রামবন্দনা
শাদমান শাহিদ
সব আপনাদের দয়া। এজন্যই বোধ হয়, ঘুরতে ঘুরতে আপনার প্রাসাদে চলে এসেছি।
আরেকটা কথা মা।
কী?
বনের অন্যান্য সরীসৃপ প্রাণী, এই যেমন টিকিটিকি, তক্ষক, বিচ্ছু, কচ্ছপ, গুইসাপ প্রভৃত্তি প্রাণিরাও কীভাবে যেনো আপনাদের জাতে উঠে গেছে। তারা আপনাদের নামের জিগির তুলে আমাদের প্রতি নানান তা-ব চালায়। যখন-তখন যাকে ইচ্ছে ছোবল মারে। একছেলে-দশছেলে বোঝে না। ভাগে পেলেই ছোবল মেরে শেষ করে দেয়। যার দশ ছেলে, সেখান থেকে একটা মরে গেলে শোকটা ততো গাঢ় হয় না। কিন্তু মা, যার একটা মাত্র অবলম্বন, তার কী উপায়? আপনি এসব বন্ধ করে দিন। আর সওদাগর সাবের উপর থেকে আপনার ক্রোধ উঠিয়ে নিন। তাকে সর্বস্বান্ত করেছেন। সাতপুতসহ সপ্তডিঙা গ্রাস করে নিয়েছেন। আপনি তাকে সব ফিরিয়ে দিন। কথা দিলাম, আমরা তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে যেভাবেই হোক— আপনার অনুগত করে আনবো।
তোমরা তো সবই বুঝ, জানো। সওদাগরকে আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। যা হয়েছে, সেটা তার কর্মফল। তোমাদের মতো আমার কয়েকজন ভক্ত তার পরিবারেও রয়েছে। তারা সারাক্ষণ সওদাগরের ভয়ে তটস্থ থাকতো। এখানেই শেষ নয়, গোপনে গোপনে আমার পূজা সাজিয়ে এটা ওটা চাইতো। আমিও সন্তুষ্টচিত্তে সব উজাড় করে দিতাম। বিষয়টা একদিন সওদাগরের চোখে পড়ে গেলো। সেদিন আমার ভক্তরা তার রক্তচক্ষুর ভয়ে একেবারে মাদুলির মতো ছোট হয়ে গেলো। তারপরও সওদাগরের রোষ থেকে তারা বাঁচতে পারলো না। সে তাদেরকে তো শাস্তি দিলোই, সে-সাথে লাথি মেরে আমার মূর্তিসহ পূজার সব উপকরণ গুড়িয়ে দিলো। এরপরও কি তোমরা তার হয়ে উকালতি করবে!
তারপরও মা, তাকে ক্ষমা করে দিন। তার হারানো দিনগুলো ফিরিয়ে দিন। বিনিময়ে আপনি যা বলবেন, আমরা তা-ই করবো। আপনার পরিবারের সকলের মূর্তি ঘরে ঘরে স্থাপন করে পুজো জারি দেবো।
সত্যি বলছো তো?
মা কালীর দিব্যি।
আবার মা কালী কেনো?
ভুল হয়ে গেছে মা। মাফ করে দিন। আর কখনো মুখ দিয়ে আপনার নাম ছাড়া অন্যকিছুু বের হবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে। প্রথমবার হয়েছে বলে মাফ করে দিলাম। এখন যাও। বিশ্রাম করো গে। তোমাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা হচ্ছে। খেয়ে দেয়ে মর্তে ফিরে যাবে।
আচ্ছা।
মা
আবার কী?
আপনি অনুমতি দিলে স্বর্গটা একনজর ঘুরে দেখবার চাই। কুরানে-পুরাণে কতো পড়েছি। পৃথিবীর মহামনীষীরা স্বর্গ-নরক ভ্রমণ করেছেন। আজ এতো কাছে এসে ফিরে যাবো, তা কি হয়!
বাছারা, এটা তো স্বর্গ নয়, পাতালপুরী। স্বর্গে থাকে পার্বতী। বাবা বলেছেন, তোমরা আমার পূজা করলেই আমি দেবী হতে পারবো এবং স্বর্গে স্থান পাবো। এটা আমার বানানো প্রাসাদ। বলতে পারো কৃত্রিম স্বর্গ। যাও, এটাই একনজর দেখে এসো। তবে বেশি দূর যেও না, আশ-পাশটা দেখেই তাড়াতাড়ি চলে এসো।
অনুমতি পেয়ে আমরা কৃত্রিম স্বর্গের বহিরাঙ্গণ ঘুরে দেখতে লাগলাম। মনে হচ্ছে ইন্টারনেটের ভার্চ্যুয়াল সাইটের ভেতর বুঝি ঢুকে গেছি। চোখ ধাঁধানো দৃশ্য। মানচিত্রের দাগের মতো আঁকাবাঁকা পথ। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। কোথাও সবুজ অরণ্যানী। তারপরেই বিশাল বিশাল নদী। এগুলো আমাদের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নয় তো! দৌড়ে গেলাম দেবীর কাছে।
মা, এই জায়গাটা কেমন যেনো চেনা চেনা লাগছে। আসলেই কি তাই?
দেবী তখন মিটি মিটি হাসেন।
তার মানে যা ভেবেছি—। আমরা তখন শতোৎসাহে আরো বেশি করে ঘুরে দেখতে লাগলাম। যতোই দেখি ততোই মুগ্ধ হই আর মহাকবি কালিদাসের জন্যে আফসোস বেড়ে যায়। আহ! তিনি যদি ভাগিরথীর পূর্ব পাড়ে জন্ম নিতেন। নিশ্চয়ই ‘মেঘদূত’এর পা-ুলিপিটা সামনে রেখে আবার নতুন করে ভাবতেন।
আমরা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে থাকি। কখনো নলখাগড়া, কখনো কেয়াকাঁটার ঝোপের ভেতর দিয়ে। তারপরই হঠাৎ টের পাই, পায়ের নিচে কী যেনো মরমর করে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখি মাথার খুলি। এক দুটো নয়, শতশত। ঘটনা কী!
পরক্ষণেই দেখি কেয়াবনে পরতে পরতে কারা যেনো শব্দহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে মাজার-আস্তানার পাগলদের মতো। মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় জটা, কাঁধে ঝোলা।
বিষয়টা কী হতে পারে ভাবতেই মাহবুব রেজা জানায়, লোকগুলো কোনো সাধারণ মানুষ নয়। সাধু-দরগার গাঁজাখোরদের মতো সস্তা পাগলও নয়। ছবি-সুরতে মনে হচ্ছে, এরা তান্ত্রিক। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে এমন বেচুইন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
যা ইচ্ছে হোক, চলো, সামনে এগুই। ঐ দেখো আকাশ ছোঁয়া পাহাড়। নিশ্চয়ই ওটা তাজিন ডং হয়ে থাকবে। চলো, ওটার চূড়ায় গিয়ে ওঠি।
দাঁড়াও, বিষয়টা ভালো কইরা দেইখ্যা লই।
তুমি দেখো, আমরা যাই।
দাঁড়াও না, পাহাড় কি যাইতাছে গা?
লেখকদের এই দোষ, সবকিছুতেই তলা খুঁজে দেখার অভ্যাস।
কবি-সাহিত্যিকদের অতিরিক্ত একটা চোখ আছে জানো তো?
কি জানি, থাকলে থাকতেও পারে।
এজন্যেই লোকেরা তোমাদের নিয়ে বিটলামি করে। কিছুক্ষণ আগেই দেবীর সাথে চমৎকার বাচচিৎ করে এলে। তখন একবারও মনে হয়নি তোমরা বেবোঝ। অথচ এখন চোখের সামনে এতোবড়ো একটা ঘটনা চিৎ হয়ে আছে দেখেও চোখে ধরা পড়ছে না।
কী বলতে চাও?
বলতে চাচ্ছি, এরা সাধারণ সাধু-সন্ন্যাসী নয়। হাতে ত্রিশূল, কপালে চন্দন, সে-সাথে রহস্যময় বিচরণ দেখে মনে হচ্ছে এরা কাপালিক।
কাপালিক মানে?
কাপালিককে চিনতে পারছো না? ঐ যে, বঙ্কিম বাবুর ‘কপালকু-লা’ উপন্যাসের কাপালিক চরিত্রটা?
হা হা মনে পড়ছে। খুব ভয়ঙ্কর চরিত্র ওটা। মানুষ খুন করে রক্তপান আর লাশের বুকে চড়ে বসে তন্ত্র-মন্ত্র সাধনই তার কাজ।
ঠিক ধরেছো। আমার মনে হচ্ছে এলোকগুলো এমনই কোন কারণে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে।
হবে হয়তো।
হবে হয়তো কী? আমার ধারণাই ঠিক। এই দেখো বনের ফাঁকে ফাঁকে কত কঙ্কাল। এগুলো কি এমনি এমনি চলে এসেছে এখানে?
দুরু, কী যে বলো না তুমি। কাপালিক এখানে আসবে কেনো? এখানে যারা আছে তারা সবাই মা মনসার শিস্য।
শিস্য বলেই তো ভয়টা বেশি লাগছে। চলো, অন্য কোথাও যাই, এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
থাক, কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। চলো, দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মর্তে চলে যাই।
হা, চলো।
তারপর চলে এলাম দেবীর কাছে। দেখি তিনি প্রসন্ন মনে কী যেনো ভাবছেন। সে ভরসাতেই বললাম, মা, এসব কী?
