এক শীতরাতের গল্প
আহমদ মেহেদী
তখন রাত ১২.৪৫ বাজে । খুব শীত পড়েছে। মোবাইলে সুমির কল আসাতে ঘুম ভেঙে গেল।
-হ্যালো, কি কর?
-সন্ধ্যা থেকে জ্বও; ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
-তোমার কি অবস্থা, রাতে খেয়েছ? েেতামাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
-ও... তাহলে চলে এসো, দেখে যাও আমাকে! দুষ্টামির ছলে
-যদি সাহস থাকে আসোনা!
সাথে সাথে আমারও একটু জেদ হল, হোক না এত রাত আমি আজ তাকে দেখতে যাবই। জেদের কথা তাকে আর বলতে গিয়েও বললাম না। ততোক্ষনে জ্বর নিয়েই প্রিয়তমাকে সারপ্রাইজ দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছি। কুটুম্বপুর-কালিয়ার চর রোডের সাথে আমাদের নয়নাভিরাম সবুজ গ্রাম। আমাদের এখান থেকে সুমিদের বাড়ি যেতে পনের টাকা সিএনজি ভাড়া লাগে কিন্তু এতো রাতে তিনশ টাকা দিয়ে ও কিছু পাওয়ার আশা করা নিরর্থক। যেন আজকে মাতাল জোসনা পড়েছে। বাজারে গিয়ে দোকানদার জসিম কে ডেকে তুললাম। বেচারা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিল। দোকানের দরজা খুলেই বুঝল কেন তার মূল্যবান ঘুম নষ্ট করেছি। এক প্যাকেট বেনসন এন্ড হেডজেস নিলাম।
-কই যাবেন রুবেল ভাই?
-কোথাও যাব না, আছি এইতো বাজারে ই।
-ও আচ্ছা ।
সে দোকান বন্ধ করে দেয়। আমি আস্তে আস্তে হাটতে শুরু করলাম। বাম কানে হেডফোন লাগিয়ে সুমিকে কল দিলাম। ওপাশ থেকে-
-এখনো ঘুমাওনি তুমি?
-বাজারে এসেছি।
-কেন?
-এমনি!
- যাও, বাড়ি চলে যাও। আমি থাকলে তো মাথায় পানি ঢেলে দিতাম।
এমনি কত কথা! প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলছি আর হাটছি। সুমি তখনো জানেনা যে আমি তার বাড়ির দিকেই আসছি । বিপদসংকুল নির্জন পথ, হাতে নকিয়া ফোন , পকেটে তিন হাজার টাকা । ২০০৫ সালে এই তিন হাজার টাকাই অনেক মনে হতো আমার কাছে। এই রাস্তায় কিছুদিন পরপর ডাকাতি হয়, বিকালে দাদী- চাচীরা পাশের বাড়ির মোফাচ্ছেলের বউয়ের জ্বিন-ভূত ধরা নিয়ে যে আলোচনা হয়েছিল রাস্তার পাশের কবরস্থান আরো সামনে গিয়ে হিন্দুদের একটি চিতাল দেখে উ! গা হিম হয়ে যাবার মত অবস্থা। মনে মনে আল্লাহর নামে ডাকছি আর ভাবছি -কি দরকার ছিল এত রাতে জিদ করার। সিগারেট চলছে একটার পর একটা। মুরুব্বিরা বলে থাকেন- আগুন হাতে থাকলে নাকি জ্বিন-ভূত কাছে আসেনা। তাই এই সিগারেট জ্বলন -থেরাপি। ৪০-৪৫ মিনিটের পথ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কয়েক ঘন্টার।
অবশেষে বাড়ির কাছাকাছি আসার পর সুমিকে জিজ্ঞাসা করলাম ।
-তুমিকোন ঘরে?
-কেন?
-না এমনি, জানার ইচ্ছে হল তাই ।
-বড় ভাবির ঘরে।
-ভাবির ঘরটা কি পূর্ব পাশে?
-হ্যা, আচ্ছা বলতো তুমি কি সত্যি সত্যি এসে পরলে নাকি? তার কন্ঠে অনেক বিস্ময়।
-ভাবির ঘরের পূর্বে কি ইক্ষু ক্ষেত?
ও শুধু আবেগ মাখানো কন্ঠে বলল।
-তুমি কই,প্লিজ জান বলো আমাকে !
ওকে আর টেনশান না দিয়ে বললাম।
-ঘরের পেছনে।
সুমি বলল।
-তাড়াতাড়ি দক্ষিণ দিকের কামরাঙা গাছ বরাবর জানালার কাছে আস!
বলেই ফোনের লাইনটা কেটে দেয় । আমি জানালার কাছে হাত রাখতে না রাখতেই সুমি তার কোমল হাতে আমার হাতটা ধওে ফেলে। সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না , নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। আর আমি চাঁদের আলোয় ওর হাসিমাখা মুখটি দেখে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। কিছুক্ষণ পরে তার ডাকে স্বাভাবিক হলাম।
-ভিতরে আস জান!
রুমে ঢুকতেই সুমি পরম মমতায় আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাদতেঁ থাকে। ভোর হওয়ার অনেক আগেই আবার বাড়িতে চলে আসলাম ।
আজ সে সুমি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে, ভুলে গেছে পবিত্র ভালবাসার কথা! তের বছর হতে চলছে তার সাথে কথা হয় না, দেখাতো দুরের ব্যাপার। ভাবির কাছে শুনেছি স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। দোয়া করি সে যেন সবসময় সুখে থাকে। তবে সেই চাঁদনী রাতের সেহেতু হাসিটা এখনো ভুলিনি আর আমৃত্যু ভুলতে পারবও কিনা জানিনা !