রূপান্তর
রাশেদ সাদী
এ এমন এক সময়, যা হাতে স্পর্স করা যাচ্ছে না, পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না; কিন্তু রয়েছে এর তীব্র অনুভব, কার্তিকের হাসফাস করা গরমে দৌড়ে হাঁপিয়ে ওঠার মতো, পানিতে ডুবে যাওয়ার এক অনুভূতি; হা করতে পারছ না পানি যাবে বলে, আবার ধরেও রাখতে পারছ না, গলগল করে পানি ঢুকে যাচ্ছে। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির বয়ান দেবার চেষ্টা আমি অনেকবার করেছি। মনঃপূত হয়নি। আর এ জন্যই হয়তো আমি লিখে চলেছি। যেদিন মনে হবে আমি পেরেছি, সেদিন হয়তো ভাষার সঙ্গে এই যুদ্ধ আমার শেষ হবে অথবা অন্য রকম একটা সহাবস্থান তৈরি হবে। এসব পরিস্থিতিতে আগে থেকে আসলে কিছু বলা যায় না।
বরং এ এমন এক সময় যখন শুধু কেঁদে ভাসিয়ে দিতে মন চায় নিজের ছোট্ট নৌকাটিকে। কারো সঙ্গে কথা বা দেখা হোক সেটা যেন মৃত্যুরও অধিক! এ এমন বোধ যার জন্ম মনের অপরিচিত কন্দরে। যেখানে শুধু একজন অশ্রুত, নিঃসঙ্গ মানুষের জায়গা ধরে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় জনের স্থান সংকোলান হয় না। এ এমন এক বোধ যা সেই ছোট্টকালের সমিরুদ্দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সে সময় এমনই এক নভেম্বরের শীতে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল, হারিয়ে যাওয়া কফিলুদ্দিনের ছেলে সমিরুদ্দিন ফিরে এসেছে। তবে সে এখন আর কোন সাধারণ কেউ নন, অসাধারণ লোক।
অসাধারণ লোক!
তখন আমি ছোট। তবে পারিপাশির্^ক পরিস্থিতি বোঝা এবং তদনোযায়ী বুদ্ধিমতো ব্যবস্থা নিতে শিখে গেছি।
আমরা একটি খড়ের আগুনের স্তুপ ঘিরে বৃত্তাকারে বসে আছি আর আগুন উস্কে দিতে হাতের সেগুন গাছের লাঠির সহায়তা নিচ্ছি। আগুন দীর্ঘতর করতে এপাশের-ওপাশের বাড়ির ‘খড়ের পালা’ থেকে দুমুঠো খড় হাতিয়ে এনে আগুনের উপর ফেলছি। শুকনো মচমচে নতুন খড় পেয়ে আগুন দাউদাউ করে জ¦লছে। কুদ্দুস দাদা পাশ দিয়ে খুড়িয়ে যেতে যেতে বললÑ ‘সমিরুদ্দিন ফিরছে।’
সে এক খবর বটে! সমিরুদ্দিন ফিরেছে।
‘তাই নাকি!’ আমরা সবকটি ছেলেপোলে একযোগে চিৎকার করে ওঠলাম। কারণ শোনা গিয়েছিল একটা ঘিয়ে রঙের চাদর মুড়ি দিয়ে যে রাতে সমিরুদ্দিন স্থানীয় কবরস্থানে ঢুকে পড়ে, তারপর থেকে আর তাকে কেউ দেখেনি। সেদিন ছিল শোকাচ্ছন্ন এক শীতের রাত; কোয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল চারদিক। ঘড়ির কাটা তিনটার ঘর অতিক্রম করে গেছে।
