কুরবানি ও লাল গরুটা
কবির কাঞ্চন
সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঝরছে। ঘনকালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে বিজলি চমকাচ্ছে। সেই সাথে বিজরীর মনেও শংকা কাজ করছে। তবে কি আজও কুরবানির হাটে যাওয়া হবে না। গত দুইদিনের টানা বৃষ্টির কারণে গরুর হাট ঠিকমতো বসতে পারেনি। সেকারণে বিজরীরও বাবার সাথে কুরবানির হাটে যাওয়া হয়নি।
আজও সেই অবিরাম বৃষ্টি। বিজরীর মনাকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেছে। একটু পরপর দরজাটা ফাঁক করে বাইরের দিকে তাকায় সে।
দূর থেকে মেয়ের এমন কাজ দেখে সোলায়মান সাহেব মিটিমিটি হাসেন। তারপর বিজরীকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
-এভাবে বারবার বাইরে গিয়ে কি দেখছো, মামনি?
বিজরী আমতা আমতা করে বলল,
-না বাবা, বৃষ্টি থামলো কিনা তা দেখছি।
-তো বৃষ্টি কি থেমেছে?
-না বাবা, এখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। বাবা, বৃষ্টি এমন কেন? সময়-অসময় বোঝে না। আর মাত্র ক’দিন পর ঈদ। এখন কি বৃষ্টি না হলেই নয়?
সোলায়মান সাহেব বিজরীর কথা শোনে একগাল হাসলেন। এরপর মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে বললেন,
-শোন মা, এমন কথা আর কখনও মুখে আনবে না। এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহই ভালো বোঝেন। কখন রোদ দিলে সৃষ্টির ভালো হবে। আর কখন বৃষ্টি হলে সৃষ্টির কল্যাণ হবে।
বিজরী মাথানিচু করে বাবার কথায় সায় দিয়ে বলল,
-হ্যাঁ, বাবা, আল্লাহ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন। তবুও।
-না, মা, এরূপ কিছু ভাববে না।
এবার সোলায়মান সাহেব মেয়েকে সাথে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলেন। ব্যালকুনীতে দাঁড়িয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। বিজরী তখন আনন্দে লাফাতে লাগলো। বৃষ্টি একেবারে থেমে গেছে। আকাশেও কালো মেঘ নেই।
বিজরী বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-বাবা, এখন তো বৃষ্টি নেই। চল, কুরবানির হাটের দিকে যাই।
সোলায়মান সাহেব ব্যস্ততার গলায় বললেন,
-হ্যাঁ মামনি, তুমি ভিতরে গিয়ে রেডি হও। একটুপর আমরা কুরবানির হাটে যাব।
-আচ্ছা, বাবা।
এই বলে বিজরী মায়ের কাছে ফিরে গেল।
বিকাল সাড়ে চারটা। বিজরীকে সাথে নিয়ে সোলায়মান সাহেব কুরবানির হাটের দিকে এলেন। এবার ‘লেবার কলোনী’ মাঠে কুরবানির হাট বসেছে। বিশাল মাঠ। চারিদিকে মানুষ আর মানুষ। সারি সারি গরু বিভিন্ন পয়েন্টে পয়েন্টে বেঁধে রাখা হয়েছে। লাল গরু, সাদা গরু, কালো গরু, দেশী-বিদেশী গরু, বড় গরু, ছোট গরু ইত্যাদি।
সোলায়মান সাহেব জন্মসূত্রে চট্টগ্রামের বাসিন্দা। চরম অসময়েও নিজেদের বংশগত ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হাটের সবচেয়ে বড় গরু কুরবানি দিতে বাপ-দাদাকে দেখে এসেছেন। নিজেও তার ব্যতিক্রম নন।
পুরো হাটে বিজরীকে নিয়ে গরু দেখলেন। সোলায়মান সাহেবের বেশ কয়েকটি গরু পছন্দ হলেও বিজরীর আপত্তির কারণে সেগুলোর দরদাম করা হয়নি। হঠাৎ বিজরী চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘ঐ দেখো বাবা, বিশাল, সুন্দর লালগরু। তোমাকে এই গরুটাই কিনতে হবে।
সোলায়মান সাহেব বিজরীকে সাথে নিয়ে গরুটির কাছে আসলেন। ভালোভাবে গরুটিকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। গরুটির পিঠে সুউচ্চ কুঁজ রয়েছে। বিশালাকার গরুটির পুরো গা লাল রঙের পশমে ঢাকা। রং বেরঙের ঝরি পেঁচানো শিং দেখে মনে হচ্ছে যেন রাজার মাথায় রঙিন মুকুট জ্বলজ্বল করছে। তার উপর গলায় সুন্দর মালা পরানোয় বেশ আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। গরুটিকে ঘিরে মানুষের ভীড় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে।
সোলায়মান সাহেব বিজরীর কানে কানে বললেন,
-কি মামনি, গরুটি কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
বিজরী খুশি মনে বলল,
-বাবা, গরুটি খুব সুন্দর। আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এই গরুটিই নিয়ে নাও।
সোলায়মান সাহেব মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-আরো আস্তে বল, মামনি। গরুর মালিক শুনলে দাম বাড়িয়ে দেবে।
বিজরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে লালগরুটার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সোলায়মান সাহেব গরুর মালিকের আরো কাছে এগিয়ে এসে কানে কানে জিজ্ঞেস করলেন,
-ভাইজান, গরুটার দাম কত ?
-দুই লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা।
গরুর দাম শুনে সোলায়মান সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মনে মনে ভাবতে লাগলেন- গরুটির দাম দেড় লক্ষের বেশি হওয়া অন্যায়। গরুটি যে বিজরীর খুব পছন্দ হয়েছে তা নিশ্চিত গরুর মালিক বুঝতে পেরেছে । তাছাড়া আমার বাজেট মাত্র ‘এক লাখ’ টাকা।
ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বিজরীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে গরুর মালিককে বললেন,
-ভাই, দেড় লক্ষ টাকা হবে।
-না, ভাই, আমি গরুর দাম বেশি চাইনি। যদি নেন একদাম দুই লক্ষ টাকা দিতে হবে।
সোলায়মান সাহেব মন খারাপ করে বিজরীর কাছে ফিরে আসেন।
বিজরী উৎফুল্ল হয়ে বলল,
-বাবা, গরুটি কি নিয়েছো?
-না, মা, চল আমরা অন্য কোন গরু নেব। গরুর মালিক অনেক বেশি দাম চাইছে।
এই কথা বলে সোলায়মান সাহেব বিজরী সাথে নিয়ে হাঁটতে লাগলেন। বিজরী গরুটার দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কোন অজানা কারণে গরুটিও বিজরীর দিকে তাকিয়ে হাম্বা হাম্বা স্বরে চিৎকার করতে লাগল। উপস্থিত লোকজন বিজরীর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সোলায়মান সাহেব বিজরীকে আপ্রাণ বুঝালেন। কিন্তু বিজরীর সেই একই কথা। লালগরুটা কিনতে হবে।
গরুর মালিকও বিষয়টি লক্ষ্য করলেন। তারপর গরুটির দড়ি হালকা ছেড়ে দিয়ে সোলায়মান সাহেবের কাছে এসে বললেন,
-ভাই, ও কি আপনার মেয়ে?
-হ্যাঁ।
-এভাবে কান্না করছে কেন?
- আপনার গরুটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে। আমারও। কিন্তু আমার বাজেট ছিল এক লক্ষ টাকা। আমি দেড় লক্ষ টাকা বলেছি শুধু আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।
গরুর মালিক একটু ভেবে নিয়ে বললেন,
-শুধু আপনার মেয়ের জন্য গরুটি আমি আপনার কাছে বিক্রি করছি। তবে আমাকে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা দিতে হবে। তাতে আমার খুব একটা লাভ হবে না।
সোলায়মান সাহেব আর কোন কথা না বাড়িয়ে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা মূল্যে গরুটি কিনে নিলেন।
গরুর মালিককে কানে কানে বললেন,
-ভাই আমি আসবার সময় এক লক্ষ টাকা নিয়ে এসেছিলাম। বাকী টাকা বাসা থেকে দেব। প্লিজ আপনি যদি আমাকে একটু সাহায্য করতেন।
গরুর মালিক হাসিমাখা মুখে বললেন,
- চলুন, আমিই আপনার বাসা পর্যন্ত গরু পৌঁছে দিই।
-এ আপনার বদান্যতা। অশেষ ধন্যবাদ।
গরুর মালিক গরু নিয়ে বিজরীদের বাসার দিকে ছুটছে। বিজরী তার বাবার হাত ধরে আনন্দে হাঁটছে। সে মনে মনেতো কী ভাবছে! বাবা যখন গরুকে গোসল দিবেন তখন নিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করবে। গরুকে খাবার দেবার সময় নিজের হাতে দিবে। আরও কতো কী!
বাসায় এনে প্রথমে বাসার সম্মুখের প্রধান ফটকের সাথে বেঁধে রাখা হলো। গরুর মালিক তার পাওনা বুঝে পেয়ে নিজ গন্তব্যে চলে গেলেন।
শুরু হলো গরুর পরিচর্যা। কিছুক্ষণ পরপর ভালো ভালো খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। খাবার দেবার সময় বিজরী ভয়ে ভয়ে গরুর মুখে খাবার তুলে দেয়। গরুটিও মাথা নাড়তে নাড়তে তা মুখে নিয়ে নেয়। এরপর কিছু মুহূর্ত তা চিবিয়ে স্থির দাঁড়ালে বিজরী আবার দেয়।
এই দুই দিনে বিজরী ও লালগরুটির মাঝে খুব ভাব হয়। এক মুহূর্ত সময় পেলে বিজরী গরুটির কাছে ছুটে যায়। আশপাশের লোকজন নিয়মিতভাবে লালগরুটিকে দেখতে আসছে।
আগামীকাল ঈদ। লাল গরুটির পুরো মুখমন্ডলে বিষন্নতা। চোখ থেকে পানি ঝরছে। বিজরী মনে মনে ভাবছে, তবে কি লালগরুটি বুঝে গেছে কাল ঈদের দিন তাকে কুরবানি দেয়া হবে! তা কি করে সম্ভব! ওরা কী মানুষের কথা বোঝে? মনে হয় না। বুঝলে কি আর এভাবে বাঁধা থাকতো। তখন তো দড়ি ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টা করতো।
ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে বাসায় ফিরে আসে সে।
আজ কুরবানির ঈদ। চারিদিকে পশু কুরবানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে
বিজরীদের গরুটির পা ভালো করে দড়ি দিয়ে বেঁধে গলাটা পশ্চিম দিক করে শোয়ানো হয়েছে এবং কিছু লোক পা ও মাথা শক্ত করে চেপে ধরে আছে । গরুটি ভেজা চোখে যেন শেষবারের মতো বিজরীকে ে দেখার জন্য ঘাঁড়টা নাড়াতে চাইল। অদূরে বিজরী বিষন্ন মনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখ দুটো যেন ছলছল করছে।
একটুপর হুজুরকে লাল গরুটির গলায় ছুরি চালানোর প্রস্তুতি নিতে দেখে বিজরী দু’হাতে মুখ ঢেকে দৌড়ে বাসার ভিতরে চলে গেল। আর এইদিকে উচ্চস্বরে ধ্বনিত হলো , ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’।