কোথায়?
এই যে স্থানে স্থানে স্তুপ স্তুপ মাথার খুলি।
ও একথা। এগুলো কিছু না। যাও। খাবার প্রস্তুত হয়েছে। খেয়ে দেয়ে মর্তে ফিরে যাও।
আমরা তখন খেতে বসি বটে। কিন্তু প্রশ্নটা তখনো মাথার ভেতর লাঠিমের মতো ঘুরতে থাকে।
খাবার পর্ব শেষে দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসবো। এ মনে করে যখন অন্দর মহলের দিকে ঢু মারতে গেলাম, তখনই শুনি কাকে যেনো তিনি ভর্ৎসনা করছেন। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলতে লাগলেন, ওরা যখন ওদিকে যায়, তখন তুমি কোথায় ছিলে? আমার তো মনে হয়, তারা কাপালিকদেরকেও দেখে থাকবে। তখন? হুজুগে বাঙালি বলে কথা, কোনটা থেকে কোনটা নিয়ে দুনিয়া মাত করে দেয়, বলা যায়? যাও, খুলিগুলো এখনই মিশিনে ফেলে পাউডার করে ফেলো। তারপর যা খুশি করো। পারলে ভালো কোনো কোম্পানির নাম লাগিয়ে বাজারে ছেড়ে দিতে পারো। এতেও যদি কিছু আয় হয়। এমনিতেই গবেটের দল পালতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি। সরীসৃপ প্রাণী ছিলাম, ওটাই ভালো ছিলো। কেনো যে দেবী হওয়ার বাসনা জাগলো...
ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন দেবী। ভয়ে আমাদের অবস্থা তখন দেখার মতো। মনসা বলে কথা। অবস্থা বেগতিক দেখলে ছোবল মারতে মুহূর্ত সময় নেবে না। বিদায় পর্বের দরকার নেই। তাড়াতাড়ি জান বাঁচাই। যে চিন্তা সে কাজ। কাউকে কিছু না বলে দ্রুত বেরিয়ে আসতে লাগলাম।
এ সময় মাহবুব রেজা ফিসফিসিয়ে বলতে লাগলো, দেখলে তো আমার ধারণাই ঠিক। এই শালারা কাপালিক। লাশের খোঁজেই এমন বেচুইন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভাগ্যিস ওরা আমাদের দেখতে পায়নি। দেখলে অবস্থা খারাপ হয়ে যেতো। দেবীও তাদের পক্ষেই রায় দিতেন।
সকালে ঘুম থেকে জেগে শুনি রাতে পুলিশ এসে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিকি সাহেবের বড়ো ছেলে বিরোধী দলীয় যুবনেতা মাসুদকে ধরে নিয়ে গেছে। আমাদের জানামতে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। অতএব পুলিশ এখন ধরে নিয়ে গেলেও দুপুর পেরোনোর আগেই ছেড়ে দেবে। এ ভেবে এক প্রকার নির্ভার মনেই বিষয়টাকে পাত্তা না দিয়ে মহল্লার সবাই যার যার কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। আমিও পার্টির অফিসে যাই। রাজেশ দা’র কথা, মাত্র দশ হাজার কর্মী জেগে উঠলে কয়েদখানার প্রতিটা ইট পেঁজাতুলোর মতো উড়ে যাবে। তারপর থেকেই একটু আধটু নড়েচড়ে বসার চেষ্টা। অফিসে গিয়ে দেখি সাজ্জাদ। নাটকে নাকি প্রাণ পাচ্ছে না। পাবে কি করে, সবক্ষেত্রেই যে দাড়িয়াবান্ধা কোটের মতো দাগ আঁকা। এর বাইরে গেলেই আউট। এতো ছকের ভেতর খেলা-ধুলা চলতে পারে কিন্তু শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নয়। বললাম, নাটক তুমি অবশ্যই করবে। তবে সে-সাথে রাজনীতির দীক্ষাটাও প্রয়োজন। পার্টির অফিস যেহেতু চিনেছো, তখন আশা করি ওটাও হয়ে যাবে। তারপর ওকে নিয়ে মার্কেটে গেলাম। দুজনের ইচ্ছে মতো শপিং সেরে অনেকদিন পর স্টার প্লাসে ঢুকলাম। মদের দরিয়ায় ভাসতে ভাসতে অনেক কথাই হলো। একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন্ট করেছে। সেলারি যা শোনালো মন্দ না। বাবা নেই, মা-বোন নিয়ে তিনজনের সংসার। বাবার রেখে যাওয়া ব্যাংক ব্যালেন্স আর চাকরিতে খুব ভালো ভাবেই চলতে পারবে।
(চলবে)