সবুরুদ্দিনের সঙ্গে কেউ অপরিচিত ছিল না। কারণ সে রাস্তার মাঝে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেত আর বাতাসকে শাসিয়ে চলত, ‘সর, পথ ছাড়! সড়ে দাঁড়া!’ অদৃশের দিকে আঙ্গুল তুলে সে চিৎকার করত। তারপর আবার চলতে শুরু করত। মানুষ বলতো, ‘ওসব জিন আর দেও-দানোর সঙ্গে ওর তক্ক।’ এসব বিষয়-আশয় ছিল সবুরুদ্দিনের জন্য স্বাভাবিক। তবে সে কোনোদিন নিজের মুখে বলেনি আমি জিন তাড়াই অথবা সে কোনোদিন কাউকে পানিপড়া বা তেলপড়া দেয়নি। তবে মাথায় তার সিট আছেÑ এমন কথাও কেউ কোনোদিন তার বিরুদ্ধে বলেনি। তাতে আমাদের ছোটদের মধ্যে তার সম্পর্কে এক ধরণের বিভ্রমের সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে গ্রাম থেকে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে কে বা কারা নাকি দেখেছিল সবুরুদ্দিন কবরস্থানে ঢুকছে; ঘিয়ে রঙের চাদরে মোড়ানো আর হাতে একটা লণ্ঠন। এরপর আর তার দেখা পাওয়া যায়নি। কত জন কত রকম কথা বলে তাকে নিয়ে। রোহিতন দাদি বলেছিল, একজন পরদানশীন পরী ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। তারপর তাদের দেশেই সংসার পেতেছে। ফলে আর কোনদিন সবুরুদ্দিনকে আমরা দেখব না।
এ জন্য দুঃখ ছিল সবচেয়ে বেশি আমাদের ছোটদের। কারণ আমরা যখন তার গ্রামের শেষকোণের বাঁশঝাড়ে ঢাকা বাড়িতে যেতাম, তাকে দেখতাম কাঠের ঘরের ছোট্ট জালনার একটা পাল্লা খুলে বসে আছে, আমরা যদি ডরভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাকে একটা মাটির ঢেলা দিতে পারতাম, সে সেটা বাতাসা বানিয়ে ফেরত দিত। যদি একটা পাথর দিতাম, সে সেটা মিষ্টি চকলেটে রূপান্তরিত করে হাতে ধরিয়ে দিত। আর এসব কারণে সমিরুদ্দিন নিয়ে আমাদের বিস্ময়ের অবধি ছিল না। আমাদেরই সমবয়সী আবু নসিব তার অভ্যাসবশত নাক খুঁটাতে খুঁটাতে বলেছিল, ‘এসব মজার মজার খাবার সমিরুদ্দিন কোথায় পায় জানিস?’ আমরা সবাই একবাক্যে বলি, ‘কোথায় পায়?’ ‘জিন এসে দিয়ে যান।’
নসিব এমন নিশ্চন্ত ভঙ্গিতে বলে, আমরা ধরে নেই এ না হয়ে পাড়েই না। নাহলে এসব সে পায়ই বা কোথায়? কোনো দিন তাকে বাজারে যেতে দেখি না, কোনো দোকানে যেতে দেখি না। ফলে বিভ্রমটা আমাদের হৃদয়ের তন্তুতে আরও শেকড়-বাকড় গড়িয়ে বসছিল। অথচ কোনোদিন আমাদের ভাবনাতেও আসেনি, তাহলে তার সদ্যনেভা চুলা, যেটা থেকে তখনও ‘ধিকিধিকি’ ধোঁয়া উঠছিল, সেটায় কী কিছু রান্না হয়েছিল?
