পদাবলি

 



কুকুর ও বিবর্তনমুখী রাষ্ট্র

দ্বীপ সরকার


কুকুরগুলো ইদানিং সরছেনা-

নাকের ডগায় হেসে ভেসে দিচ্ছে ঘেউ ঘেউ

উঠোনে কার যেন পা পড়েছে আজ

পীতরঙা মেঘের ভেতর কে হেঁটে বেড়ায়


কোমলমতি রোদের মাহফিলে কে এসেছে? 

কে কন্ঠ মিলিয়ে কুকুরের সাথে রাষ্ট্রের গান গায়?


আমাদের এইখানে-এই রাষ্ট্রে

মজার এটা ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে 

কুকুরগুলো গা ঘেঁষে বসে সামাজিক হতে চায়

আমারা সুযোগ দিচ্ছি কিংবা দিচ্ছি না

অথচ কুকুরের মুখে লালার বদলে

বির্বতনের জল গড়িয়ে পড়ছে

খুব চিকচিকে এবং ফিকফিকে



জন্মের দাগ

সাব্বির আহমাদ 


অযাচিত প্রশ্নের সম্মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি।

আকাশচুম্বী উপত্যকা ঘেঁষে 

গলে গলে পড়ছে সহস্র বছর পুরনো আলোকবর্ষের দোষ। 

জন্মের দাগ রেখে পালিয়ে যাচ্ছে বছর।

ঐ পথে মায়েদের চোখের ভিতর 

জমা হচ্ছে বিষাক্ত ছোবলের আঘাত।  

সময়ের কোলে বসে অকাতরে কাতরাচ্ছে 

আহত চিৎকার-

আমাদের বঞ্চিত সব অধিকার। 

এরপর ইতিহাস সাক্ষী হয়ে আছে;

রাতের নির্জনতা গাঢ় হতে হতে 

নিস্তব্ধ হয়ে যায়ে কুহকের বুক।



একটি পণ্যবীথির আত্মকাহিনি 

সোহেল রানা 


পুবের হাওয়া যেন গায়ে মাখানো সাবান!

এ-ই চায়ের নেশা আর আড্ডাবাজি’ই সকল নষ্টের গোড়া! 

আর ওটা যখন তোমার পেয়ে বসেছে- তুমি শেষ-

দাদা বলতেন।


এখানে শুধু নুন-তেল-সামগ্রীর অভাব পূরণেই নয়, 

বরং রাজনীতি, অর্থনীতি ও 

দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পাদনের যথার্থ স্থান


খলিল-মকবুলের চায়ের কাপে ঝড়-

দারোগালীর জয়জয়কার!

শুনেছি যাত্রাশিল্পী-নোলে ঘোষের সাথে 

দাদারও দহরমমহরম ছিল খুব বেশি!

আর বাবা পরবর্তীকাল আমি... 

যার ধারাবাহিকতা অনন্তকাল চলবে।


পুবের সূর্য পশ্চিমে ডুবো তারপর রাত ঘনায়-

অন্ধকারে পিষ্ট পথচারী- একটা হায়েনার হাসি! 


এবং সাপের ছোবলে বাজপাখির মৃত্যু! 

যদিও অজগরটা এখনো হাঁ-করে আছে।


চাপা বিপ্লব

আকিব শিকদার


আধপোড়া সিগারেটে পুনরায় জ্বালাই আগুন, কাচফাটা চশমাটা 

নাকের ডগায়, মুখময় বার্ধক্যের জ্যামিতিক রেখা। 

কানের গোড়ায় সাদা চুল জানিয়ে দেয় বয়স। আমি যেনো 

নিবিড় গুহায় নিদ্রিত বুড়ো সিংহ, পড়ে আছি অসহায়। 

তবু অনাচার দেখলেই জ্বলে ওঠে গা, মনে হয় 

শরীরময় এসিড, জামার ভেতর কেউ ছেড়েছে মুঠো ভরা বিষপিঁপড়ে।


নক্ষত্র খসে পড়লে আকাশের খুব বেদনা হয়। আমাদের 

বেদনা হয় যখন স্বপ্নগুলো বালির বাঁধের মতো গড়িয়ে যায়।

যখন আশার শ্যামল ডগা নেতিয়ে পড়ে, বইয়ের পাতার ভাঁজে 

গোলাপ-পাপড়ির মতো শুকিয়ে হয় কাঠ। 

যখন আমাদের বালিশ-তলায় চাবির গোছার মতো 

যতেœ আগলে রাখা সন্তানেরা 

হয়ে যায় হায়েনার শিকার। আমাদের খুব বেদনা হয়... 


চলার পথে শত্রুরা ছড়িয়ে রাখে কাঁটা, উটকো পাথর। 

ওরা তো জানে, জল ঘোলা করলেই

মাছেরা পড়বে বিপাকে; হঠাৎ আলো নিভে গেলে 

যেমন বিপাকে পড়ে পতঙ্গ।

শকুনের চোখ আর ঠোঁটের আঘাতে মুমূর্ষ জীবন, বরফে জাহাজ 

এঁটে যাওয়ার মতো স্তম্বিত জীবনের সাবলীল গতি।

যেন কাশের গভীর অরণ্যে বালিহাঁসের

রক্তস্রোত বইয়ে দিলো একটা শিয়াল। 

এক ফোঁটা স্নিগ্ধ শিশিরের জন্য, একটা ফুটন্ত গোলাপের জন্য 

আমাদের চোখে অশ্রু। যেন আমরা কাচের বৈয়ামবদ্ধ তেলাপোকা

নিঃশ্বাসের যন্ত্রণায় ধুঁকছি ভীষণ। 


কাল-গোখরার বিক্ষুব্ধ তা-বে ফুঁসে উঠবই একদিন, প্রতিবাদে 

মারবো ছোবল। রক্ত জবার মতো লাল চোখ, রক্তিম দৃষ্টিতে 

ঝরিয়ে আগুনের ফুলকি জ্বালাবোই সত্য আলোর শিখা। 

মানবো না বেআইনি আইন। যতক্ষণ বাঁচি

চলবো তেজোদ্দীপ্ত ভঙ্গিমায়, যদি মৃত্যু আসে 

করবো আলিঙ্গন মরণেরে অগ্নিমুখ পতঙ্গের মতো। 

ঝাপসা পৃথিবী দেখতে চাই না আর, ছুঁড়ে ফেলে 

ভাঙা চশমা, মুখ থেকে টেনে তুলে বার্ধক্যের ছাপ 

পায়ের তলায় চাপা দিয়ে জ্বলন্ত সিগারেট, কালো ধোঁয়ার 

কু-লি ভেদ করে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে করে আমার।


লেবাস

রফিকুল নাজিম 


বাজারে সাদা রঙের পোশাকের চাহিদা বেড়েছে খুব

সুই-সুতার ঘরে কারিগরদের ব্যস্ততাও বেড়েছে খুব।


সাদা পাঞ্জাবিতে পাতি লিডারকে 

মনে হয় পূতপবিত্র মানুষ; সাক্ষাত দেবদূত,

সাদা পাঞ্জাবিতে খলনায়ককেও 

মহানায়ক উত্তম কুমারের মতো লাগে!

সাদাতে ফটকাবাজ আদম ব্যবসায়ী 

সুরত আলীকেও মনে হয়- উদীয়মান সমাজসেবক।

সাদা মানেই পবিত্রতার প্রতীক; সাদা এখন হালের ফ্যাশন।


চতুর্দিকে সাদা পোশাক পরা লাখো মানুষকে দেখি রোজ

আহা! সাদা মনের মানুষগুলো কোথায় যেন হচ্ছে নিখোঁজ।


বদলে যাওয়া সময়ের গান

প্রিন্স মাহমুদ হাসান 


আমরা বদলাতে না চাইলেও বদলে যায় 

আমাদের হিসেব, বদলে যায় সময়।

শৈশবে যে বৃষ্টিকে দেখে ভিজতে যেতাম

আজ সে বৃষ্টিকে দেখে দৌড়ে পালাই।

আশ্রয় খুঁজি অন্তত একটি ছাতার কাছেও

আমরা ভেতর থেকে যতই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই

নিজের কাছে মিথ্যাবাদী সাজি ততই।

আমরা যারা আমাদের খেলনাপাতি গুছিয়ে

বড়দের আকার ধারণ করে আছি

তারা আজ সত্যিই কত বড় অসহায়!

আমাদের প্রকৃত কোন আশ্রয় নেই

নেই চিরচেনা পরিবেশের আবহ

আঁধারে পথ চেনার দায়িত্ব নিজের 

ঘাড়ে নিয়ে দিগি¦দিক ছুটে চলেছি।

আমাদের কান্না পেলে কাঁদতে পারি না

আমাদের ভেতরের কান্না বরফ হয়ে গেছে।



আমি কালো গোলাপ

মারজানা মার্জিয়া


আমি ঝড়ো হাওয়ার মত বেগবান,

আমি কাঠফাটা আগুন ,

বিরোধী আমি শরতের স্নিগ্ধ শুভ্র মেঘ হতে।

যে মেঘ ছায়ায় স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলবে ।

সকল ক্লান্তি-শ্রান্তি অস্থিরতা মুছে যাবে

আমি আগুন ঝরা ফাগুনে তোমায় পোড়াতে রাজি,

আমি রয়েছি বসন্তের দখিনা হাওয়ায়,

মৃদু মহনায় দুজনে হারিয়ে যাওয়ার বাঁধা হতে।

আমি কালো গোলাপ, আমি একগুচ্ছ লাল গোলাপের চির বিরোধিতা করেছি।

যার সুবাস নিসৃত হয়ে দুটি হৃদয় এক হয়; আমি তার মহাশত্রু হয়েছি।

চেয়েছি ঝিরি ঝিরি বাতাসে বয়ে যাওয়া

শাপলা ফোঁটা পুকুরের জলের বাধা হতে,

যার ¯্রােতধারায় মিশে মিলিত হয়,

দুটি হৃদয়ের উষ্ণতা উত্তাল তরঙ্গে।

আমি কালো গোলাপ- 

বিরোধীতা করেছি লালগোলাপ সামনে রাখা তোমার প্রেমালাপ।

আমি কালো গোলাপ-

ক্লান্তিকালের হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া, বিলুপ্তপ্রায় সংলাপ।

