শুভ্র শরতে কাপাসিয়া কলেজ ক্যাম্পাস
শামীম শিকদার
কয়েকদিন ধরে কোন বৃষ্টি হয় না। তাই পুরো কলেজ ক্যাম্পাসটিতে কেমন যেন একটি ফ্যাকাসে ভাব। কলেজের মাঠের দূর্বা ঘাস গুলোও যেন শুকিয়ে বিবর্ণ সবুজ রঙ্গে পরিণত হয়েছে। উত্তর পাশ দিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসের মূল ফটকে প্রবেশ করতেই মাঠ পেরিয়ে পুকুর পাড়ের পশ্চিম পাশের সাদা সচ্ছ কাশ ফুল গুলো এলোমেলো বাতাসে উড়ছে, তা স্পষ্ট চোখে পড়ে। কিন্তু শুভ্র শরতের স্নিগ্ধ এই প্রকৃতিতে কোথায় যেন একটি শূন্যতা জড়িয়ে আছে । আকাশ বেশ মেঘলা, সাদা মেঘের টুকরো গুলো এদিক সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে; দেখলে মনে হয় যে কোন সময় অঝরে কান্না শুরু করবে। হঠাৎ করেই টুপটাপ বৃষ্টিতে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে বৃষ্টি প্রেমিদের জন্য আনন্দের একটি জোয়ার বয়ে গেল। মাঠের বিবর্ণ সবুজ দূর্বা ঘাস গুলো পরিপূর্ণ ভাবে তাদের প্রাণ ফিরে পেল। পুরো মাঠে সবুজের ছোঁয়ায় সহজেই দৃষ্টি কাড়ছে চোখের। আমি, কিবরিয়া, ইয়াসিন, শান্ত সহ আমরা প্রায় ৬-৭ জন একাউন্টিং ডিপার্টমেন্টে অবস্থান করছি। আমাদের ডিপার্টমেন্টের ভবনের ঘা ঘেসে আকাশি গাছ গুলো ভিজে জবুথবু হয়ে নিরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টিটাও বড় বেশি বায়না নিয়ে আসে। এই আছে, এই নেই; কখন নামবে, কখন থামবে বুঝারও কোন ঝোঁ নেই। গাছের ডাল থেকে পানি ছিটকে গ্রিল বেধ করে শরীরে লাগছে। শীতল পানিতে মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা হচ্ছে পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে উদাস মনে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু না, আমার আবার বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা জ্বর পিছু ছাড়ে না। ভিজার লোভটিকে হালকা সামলিয়ে সিড়ি দিয়ে তিন তলা থেকে নিচে নমলাম। আমার বৃষ্টিতে ভিজার ভয়কে উপেক্ষা করে অনেকেই ভিজেছে, তবে তা কাক ভেজার মতো। তাদের মতো ক্যাম্পাসের ভিতরের কাশফুল গুলোও ভিজেছে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে সব গুলো ফুল এক সাথে জমাট বেধে নিরবতা পালন করছে। মঝে মাঝে বাতাসের ধাক্কায় সে নিরবতা ভেঙ্গে নিজেদের রূপকে জাগিয়ে তুলছে। কাশ ফুল মিশ্রিত সবুজ বাগানের পাশেই কিছু লোক ধান ক্ষেতের পরিচর্চা করছে। আমন ধান, যা হেমন্তকালে ঘরে তোলা হবে। খুব দ্রুত দৌড়ে এক কৃষানী বাড়ি থেকে ছুটে আসছে। কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। ভাবলাম কোন বিপদ হলো না কি! কিন্তু না, মাঠের এক কোণায় গাভী বাধা রয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে থরথর করে কাপছে গাভীটি। তা নিতেই কৃষানী দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। মাঠ পেরিয়ে ক্যাম্পাসের পূর্ব পাশে যেতেই চোখে পড়ল কিছু ছোট ছেলে-পেলে পুকুরে হৈইচই করে গোসল করছে। আবার কেউ কেউ পুকুর থেকে লাল শাপলা তুলছে।
তাদের এমন গোসল করা দেখে মনে পড়ল শৈশবের সেই দিনগুলোর কথা। ক্যাম্পাসের ভিতরে দু’টি বড় বড় বকুল ফুল গাছ। তার নিচে বসার মতো সুন্দর নান্দনিক জায়গা। সেখানে বসে যে কোউ পুরো ক্যাম্পাসের চিত্র খুব সহজে উপভোগ করতে পারবে। আমিও তার ভিন্ন কিছু নয়। একটু ভিন্ন সাজে পুরো ক্যাম্পাসটি দেখতে মোটেও মন্দ লাগছে না। তবে মনে মনে ভাবছি, এই পুরো ক্যাম্পাসে আমিই কি শুধু প্রকৃতি প্রেমী একজন। না হয়তো অনেকেই। বৃষ্টি থামতে দেরি হলেও সকলে ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে আসতে দেরি করেনি। বৃষ্টি ভেজা মাটির ঘ্রাণে নিরবে মনের ভিতরে প্রকৃতির প্রতি এক অনবদ্য সম্পর্ক সৃষ্টি করে। ইউনির্ভারসিটির ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি কলেজের ছোট ভাই-বোনেরাও মাঠে নেমে এসেছে। শিক্ষকরাও রুমে বসে নেই। শান্ত প্রকৃতির টানে সকলের মনের ভিতরে সঞ্চারিত হচ্ছে অজানা কিছু সুখ। এমন দিনে প্রিয় জানকে নিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে অজানা কোন দেশে। এতক্ষেনে কাশ ফুল গুলো পুনরায় মাথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠেছে। সূর্যের আলোতে ভেজা ফুল গুলো নিশ্চয় ঝলমল করছে। আমি ও কিবরিয়া পুনরায় চলে গেলাম বৃষ্টি ভেজা কাশফুলের হাসি দেখার জন্য।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্র খোদাদিয়া গ্রামে ছিল জমিদার রামনাথ রায়ের বাড়ি। জমিদার রামনাথ রায়ের মৃত্যুর পর তার তিন পুত্র ভূবতি চন্দ্র রায়, পরেশ চন্দ্র রায় ও প্রাণ গোপাল রায় একে একে জমিদারি স্টেট পরিচালনা করেন। আরেক পুত্র মহেন্দ্র চন্দ্র রায় অন্যত্র বসবাস করেন। প্রায় সাত হাজার বিঘা জমি নিয়ে জমিদারি স্টেট পরিচালিত হতো। এ বাড়ির নাটমন্দির ও রন্ধনশালায় বছরব্যাপী হতো পূজাপার্বণ। বিশেষ করে দুর্গাপূজায় বসত নাট্যোৎসব ও সংগীতের আসর। বিভিন্ন জায়গা থেকে নামিদামি শিল্পীরা এসে উৎসবে যোগ দিতেন। চলত মাসব্যাপী যাত্রাপালা।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ ও ১৯৫১ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর পরেশ চন্দ্র রায়, প্রাণ গোপাল রায় ও মহেন্দ্র চন্দ্র রায় পরিবার-পরিজন নিয়ে পাশের জুনিয়া ও সাফাইশ্রী গ্রামে চলে যান। তবে ভূবতি চন্দ্র রায় কাপাসিয়াতেই থেকে যান এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। যার মূল জমিদার বাড়িটিতে এখন কাপাসিয়া কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যা স্থাপিত করা হয় ১৯৬৫ সালে। ২১ একর জায়গা নিয়ে এ কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলেও সংস্কার করা হয়নি জমিদার বাড়িটি। ফলে জমিদার বাড়ি এখন শুধুই কালের নীরব সীসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এমন বিশাল বিস্তৃতি সম্পন্ন কলেজ ক্যাম্পাস গাজীপুরে ভিতরে দ্বিতীয়টি আর নেই। প্রকৃতির ছোঁয়ায় ক্যাম্পাসের প্রতিটি স্থানই দৃষ্টিনন্দন। ঘন সবুজ ঘাস ও গাছ-পালায় আরো বেশি নান্দনিক করে তুলে প্রতিটি মূহুর্ত।