তবে তার বাবার  সিদ্ধান্তটি অকপটে স্বীকার করছে যে আসলেই তার স্বামী কালো সোনা যা সে চিনতে ভুল করে ছিল । ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে ছেলেটির দিকে ।


মালদা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।




শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট