প্যারিস রোড
লতিফ জোয়ার্দার
ইতি বললো, প্যারিস রোডে এসো। সকাল বেলায় রাস্তাটা বেশ নির্জন থাকে। প্রাণ খুলে কিছু সময় কথা বলা যাবে। মোবাইল ফোনটা পকেটে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি বৃষ্টি পড়ছে। ছাতাটা কোথায় রেখেছি কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাড়াহুড়ায় কোন কাজই সফল হয় না। দ্রুত অস্থিরতা বাড়তে থাকলো। ঘরে ফিরে আবার ইতিকে ফোন দিবো কিনা ভাবতে থাকি। তখনো বৃষ্টি পড়ছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। মনে হলো মেঘের অশ্রুপাতে ভেজা একটা নতুন সকাল আমার সামনে। একটা নতুন সম্ভাবনা আমার সামনে। আমি হাত বাড়িয়ে আছি তার দিকে অথচ কিছুতেই তাকে ধরতে পারছি না। অবশেষে যখন ছাতাটা পেলাম তখন প্রায় ত্রিশ মিনিট চলে গেছে। এত সময় নিশ্চয় একাকী প্যারিস রোডে অপেক্ষা করবে না ইতি।
তারপরও ঘর থেকে বেরুলাম। আমাদের বাড়ি থেকে প্যারিস রোডের দুরুত্ব কিলো দুইয়েক। সবুজে উদ্যানের মত দাঁড়িয়ে আছে প্যারিস রোড। দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষের সারি। ভেজাপথ ধরে কিছুতেই এগুতে পারছিলাম না। থেমে যাচ্ছিল পা। যেতে যেতে বৃষ্টি থেমে গেল। বৃক্ষের পাতা থেকে ঝরে পড়লো জল। সজীব সতেজ মনো-মুগ্ধকর চারপাশ। কোথাও কোন লোকজন নেই। এই বৃষ্টির দিনে কে আর বের হবে ঘরে থেকে। অথচ আমার বিশ্বাস ইতি জলে ভিজে দাঁড়িয়ে আছে প্যারিস রোডে। একমাত্র আমার জন্য। আমাকে কিছু বলার জন্য। অথচ প্যারিস রোডে পৌঁছানোর পর কোথাও ইতিকে দেখতে পেলাম না আমি। ধু-ধু চারদিক। কিছু কিছু বৃক্ষের আলাপন শুনে ফিরে এলাম আমি।
সেদিনের পরে আর ইতিকে খুঁজে পাইনি। ফোন বন্ধ। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা করবো সে সাহস নেই আমার। কারণ তখন ইতির নতুন সংসার। আমার মত কোন বাউ-ুলেকে নিশ্চয় কেউ আশা করবে না সেখানে। তারপরও বেশ ক’দিন দিন ছুটে গেছি। ইতিদের বাড়ির ছাদে তখন, ইতির ভেজা কাপড় শুকোচ্ছে বৃষ্টি বিরতি সামান্য রোদে। বন্ধ জানালায় চোখ রেখে ফিরে এসেছি আবার। রাস্তায় এসে দেখি ইতির স্বামী বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরছে তখন। তাকে দেখে একটুও চমকাইনি আমি। স্থির চোখে তাকিয়ে থেকেছি। পোষা বিড়ালের মত নাদুস-নুদুস চেহারা তার। মনো হলো এর আগে কোনদিন দেখা হয়নি তার সাথে।
অপেক্ষার দিন কখনো শেষ হয় না। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। স্মৃতির সাথে বসবাস আমার। এক শহর থেকে আরেক শহর। কখনো আবার ফিরে গেছি নিজের কাছে। একাকী কথা বলেছি কত। কখনো মনেই হয়নি ইতি আমার সামনে নেই। অথচ তার সাথে কথা বলি আমি।
বিকেলের রোদে ভিজে চটপটির দোকানে পৌঁছানোর আগে ভো- ভো দৌঁড়ের কথা মনে আছে তোর। আমি কিন্তু এখনো সেইসব পুরনো স্মৃতির কথা ভাবি আর জীবন এত ছোট কেন তার হিসেব-নিকেশ করি। বন্ধু তালিকা খুব একটা বড় ছিলো না আমার। স্কুল ভর্তি গাদা-গাদা ছেলে-মেয়ের মধ্যে কিছুটা অন্যরকম মিজান মেরিনা স্বপন। তুই ছিলি বড় বোকা বোকা। কথা বলতি খুব কম। একমাত্র আমাকে দেখলেই চঞ্চল মেঘের মত এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে যখন তখন আমার হাত ছুঁয়ে দিতি। সেই যে স্কুল জীবন আমার। কতদিন স্কুল পালিয়ে তেপান্তরের পথে ছুটে চলা। সেই যে আমার ছেলেবেলা। আমি এখনো ছুটে যাই তার কাছে। ভো-ভো এক দৌঁড়ে। কিছুতেই তোকে আর খুঁজে পাই না আমি। অথচ এখনো আমরা কত কাছাকাছি থাকি। ভাবনার রাস্তাগুলো খুব সামান্যই হয়। একযুগ তোকে দেখি না আমি। মনে হয় এক কোটি আলোকবর্ষ এখনো দূরুত্ব আমাদের।
একাকী একটা বাড়িতে থাকি আমি। পুরনো সেই দিনের কাছে। নিজে নিজেই রান্না করে খাই। রাত্রী বেলায় কিছুতেই ঘুম আসে না আমার। বাবা-মা কেউ নেই আমার কাছে। দু’জনই ফিরবে বলেই আর ফিরলো না এখনো। ঈদের বাজার শেষ করে অটোরিক্সায় চেপে বাড়ি ফিরছিলো তারা। রাস্তায় ঢাকা কোচের সামনে পড়লো অটোরিক্সা। বাবা সঙ্গে সঙ্গে আর মা হাসপাতালে তিনদিন বেঁচে ছিলো মাত্র। তারপর থেকেই আমি একা। লেখাপাড়াটাও শেষ হলো না আমার। বাউ-ুলে জীবন শুরু হলো। এখনো আমি নির্জন যে ঘরটাতে থাকি। অগোছালো এলোমেলো। ময়লার স্তুপ এখানে সেখানে। ভালো লাগে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না।
আমার ঘরের দেওয়ালে বাঁধানো আছে, বেশ পুরনো একটা ছবি। হঠাৎ দেখে কেউ চিনবে না তাকে। ছবিটা কার প্রশ্ন করবে। আমি একাকি কখনো তার সাথে কথা বলি। বেশ ধুলোর আস্তর পড়েছে ছবিটার বুকে। সে কারণে হয়তো চেনা মানুষটাও কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছে। তারপরও বেশ অনেক সময় ধরে তাকিয়ে আছি ছবিটার দিকে। এতদিনে তার টোলপড়া হাসিটা আছে নাকি হারিয়ে গেছে! এ কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতর কেমন যেন চিন চিন ব্যথা করে ওঠে। আমি নিজেও তো কতটা বদলে গেছি। কত বিষণœ কত ক্লান্ত লাগে আজকাল। ওজন বেড়েছে বেশ। সকাল-বিকাল হাঁটার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তার। যদিও বেঁচে গেছি! এখনো ডায়াবেটিস কিংবা উচ্চ কোন রক্তচাপ হয়নি আমার। চারদিকে সবার যে অবস্থা! কখন আবার ওসব রোগ এসে ভিড় করে শরীরে। ও নিশ্চয় ভালোই আছে। তাকে একবার দেখার জন্য বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। অথচ মানুষটা আমার কথা হয়তো একবারও মনে করে না। একবারও ভাবে না! আর মনে করবেই বা কেন! তার তো আবার পিছুটান আছে। দিব্বি একজনের সংসার করছে। আমি না হয় বাউ-ুলে মানুষ। আমার কথা না হয়, বাদই দিলাম। আমার মত একটা অদ্ভুত মানুষের কথা, কেন ভাবতে যাবে সে? কেনই বা মনে করবে আমাকে? আমি জানি ,আমাকে একবারও দেখতে ইচ্ছে করে না তার। জানি মানুষের সব ইচ্ছে সব সময় পূরণ হয় না। একদিন এ কথা সেই আমাকে বলেছিলো ।
-জানিস শাওন, আমার কোন ইচ্ছেই না, কখনো পূরণ হয় না। এই তোর বেলায় দ্যাখ। একসাথে বন্ধু হয়ে আছি আমরা কতদিন। অথচ কতদিন চলে গেল। হয়তো ভালও বাসি তোকে! তারপরও! ভালোবাসি এই কথাটি বলতেও আমার তিন বছর সময় লেগে গেল। আবার হয়তো সংসারের করার কথা বলতে গেলে, একযুগ লেগে যাবে । আর ততদিনে তুই একটা লাল টুকটুকে বউ এনে ঘরে তুলবি! বছর যেতে না যেতে বউয়ের কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা। ওয়াও ওয়াও করবে।কোলে তুলে তাকে থামনোর চেষ্টা করবি তুই। তোর বউ ছুটে আসবে।
Ñএই তুমি এমন কেন বলো তো, নিজের সামান্য বাচ্চাটাকেও থামাতে পারো না?
তুই কী আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস ইতি ? কী আশ্চর্য রকম বোকা আমি। তাই না! আমার সামনে তো তুই এখন আর নেই । কেবলমাত্র তোর একটা পুরনো ছবি আছে আমার কাছে আর ফেলে যাওয়া পুরনো কিছু স্মৃতি। আর হৃদয়ে গেঁথে আছে সেইসব দিনের কথা। সেই ছবির সাথেই কতদিন আমি কত কথা বলি । সেই ছবি কী আমার কথা শুনতে পারে! বলতে পারিস তুই? এই যে এত এত সময় ধরে, আমি তোর ছবির সাথে কথা বলছিলাম। ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
বোকা-সোকা মেয়েটা কেন যে, আমার এত দূরে চলে গেল। এখনো বুঝি না আমি! অথচ এখনো তার অপেক্ষায় থাকি। এখনো রাত জেগে বসে থাকি। হয়তো তার ফোনের অপেক্ষায়। সব সময় একটা অদ্ভুত ঘোর আমাকে ভেজায়। অল্পদিন হলো ্পুরনো মোবাইলটা চেন্স করেছি আমি। বুড়ো মোবাইলটার বয়স হয়েছিলো ঢের। কবে একেবারে শেষ হয়ে যায় এই ভয়ে বদলিয়ে ফেলেছি তারে। এখন অবশ্য ভালোই হয়েছে। নতুন ফোন কেনার পর, অনলাইন প্রবেশ করতে পারি। ফেসবুকে ঢু মারতে পারি। তোর কী কোন ফেসবুক একাউন্ট নেই? যেখানে তোর প্রফাইলে হাজার রকম ছবি থাকবে হাজার ভঙ্গিতে। দু-চারটা কবিতার পঙতি থাকবে। আমি তোকে ভাজপত্র লিখবো ।
প্রথম যখন তার সাথে সেই উড়োসংযোগে কথা হতো, তখন মনে হতো ছোট্র এই যন্ত্রটার ভিতর বসে আছে ইতি। আমি ইচ্ছে করলে যখন তখন কথা বলতে পারি তার সাথে। কিন্তু ইতির বাবা-মা ছিলো অন্যরকম। একসাথে বড় হলে কী হবে। যখন তখন ওদের বাড়িতে যাওয়া যেত না। ওর মা নানা প্রশ্ন করতো। প্র্েরয়াজনটা কতটুকু জেনেই তাকে ডেকে দিতো। ওদের ঘরের বাইরে ছোট্র বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পা ব্যথা করতো। অথচ ওর মা একবারও ঘরে ডাকতো না আমায়। বেশ অনেক সময় পর, একবার ইতি এসে জানালায় দাঁড়াতো। তার চোখের হাসি টের পেতাম আমি। কোন নোটবই অথবা বইয়ের বাহানায় অল্প কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকতাম আমরা। আমাদের কিছু দূরে ইতির মা কান খুলে দাঁড়িয়ে থাকতো। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই জেলখানার কয়েদীর মত ডাক পড়তো আমার। আমার সময় শেষ। অথচ কিছুতেই তার সামনে থেকে ফিরতে ইচ্ছে করতো না।
একসাথে এইচ এস সি অবধি আমরা ছিলাম। অতঃপর ইতির বিয়ে হলো, তার খালাতো ভাইয়ের সাথে। সরকারী কলেজে পড়াতো সে। আর আমি তখন পড়ি। আমাদের দুরুত্ব হয়তো এখানেই। তিন মাস যেতে না যেতেই! ইতি তার স্বামীর সাথে চলে গেল নতুন কর্মস্থলে। কিন্তু আমি জানতে পর্যন্ত পারলাম না তার কর্মস্থল কোথায়! এতই খারাপ আমি যে তার কাছে ছুটে যাব। তাকে জ্বালাবো। তাকে পোড়াবো। তবে এখনো কেবলি আমার মনে হয়। সেদিন প্যারিস রোড়ে কেন আমাকে ডেকেছিলো ইতি। সেদিন কী কথা বলতে চেয়েছিলো আমায়। নাকি! তার বিয়ের খবরটাই দিতে চেয়েছিলো। এর বেশি কিছু ভাবতে গেলেই, এখনো আমার চোখে বর্ষা নামে।