আসলে এসব আমাদের মাথাতেই আসত না। আমরা তার ঢেরায় যেতাম ভিত-শঙ্কিত হয়ে, কম্পিত পদক্ষেপে।
এতসব খাবার যে আমরা পেতাম তার কাছে, তথাপি কচিৎ আমরা ও-মুখো হতাম। কারণ আর কিছুই না Ñওই ভয়। কীসে ভয় তা বলতে পারব না। কোনো দিন সমিরুদ্দিন আমাদের খালি-হাতে ফেরায় নি, কোনো দিন একটা ধমক দেয় নিÑ যতবার গিয়েছি তার হাসিমুখটিই দেখেছি। তারপরও সবসময় সেই অজানা ভয়ই আমাদের হয়েছেÑ যে জন্য আমরা তার কাছে বেশি যেতাম না। দল বেঁধে যদিও বা কখনো যেতাম দুরুদুরু বুকে, চলে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। তার মধ্যে আমার ভয়টাই যেন ছিল বেশি। মনে হতো বুকে একটা পাথর চেপে বসেছে। ওখান থেকে চলে আসতেই সেই ভারী পাথরটা আস্তে করে নেমে যেত আর তখন সমিরুদ্দিনের দেয়া চকলেট মুখে রেখে চুষতে চুষতে বুক ভরে নিশ্বস নিতাম।
সেই সমিরুদ্দিন ফিরে এসেছে, শুনে আমাদের আহ্লাদের আর অবধি থাকল না। কিন্তু যেতে যেতে লেংড়া দাদা বা ‘বুইড়া কদ্দুস’ যা শুনালো তাতে আমরা হতাশ না হয়ে পারলাম না।
সমিরুদ্দিন নাকি পীর হয়ে এসেছে। করো সঙ্গে দেখা দেয় না। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে যে ঢুকেছে, তার আর দেখা নেই। যারা তাকে দেখেছে বলে দাবি করছিল, তাদের দু-একজনের কাছ থেকে নিজ কানে শুনেছে এমন একজন বলল, আবক্ষ দাড়ি আর গোঁফে ঠোঁট ঢাকা মুখ, মাংসহীন চোখের কোটরে বসে যাওয়া দুটো তারা এভাবে উচাটন হয়ে নড়ছে, যেন মায়াবী দুটো পাখী। খাচার দোয়ার খোলা পেয়েছে কি ওমননি উড়ে চলে যাবে। হাতে সাপের মতো আঁকাবাঁকা কালো লাঠি; মাথায় জোনাকির মতো একটা আলো জ্বলছিল।
তবে কে তাকে দেখেছে তা কিন্তু কেউ নিশ্চয় করে বলতে পারে না। তবে কেউ একজন দেখেছে, সে বলেছে। কে সে? তা আর জানার মতো সময় কই? কিন্তু সে যে এসেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। চোখে দেখাকে কি কেউ অস্বীকার করতে পারে?
প্রায় পড়ো ভিটের ঘরটিতে তিনদিন হল ঘোর রাতে এসে সে ঢুকে দোয়ারের পাল্লা দিয়েছে আর কেউ তাকে বের হতে দেখেনি। দোয়ারের নিচ দিয়ে কতজন কত রকম খাবার দিয়ে রেখেছে, সেখান থেকেও এক টুকরো রুটি পর্যন্ত নড়েনি। মিথ্যে বলব না, এতো মজার মজার খবার যে, দেখেই আমার জিবে জল এসে গেল।
উদগ্রীব জনতার সমাগম আরো বেড়ে গেল। এলাকার চৌহদ্দি পেরিয়ে এ সম্মোহন গিয়ে আছড়ে পড়তে লাগল আশপাশের গ্রামে। দলে দলে লোক আসতে শুরু করল। কিছু কিছু মানুষ সেই সকালে এলো, ফিরল সেই রাতে। কিছুতেই সে সমিরুদ্দিন পীরের মাজেজা না দেখে ফিরতে চায় না। হুট করে যদি বেরিয়ে আসে। কী ঘটবে কে বলতে পারে?
পুরো এলাকা মানুষে গমগম করছে। এ উপলক্ষ্যে দুটো একটা চা-পানের দোকান বসেছে ওই বাড়ি কেন্দ্র করে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নিয়ে আরও কেউ কেউ আসার উদ্যোগ করছে। সেসব হঠাৎ হওয়া টঙ্গদোকানে বসে কেউ চায়ে চুমুক দিতে দিতে, কেউ পান মুখে পুরে দিয়ে, কেউবা আবার বিড়ি ধরাতে ধরাতে বুনো লতাপাতায় জড়িয়ে ধরা জীর্ণ বাড়ির দোয়ারের দিকে তাকায়, এই বুঝি সমিরুদ্দিন পীর মুখ বের করল।
সমিরুদ্দিন একজন কামেল মানুষ। তার কাছে কত জনের কত কিছু চাওয়া। আমাদের ছোটদের চাওয়া কি কম। এবার বেশি বেশি মাটির ঢেলা দিয়ে বেশি বেশি বাতাসা নিতে হবে। ওসব ভয়টয় এখন অনেকটা কমে গেছে আমাদের। কিন্তু পীরসাহেবেরই যে দেখা নেই!
কয়েক দিন যেতে মানুষের সমাগম কমল বটে। কিন্তু কৌতূহল গিয়ে সেই আকাশ ছুঁলো। দূর-দূর থেকে লোকজন আসছে। এটা-ওটা মানত করে যাচ্ছে। মুরগী, আতপ চাল, ছাগলমাই এসে গেল মানতের। এমনকি এসব সুশৃঙ্খলভাবে চালাতে স্বেচ্ছাসেবক দলও গঠন করা হয়ে গেল।
কিন্তু মানুষের ধৈর্য্যের বাঁধ যেন কিছুতেই মানতে চায় না। তারা তাদের কাক্সিক্ষত মানুষটির মুখদর্শন করতে চায়, মাজেজা দেখতে চায়। ধীরে ধীরে সেই কৌতূলহ গিয়ে পড়ল ওই পড়ো ভিটের উপর। জড়াজির্ণ ওই ঘর অতো কৌতূহলের ভার সইতে পারে!
ওটার ভেতরে আসলে সমিরুদ্দিন আছে? নাকি নেই? এই নিয়ে মানুষের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে গেল। শেষমেশ মানুষের কৌতূহলই জয়ী হলো। কারণ এ এমন এক তৃষ্ণা যা আর কিছু দিয়ে মেটানো যাচ্ছিল না। সিদ্ধান্ত পাঁকা হলো, দোয়ার ভাঙা হবে। কিন্তু কে করবে এ কাজ? কার এতো সাহস?
সেদিন লক্ষাধিক মানুষ জমা হল বাড়িটি ঘিরে। লোকে লোকারণ্য। স্বেচ্ছাসেবক দলের হিসশিস দশা। আমাদেরর ছোটদের উপরেও কিছু কিছু দায়িত্ব এসে পড়লো। অনেকের মতো আমার দায়িত্ব পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। দর্শনার্থী পানি চাইলে মানি বাড়িয়ে দেওয়া।
চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে ওয়ার্ডের মেম্বার শাবল নিয়ে আসতে বললো। শাবল এলে সেটা তুলে দেয়া হলো মহল্লার মাতুব্বর মহর আলীর হাতে।
মহল্লার মাতুব্বরের হাতে জীর্ণ বাড়িটির, ততধিক ভঙ্গুর দোয়ারে শাবল পড়ছে। চারদিকে পিনপতন নীরতা। দেখে মনে হবে, এই কিছুক্ষণ আগে যে এখানে একটা উত্তাল সাগর ছিল, তা মুহূর্তের ব্যবধানে মুছে গেছে। আমি জগ আর গ্লাস নিয়ে বড়দের ফাঁকফোর দিয়ে শরীরটা ভেঙে-চুড়ে একদম দোয়ারের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। কোনো শব্দ হচ্ছে না শাবলের আঘাত আর বাঁশঝাড়ের সরসর ছাড়া।
দোয়ার দেখা গেল যতটা ঠুনকো মনে করা হয়েছিল ততটা না। সারি গজারির কাঠের দরজা। টাকডুম টাকডুম করে বাড়ি পড়ছে আর দোয়ার কুম্ভকর্ণের মতো নির্বিকার।
মহর মাতুব্বরের পঞ্চাশ উর্ধ্ব দেহের যে এ কম্ম না, সেটা বুঝতে পেরে তপন খুলে যাওয়ার ছুতোয় শাবল আইজুদ্দির হাতে তুলে দিল। আইজুদ্দি বছর পচিশের তাগড়া যুবক। সব সময় মৌজ-মাস্তি নিয়ে থাকে। তার কাছির মতো পাকানো শরীরের দুই-চার ঘা পরতেই দোয়ার খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু একটা রব উঠল। সবাই যেন একসঙ্গে কথা বলে উঠল। যে যা নিয়েই কথা বলুক সবার কৌতূহল ওই ঘরের দোয়ারের দিকে।
চেয়ারম্যান সামসুজ্জুহা ম-ল তার কাচা-পাঁকা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে মেম্বার আর মাতুব্বরকে বললেন, কাউকে পাঠান ভেতরে?
এ কথার পর পুরো এলাকাজুড়ে সেই পূর্ব নিরবতা নেমে এলো। কেউ সামনে এগোচ্ছে না। একজন আরেক জনের দিকে তাকায় ‘তুই যা, তুই যা’র মতো করে।
অগত্যা আইজুদ্দিই বিরক্তমুখে তার মারওয়ারী ঘোড়ার মতো শরীরে একটা এগুয়ে বাঁক তুলে একলাফে ভেরতে চলে গেল। আইজুদ্দি পরে আমাদের গল্পচ্ছলে বলেছিল, ভেতরে গিয়ে দেখে সুন্দর করে একটা ছালার বিছনা পাতা। একলাফে ভেতরে গিয়ে, দ্বিতীয় লাফে বিছনায় শুয়ে রীতিমতো একটা ঘুম দিলাম।
এরপর প্রায় আধা-ঘণ্টা তার কোনো খোঁজ নেই।
এদিকে রটে গেল সমিরুদ্দিনের ঘরে ঢুকে আইজুদ্দি নাই হয়ে গেছে। গুজব বলে কথা; দাবানলের আগে যার গতি, সঙ্গে আরও রঙ মেখে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে গেল সেই কেচ্ছা।
আইজুদ্দির মা ‘হায় হায় আমার পোলাডারে...’ বলতে বলতে ফিট খেল। ওদিকে আইজুদ্দি তো সমিরুদ্দিনের ঘরে আয়াসে নাক ডাকাচ্ছে। হঠাৎ চিৎকার-চেচামেচিতে তার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেরিয়ে আসে। তাকে দেখে মানুষের মধ্যে আবার নীরবতা নেমে আসে। আইজুদ্দির মা মানুষের ভীড় ঠেলে এসে ছেলেকে জাড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দেয়। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে, গাব হয়ে যাওয়া আইজুদ্দিকে পাওয়া গেছে। দেখে মনে হলো সে ঘুমাচ্ছে তার মুখের ভাব ছিল এমন!
অদৃশ্য হলে মানুষের এমন হয় বলে সবাই ধরণা করে নিল সবাই। কারণ কারো যেহেতু অদৃশ্য হওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। ফলে এমন একটা ধারণা মুখ থেকে পড়তে-না-পড়তেই মানুষ লোফে নিল। তখন অবশ্য আইজুদ্দিনও এ বিষয়ে আর কিছু বলেনি। বলবে আর কী? আতঙ্কিত মাকে সামলানো তার দায় হয়ে গেছে। মা ছেলেকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছে। আইজুদ্দিন মাকে নিয়ে কোনো মতে জমায়েত থেকে সরে এলো।
সে দোয়ার থেকে সরে আসায় অন্যদের সুযোগ হলো ভেতরে প্রবেশ করে কৌতূহল নিবারণের। কিন্তু ভয় সেই আদিম প্রবৃত্তির নামÑ যা মানুষকে, মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিকল করে দেয়। আর সেই বস্তু যদি বড়দের সংক্রমিত করে তাহলে আর দেখহে হচ্ছে না। গোটা জনপদ অচল হয়ে পড়ে। সেটা যে কতটা ভয়াবহ এই প্রথম আমি নিজ চোখে দেখলাম। ওই রহস্যময় ঘরটিতে আর কেউ যেতে সাহস করল না। তবে মুহূর্তকালের ব্যবধানে সেই সুযোগ আর থাকল না। ইতোমধ্যে লাল নাইলনের রশি দিয়ে ঘেরাও করে ঘরে গণমানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এর কিছু দিন পর, আমাদেরকে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলল আইজুদ্দিনÑ
আরে কীসের কী! ভিতরে এক্কেবারে খালি। কিচ্ছু নাই। ফাঁকা। খালি একটা বিছনা পাতা দেখলাম। আমার আর মন মানল না। দপ করে বিছনায় পড়ে নাক ডাকায়া একটা ঘুম দিলাম। এই তো, ব্যস! এরে গাব-টাব করে দিয়ে কত কী বানায়া ফেলছে মানুষ। আরে পারেও মানুষ!
এই গল্প বলার আরও কিছু দিন পর, আইজুদ্দি সত্যি সত্যি গাব হয়ে গেল। কেউ আর কোনো তার হদিস পেলো না। ছেরের নাম জপতে জপতে তার দিছুদিন পর আইজুদ্দির মাও পাগল হয়ে কোথায় যেন চলে গেল। তাদের সংসার বলতে তো ওই আইজুদ্দি আর তার মা। যেভাবে একদিন কোথা থেকে উড়ে এসে গাঁয়ের পড়ো ইশকুলবাড়িতে জুড়ে বসেছিল; ঠিক সেভাবেই একদিন আইজুদ্দি আর তার মা গাঁ থেকে হাওয়া হয়ে গেল। এসেছিল একসঙ্গে, চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল বিচ্ছিন্নÑ আগমন আর নিরগমনে তফাতটা ছিল এই। এবং কিছুদিনের মাথায় তাদের কথা ভুলও গেল গাঁয়ের সবাই।
রয়ে গেল কেবল সমিরুদ্দিন পীরের মাজার।
হাজার হাজার গ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে এখানে এখন মানত দিয়ে যায়। যেখান থেকে এক সময় অদ্ভুদ জাদুবলে আমরা মিষ্টি চকলেট আর বাতাসা পেতাম, সেখানের সেই মিষ্টি জাদুগরটি আর নেই। সে এখন পীর, ছায়া পীর, মানুষের থেকে গ্রহণ করে ছাগাল-মুরগি-ডিম-চাল; প্রতিদান হিসেবে তাদের দেয় সন্তান, বিপদ থেকে মুক্তি আরও ইত্যাদি কারবার। সেখানে আমরা ছোটরা কতই না উপেক্ষিত।
এলাকার গণমান্য লোকদের নিয়ে ইতোমধ্যে একটি মাজার কমিটি গঠন করা হয়ে গেছে। তারাই এখন এটি রক্ষণাবেক্ষণ করে, পরিচালনা করে। মাজারের ধারে-কাছে আমাদের ছোটদের ভিড়তে দেওয়া হয় না। কিন্তু আমি ঠিকই একরাতে কায়দা করে সেখানে ঢুকে পড়েছিলাম।
গভীর রাত। চারদিকে কুয়োর মতো নীরবতা। এমনকি পাখিদের বাসায় তাদের নড়াচড়া পর্যন্ত থেমে গেছে। প্রহরী-ভক্তরা বেদম সিদ্ধি টেনে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। তখন আমি শার্লক হোমসের মতো বেড়াল পায়ে এসে সমিরুদ্দিনের ঢেরায় ঢুকে পড়লাম। হাতে একটা ছোট্ট টর্চ, যেটা আমি হাত দিয়ে ঢেকে খুব কায়দা করে জ্বালিয়ে এগিয়ে গেলাম।
সমিরুদ্দিনকে এভাবে দেখে আমার দুঃখে কান্না চলে এলো। যে আমাদের বাতাসার জাদুকর, চকলেটের জাদুকর; জলচকির উপর তার মলিন একটা চটের বিছনা। এতে শুয়ে সমিরুদ্দিনের পা নিশ্চয় চকির বাইরে চলে আসতো। আড়াআড়ি একটা বাঁশের আড়। যেখানে আছে বলতে একটা ময়লা উড়না; হয়তো ওর মার। সমিরুদ্দিনের মা-বাবাকে আমি কোনোদিন দেখিনি। তার নিশ্চয় বোন ছিল, চাচা ছিল কিংবা অন্যান্য আরও আত্মীয়। তার বাবা-মা কেন কোনো আত্মীয় যে তার থাকতে পারে, তখন আমার মনেই হয়নি। চির নিঃসঙ্গ মানুষটিকে আমি এভাবে দেখেই অভ্যস্ত ছিলাম।
যখন সেই উড়নাটা দেখলাম, তখন আমার খটকা লাগল, উড়নাটা কার? তার মা’য়ের? নাকি অন্য কারো? সে খবর আমার কোনোদিনই জানা হবে না। তবে এটা যে এক নারীর, তাতে আমি একশো ভাগ নিঃসন্দেহ। এ থেকে এই ধারণায় আসা যায়, বাড়িটিতে নারী ছিলেন বা নারীর গমনাগমন ছিল। এছাড়া ঘরে ছিল বলতে সাদা ছেড়া একটা লুঙ্গি। দোয়ারের পাশে একটা মাটির হাড়ি, তলানিটা মাটিতে বসে গিয়ে গোল বৃত্ত তৈরি করেছে; শুকনো খটখটে মাটির ভেতর তলা ডুবিয়ে দেয়ালের দিকে কাত হয়ে বসে আছে সেটা।
দরজার উল্টো দিকের দেয়ালে ধর্ণা থেকে ঝুলছে একটা কাঠের টুকরো। সেখানে কতগুলো বই। পুরো করে ধুলো জমে আছে। বিভিন্ন রান্না আর মিষ্টি বানানোর নিয়মের একটি বইও ছিল সেখানে। সেখান থেকে নিয়েই একাডিমেকি বইয়ের বাইরে আমি জীবনের প্রথম বইটা পড়ি, দ্বিতীয় বইটিও। এটি ছিল কাউন্ট অব মন্টিক্রিসটো, অন্যটি রবিবাবুর ডাকঘর। আজ আমি কিছুতেই মিলাতে পারি না, সমিরুদ্দিনের ঘরে, যে কি-না পীরে বলে পরিচিত, তার ঘরে এসব কী করে এসেছিল!
অতঃপর সম্ভবত সেই ঘরটি বা ওই বইগুলো আমার ভেতর কী একটা রেখে যায়। যা আমাকে ক্রমেই সবার থেকে আড়াল খুঁজতে শেখায় এবং নিঃসঙ্গ করে তুলতে থাকে। ঘরটিতে জালনার কাছে রাখা ছিল সেই বিখ্যাত চেয়ার যেখানে বসে তিনি আমাদের বাতাসা দিতেন। একটা ভাঙা কাঠের সাদামাঠা চেয়ার সেটা, একটা হাতল ভাঙা।
ঘরে মনে হলো কেউ কথা বলে উঠল। আমি চমকে উঠে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলাম। পরক্ষণেই দেখি ঘুলঘুলিটা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। ঘুলঘুলি দিয়ে বাতাস ঢোকার ফলেই এই শব্দ। বাতাসের তোড় যখন বেড়ে যাচ্ছে, ওই ঘুলঘুলি থেকে তখন এক ধরণের গোঙানির মতো আওয়াজ বেরুচ্ছে। তাই আমি বিভ্রমে পড়ে মনে করেছিলাম কেউ বুঝি পেছন থেকে কথা বলে উঠেছে।
সেদিন যদি চিৎকারটা দিয়ে উঠতাম আমার কী হতো জানি না। হয়তো আইজুদ্দির মতো আমিও গাব হয়ে যেতাম। তার চেয়েও বড় কথা, যদি নাই যেতাম ওই সমিরুদ্দিনের ওই সহস্যময় ঘরে, তা হলে কী হতো? হয়তো কিছুই হতো না। তবে বেঁচে থাকার এই দীর্ঘতম পথে সম্ভবত সেই রাত, সেই ঘর আমাকে আজও ওই নিঃসঙ্গ রাজার চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে, যার একটি হাতল ভাঙা, তা হয়তো আর হতো না।
সমরিুদ্দিন; আমাদের হারিয়ে যাওয়া মিষ্টির জাদুকর; আজ অবশ্য মিষ্টিই খেতে পারি না, ডাক্তারের নিষেধ, তাকে এভাবে আমার জানাই হতো না। আমার কেন যেন শুধু মনে হয়, মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন সমরিুদ্দিন নিজের নৌকাটা পৃথিবীর গোপনতম ¯্রােতে ভাসিয়ে দিয়ে একটি বই নিয়ে বসেছে। যে একদিন জাদুবলে একটি পাথরে পরিণত হয়েছে। যে পাথর ঝরঝর করে কাঁদছে।
আমি সমিরুদ্দিনকে যদি বুঝে থাকি তাহলে আমিও তাই; আরেক সমিরুদ্দিন। আদতে আমরা নিজেদের কাছে আশ্রয় নেওয়া সেই নাবিক, যাদের জাহাজ মাঝ দরিয়ায় ডুবে গেছে; তাও সেই জন্মাবধিই। আমি কিংবা সমরিুদ্দিনÑ কেউ হয়তো কোলাহল, হৈ-চৈ পছন্দ করি না। সমিরুদ্দিনের মতো একদিন আমিও হয়তো পাথরে পরিণত হবো। কিন্তু কিছুতেই চাইব না আমার শেষ আশ্রয়টা একটি কোলাহলপূর্ণ, হইচইয়ের স্থানে পরিণত হোক।