আমি প্রণয় জীবনের বিদ্ধস্ত বিপর্যস্ত বিক্ষিপ্ত আর মহাশান্তির সংঘর্ষণ।

যত সুন্দরই হোক তোমার প্রাপ্তি, 

ঠিক তার চেয়ে বিধ্বংসের ন্যায় ঘটাবো প্রণয় জীবনের সমাপ্তি।

আমি কালো গোলাপ -

পারিনি লালের সৌরভতা ছড়াতে, 

শিখেছি রক্ত লালে তোমার হৃদপিন্ড ক্ষতবিক্ষত করতে।

আমি অবহেলিত অপ্রিয়, ভীড়ের মাঝের বিরলমাখা কালো গোলাপ হয়ে জন্মেছি।

প্রণয়ের মহাভয় হয়ে দাড়িয়েছি, সুশ্রী মিলনে চিরবাধা হতে চেয়েছি ।



কিশোরীর তরে প্রেম 

মীযান তাসনীম


তোমাকে বলি নি কিছু 

কত কথা ছিলো 

সময়ের এই স্রোত 

সব শুষে নিলো। 


ভালো লাগা ছিলো আর

ছিলো কী যে টান

তোমাকে ভেবেই দিল

হতো পেরেশান।


দেখা দিলে মনে হতো

এইটুকু ক্ষণ

বুকে ধরে কেটে যাক

পুরোটা জীবন! 


যতটুকু প্রেম ছিলো 

বেশি ছিলো ভয়

কিশোরীর তরে প্রেম

এমনই কি হয়?



সূর্যমূখি গান 

রজব বকশী 


এই জীবনের রাস্তা খুঁড়াখুঁড়ির শেষ নেই  

যেভাবে নির্মাণ এগিয়ে যায়

আমাদের অনাগত ভবিৎষতের দিকে 

ভোর গড়িয়ে সকালের পথ ধরে 

দুপুরের প্রান্তরে জাঁক জমক উপস্থিতি 

আহা দুপুরমিত্র! এই জীবনের সোনালি সময়

ফুরালে কেবলি স্মৃতি ও দীর্ঘশ্বাস উঁকি দেয়

হায়! ক্লান্ত বিবর্ণ বিকেল ছায়া ফেলে যায় 

দীর্ঘশ্বাসে সন্ধ্যার স্তব্ধতা কুড়াই 

একাকিত্বের বিষণণ অক্টোপাস নীলক›ঠ ঢেউ 

যথারীতি রাতের গভীরতা স্পর্শ করে

যদিও গন্তব্য উজ্জ্বল ভোরের দিকে

শব্দ ও নৈঃশব্দের যাত্রী হয়ে জেগে উঠি

এই শরীর মনের অভিব্যক্তি প্রস্ফুটিত করে

নিশ্বাসে ছড়াই হৃদ্যতার পারফিউম 

চৈতন্যোদয়ে বাড়াই হাত 

সূর্যমুখি গান



কবিতা আমার

হাফিজুর রহমান


আমি চাই, আমার কবিতাগুলো বেঁচে থাক;

কথা বলুক ন্যায়ের পক্ষে- অন্যায়ের বিরুদ্ধে 

একইভাবে শত-শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে। 


ব্যস্ততম সড়ক ছেড়ে খানিকটা সময়ের জন্য 

ঘুরে দাঁড়িয়ে শুনে ভাববে হয়তো কোন পথিক, 

অল্পের হলেও এ যেন হয় তারই জীবনের গল্প।

অশ্রু সজল ধর্ষিতার চোখে কবিতা প্রলয়ে

হতে পারে অন্ত্যমিলের গোলযোগ ভীষণ!

তাতে কী? অনিয়মের বিরুদ্ধাচারণে বর্ণগুলো,

ঝাঁঝালো ভাষায় মিছিল করবে এক-জোট হয়ে

একেকটি শব্দ- প্রতিস্থাপন করার তীব্র বাসনায়

মনুষ্যত্বের, অচল যন্ত্রগুলোকে সচল করতে।


আমি চাই, আমার প্রিয় কবিতাগুলো বেঁচে থাক;

অনন্ত সময় ধরে- মেয়াদোত্তীর্ণের ধার না ধেরে।



শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট