দুঃখের আরেক নাম
হেলাল হাফিজ
রাহাত রাব্বানী
হেলাল হাফিজ । নামটি উচ্চারণ করতে গেলেই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় অনেকটা স্থির হয়ে যাই । কবি হিসেবে যেমন, ব্যক্তি হিসেবেও আমাদের তেমন প্রিয় তিনি। নিজেকে আড়ালে রেখে কবিতায় মানুষ জমিয়ে যাচ্ছেন হেলাল হাফিজ । ব্যক্তি হেলাল হাফিজকে যারা চিনেন বা জানেন না; তারাও জানেন কবি হেলাল হাফিজের নান্দনিক কবিতার নানান পঙক্তি। বিংশ শতাব্দীর শেষাংশে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেন বাংলাদেশের আধুনিক এই কবি । তিনি সেই বিরলপ্রজদের একজন যিনি মাত্র একটি কবিতার বই দিয়ে বাংলা কবিতায় গড়েছেন নিজস্ব আবস্থান । প্রেম-বিরহ-বিপ্লব কোনটি নেই তাঁর কবিতায়? তিনি সময়কে লিখেন কবিতার শরীরে। আর তাই তো ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থানে প্রথম তিনিই লিখেন,
“ এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।”
[ নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় ]
এ দুই পঙক্তিতেই কবি হেলাল হাফিজ অমরত্ব অর্জন করেছেন । কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে এ দুই লাইন । তবে এ কবিতায় সেরা আরেক অংশ হলো প্রেম ও দ্রোহের নিপুণ মিশ্রণ। যা খুব কম কবিই করেছেন ।
“...কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়”
প্রেমের কবিতাতেও কবি হেলাল হাফিজ অনন্য । কবিতা লিখেই প্রেয়সীর সব ঋণ শুধ হয় না, এ সত্য মেনে নিয়েই নির্মাণ করেন-
“...আঙুল দিয়ে আঙুল ছুঁয়েছিলাম বলেই আমার
আঙুলে আজ সুর এসেছে,
নারী-খেলার অভিজ্ঞতার প্রথম এবং পবিত্র ঋণ
তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখে সত্যি কি আর শোধ হয়েছে?”
[হিরণবালা]
বাঙালি সাহসী জাতি। বাঙালির ইতিহাস সাহসিকতার ইতিহাস। নানান ভাবে, নানান সময় বাঙালিরা সেই প্রমাণ দিয়েছে। কবি হেলাল হাফিজ সেই ইতিহাসের ছন্দ থেকে সরে না দাঁড়িয়ে স্বাক্ষী হতে চেয়েছেন। নিজেই বলেছেন-
“...এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষ ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো...”
[ দুঃসময়ে আমার যৌবন]
প্রসঙ্গত যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় পড়ে নিজের ইকবাল হলে ( জহুরুল হক) ফেরেননি হেলাল হাফিজ। যার কারণে ক্র্যাকডাউনের এই রাতে পাক সেনাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনি। ক্র্যাকডাউনে বন্ধু হেলালের খোঁজ নিতে আজিমপুর থেকে ইকবাল হলে ছুটে আসেন আধুনিক বাংলা কবিতার আরো একজন পাঠকনন্দিত কবি নির্মলেন্দু গুণ। কারফিউ তুলে নিলে কবি হেলাল হাফিজ নিজের হলে গিয়ে দেখেন লাশের মিছিল। হলের গেইট দিয়ে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণকে পেয়ে যান তিনি। আর হেলাল হাফিজকে জীবিত পেয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ।
কবি হেলাল হাফিজ নিজেকে নিজেই কবিতায় পরিচয় দিয়েছেন ‘দুঃখের আরেক নাম হেলাল হাফিজ’ হিসেবে। প্রেমিক কবি হিসেবেও হেলাল হাফিজের নিজস্বতা আছে। এক লাইনের কবিতায় তুলে ধরেছেন শতসহস্র শতাব্দীর গভীর প্রেম। যা বাংলা সাহিত্যে অনন্য সংযোজন।
“তোমার বুকের ওড়না আমার প্রেমের জায়নামাজ!”
[ ওড়না ]
বলা হয়ে থাকে, তরুণ-তরুণীদের প্রেম নাকি অনেকাংশে অসম্পূর্ণ থাকে হেলাল হাফিজের কবিতা ছাড়া। বিরহে কাতর প্রেমিকের কাছেও কবি হেলাল হাফিজের কবিতা তুমুল আলোচিত।
“...ইচ্ছে ছিলো রাজা হবো
তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে,
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে।”
[ইচ্ছে ছিলো]
প্রেমিকার প্রস্থানে লিখেছেন-
“এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো,পত্র দিয়ো,
.................................................................
আর না হলে যতœ করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?
আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?
এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতোটাই বা কষ্ট দেবে!”
[প্রস্থান]
নিঃসঙ্গতায় কবি বলেন-
“কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না”
[যাতায়াত]
এসব ছিলো কবিতায় হেলাল হাফিজের আংশিক পরিচয়। ব্যক্তিজীবনেও হেলাল হাফিজ এক বিস্ময়ের নাম, ঘোরের নাম। অদ্ভুত এক ভালোলাগার নাম। যা তাঁকে মৌলিক কবি হিসাবে গড়ে তুলতে অধিক কাজ করেছে। আজন্ম মানুষ তাঁকে পুড়াতে পুড়াতে কবি করে তুলেছেন, এ স্বীকারোক্তি তিনি নিজেই দিয়েছেন। জন্মের পর মাকে হারান। সেই কষ্ট তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে। কিন্তু এ কষ্টই যেন তাঁর বেঁচে থাকার হিরণময় হাতিয়ার; জীবনের পরম অর্জন।
“কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মতো ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।”
[ ফেরিওয়ালা]
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর পিতা খোরশেদ আলী ঔরসে এবং মাতা কোকিলা বেগমের গর্ভে নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করেন হেলাল হাফিজ। ১৯৬৫ সালে নেত্রকোণা দত্ত উচ্চ বিদ্যালইয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৭ সালে নেত্রকোণা কলেজ থেকে এইচএসসি পশ করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়ই তৎকালীন জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বদেশে যোগদান করেন তিনি। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এই পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে তিনি দৈনিক দেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন এবং সর্বশেষে দৈনিক যুগান্তরে কর্মরত ছিলেন।
ব্যক্তি হেলাল হাফিজের সাথে আমার পরিচয় অনেকদিনের। গভীর এক বন্ধন আছে তাঁর সাথে। আর এ কারণেই তাঁকে আলাদাভাবে, আলাদা করে জানতে পেরেছি; কতোটা আত্মমর্যাদায় ঋদ্ধ কবি তিনি। কবিতার জন্য স্বেচ্ছায় নিঃসঙ্গতা বরণ করেছেন। সংসার করেননি। পড়েননি মেডিকেল। কর্ণফুলি হোটেলের এক ছোট্ট ঘর আর প্রেসক্লাব সীমানায় নিজেকে আটকে রেখে জমাচ্ছেন মানুষ। ভালোবাসা বিলিয়ে দিয়ে কবি হেলাল হাফিজকে ছাড়িয়ে ব্যক্তি হেলাল হাফিজও তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়। আকাশের চেয়ে অধিক এই উচ্চতা। তখন ব্যক্তি হেলাল হাফিজ লিখেন-
“কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন-
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।”
[রাখালের বাঁশি]
এতো এতো ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠা কবি হেলাল হাফিজ নীরবেই হারাচ্ছেন তাঁর দৃষ্টিশক্তি। তাঁর চারপাশ ছেয়ে যাচ্ছে নিকষ অন্ধকারে। অভিমানী এ কবি নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়েই বেঁচে আছেন, মেনে নিচ্ছেন সব। কিছুই বলছেন না। কারণ তিনি জানেন, তিনি হেলাল হাফিজ। আর কবির এ দুঃসময়ে কবির সহোদর নেহাল হাফিজ উচ্চারণ করেনঃ
“কবিতায় বামহাত দিয়েছিলে, বাম-
চোখটাও স্বেচ্ছায় দিয়ে দিলে!”
হেলাল হাফিজের মতো মৌলিক ও পাঠকপ্রিয় কবি আমাদের খুব বিরল। তাই দেশের দায় কিছুটা মুক্তির জন্য হলেও হেলাল হাফিজের চিকিৎসা নিশ্চিত ও বাস্তবায়ন করা জরুরী ।