মেঘের সফেদ জমিন
আনোয়ার কামাল
ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দু ঘাসের ডগায় চুমু দিয়ে যায় মেঘপুঞ্জ ধেয়ে আসে, উড়ে যায় সোনালি ডানার শঙ্খচিল পাখনা মেলে দেয় নীলাকাশ হাতছানি দেয় তুলো তুলো মেঘের সফেদ জমিন ফেরি করে, কাশবনে ছেয়ে থাকে নদীর কিনার চরাঞ্চল আর মেঠোপথ। ডাহুক পাখির বাসা জেগে ওঠে পদ্মার চরে পল্লির প্রলেপ লেপ্টে থাকে কিষাণির পাজরে। আবার গড়ে ওঠে বসতি ঝির ঝিরে উত্তরে হাওয়া গা শির শিরে বার্তা নিয়ে আসে। আমিও বেসামাল হই খুঁজে ফিরি চেনা মুখ ধূসর পাণ্ডুলিপি; বেদনায় বিদীর্ণ মন সহসা উথলে ওঠে প্রেমময় মেঘের ভেলায়- তুমিও শরিক হও, আমরা দু’জন ভেসে বেড়াই নায়ের গলুই ধরে জলের ছোঁয়া নিয়ে ভেজাই উদোম শরীর।
শরতের মাঠ
হাসান ওয়াহিদ
হলুদ ডানাঅলা একটি পাখির মতো
মাঠটা আমার সামনে ভাসছে
নরম আউশ ধানের
ক্ষেতে বসে প্রকৃতি
দু’টো ভালোবাসার কথা লিখে
উড়িয়ে দিচ্ছে হাওয়ায়।
বনপথে দেখা মিলছে
মন কেমন করা পাখির-
এখনও তীব্র রোদ
নসিমন অন্যত্র থেমেছে।
শরতের মাঠ নিয়ে যাচ্ছে সৃষ্টির দিকে।
শরতের খেরোখাতা
রাজু ইসলাম
রৌদ্রের প্রকান্ড প্রকান্ড চাইগুলো মাথায় নিয়ে
ঘুরে বেড়ায় আশ্বিনের জমজ বোন ভাদ্র
(তারা উভয়ে বিধবা শরতের কন্যা)
তা দেখে ভাদ্র’র দু’চোখের ভ্যাপসা জল
ঝরতে থাকে বায়ূমন্ডলের শরীর বেয়ে
কিন্তু তারা ছুঁতে পারে না স্বস্থির শরীর;
তাড়াতে পারে না দস্যি ভ্যাপসা গরমকে
সে ওদের উভয়েরই শত্রু; কেননা সে
ওদের মা শরতের প্রাণ নিয়েছিলো
পদ্মা বিধৌত ইছামতির জলে ডুবিয়ে।
তাই মন উদাস করে কাশ ফুলে ফুলে
নদীতীরে পরে থাকা বিধবা শরতের।
কিন্তু লাবণ্যময়ী শরতের রূপে পাগল
হয় আকাশ ও বিকেল। তারা একে একে
মুগ্ধতা দিতে থাকে ক্ষণজন্মা শরতকে
তবু তার করুণাকে তারা ছুঁতে পারে না
সে দেখে নিতে চায় তার দুই মেয়ে
ভাদ্র ও আশ্বিন তাদের পিতৃহত্যার
প্রতিশোধ নিতে ভ্যাপসা গরমকে
ইছামতি ও পদ্মার ধারে নিয়ে এসে-
ঘোলা জলে ডুবিয়ে মারতে পারে কিনা
পদ্মা-ইছামতিও তাদের সহায়তায়
ফুপিয়ে উঠে আসতে থাকে তীরের দিকে
অতপর হেমন্তের শিশির এসে ছিনিয়ে নেয়
শরতের শাড়ী, যা সে শুকাতে দিয়েছিলো
নদীতীরে কাশফুলেদের গায়। স্বামী হত্যার
প্রতিশোধ আর দেখা হয় না বেচারী শরতের
আবারও নিদারুণ অপেক্ষা দশটি মাসের।
শরৎ মেয়ে
ঊষার মাহমুদ
কাশফুল দোলাতে দোলাতে হেঁটে যেতেন
বিকেলের নরম রোদের ভাঁজ ভেঙে;
শরতের মতোই শুভ্র হাসি, তাই নাম দিয়েছিলাম শরৎ মেয়ে!
পাখির মতো ডানা মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে উড়ে যাওয়া মেঘের সাথে ছিলো কথোপকথন থথ বৈরি বাতাসে উড়তো আপনার চুল, আর আমি দূর থেকে আপনার শরীর ছুঁয়ে আসা বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতাম।
কবি, এখনো কি সবুজ শাড়ির আঁচল ছেড়ে, খোলা চুলে হাঁটতে আসেন, গোমতি নদীর তীরে?
কতোদিন হয় দেখিনা আপনার পায়ের বদল...
জীবন্ত কবিতা যেন পথ চলতো বুকের পাশ দিয়ে!
চশমার ওপাশের জোড়া চোখ, খুব মনে পড়ে।
সংসার নামের অজুহাতে আত্মসমর্পন, শুনেছি কবিতা লেখেন না এখন আর-
মনেপড়ে, সেদিন হুটকরে ভালোবাসি বলে ফেলেছিলাম! পাথর চোখে তাকিয়েছিলেন,
তার পর নীরবতার রেখা টেনে সেই যে চলে গেলেন আর ফিরলেন না-
শরৎ এলে কাঁশফুল দোলাতে দোলাতে আপনার হাঁটা নকল করি, আর ভাবি সত্যিই কি অতটা অপরাধী আমি, যতোটা দূরে চলে গেছেন...
সুগন্ধী রুমাল
আরিফুর রহমান
(উৎসর্গঃ চিত্রশিল্পী পার্বতী ঘোষ)
আহা, এমনই উড়ো হাওয়ার দিনে তুমি ছিলে।
শারদ জলে মুখ দেখে ফেরা পাখির পালক, ডানা ঝরা বিন্দুগুলো, সবুজ ধানক্ষেত, ভেজা ঘাস, ঈষৎ সান্ধ্য রঙ... তোমার প্রিয় ছিল; আমারও
তারপর সেইদিন, তোমাকে নিয়ে যাওয়া- ধ্যানী বকের ছোবলের মতো হঠাৎ- আমার মনকে সার্বজনীন দ্রাবক করে দিয়েছে। দ্যাখ, কোন কষ্ট নেই, কোন দাগ নেই
শুধু এখনও, সুগন্ধী রুমালের স্মৃতি ভাঁজ করা থাকে বুক পকেটে। ওটা ছাড়া তোমার না বলা কথাগুলোর স্পর্শ পাওয়া হতো না
কাশফুলে ছেয়ে যাবে
নূরনবী সোহাগ
মন্ত্রমুগ্ধের মত কান পেতে আছি
ও চোখ কখন বলবে-
খুলে রেখেছি কাজলের হার।
আমি কেবল তোমার জন্যই
সাদাসিধে চিরকাল।
দেখো, শৈলজ অন্ধকার
মেখেছি দীর্ঘ চুলে
ঘুরেফিরে এসে- এ গাঢ়তায়
মিশে যেও ইচ্ছে করে
এই যে দেখো, নখভর্তি স্বচ্ছমেঘ
তুমি ঠোঁটের কোমলতা দিও
কাশফুলে ছেয়ে যাবে হৃদয়ের চারদিক
শরৎ ট্রেন
সজল কুমার টিকাদার
বাংলার স্টেশনে দাঁড়িয়েছে শরৎ ট্রেন।
দরজা ঠেলে একে একে নেমে আসে
খরগোশ মেঘ, সমুদ্র বর্ণ আকাশ,
পোয়াতি ক্ষেত, শামুকের মত শান্ত নদী
অবশেষে কিশোরী শিউলি।
নরম রোদে ডানামেলে ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়ে
প্রজাপতি খুশি।
বহুদিন পর যে আজ ঘরে ফিরেছে দূরবাসী!
ঘন বাঁশবন আর কাশ ফুলে দেখি
সবুজের ডালি নিয়ে স্বাগত মাথা নাড়ে।
তোমাকে বলার কিছু নেই
যাহিদ সুবহান
তোমাকে বলার কিছু নেই
বয়ে যায় সময় এই শরতবেলায়
আমার শারদীয় শুভেচ্ছা নিও।
যদি পারো কাকডাকা ভোরে
দূর্বায় জমে থাকা শিশিরের কাছে
আমার খবর নিয়ে নিও।
ঘাটপোড়া নদীর কাছে যেও একা
পানসিতে চড়ে চড়ে নদীর বুকে
শাদা কাঁশেদের কুশল জেনে নিও
শেষ বিকেলে বিষন্ন থাকে যদি মনটা
সবুজ মাঠের বুকে দাঁড়িয়ে
আকাশের তুলোমেঘ দেখে নিও।
যদি দিতে চাও কোনো খবর
হৃদয় গহিনের কথা কোনো
শাদা বকেরা ঘরে ফিরলে গোধুলিতে
ওদের কাছে বলে দিও।
যদি কাছে পেতে চাও আরো এই শরত সন্ধ্যায়
তবে রুপালী জোসনায় আমাকে খুঁজে নিও।
প্রিয়া, তোমাকে বলার কিছু নেই
আমার শারদীয় শুভেচ্ছা নিও...
এ দৃশ্য শুধু তোমার’ই
মোঃ মাসুদ রানা
গাঢ় নীল আকাশ,
সোনা ঝরা রোদ,
শিমুলের তুলোর মতো ভেসে চলা সাদা মেঘের ভেলা।
নদীর ধারে মৃদু মন্দ বাতাসে
দোল খাওয়া সাদা সাদাকাশফুল,
সাদা বক, পাখ-পাখালি দলের সারি সারি মেলা।
আকাশের উজ্জ্বল নীলিমা,
বাঁশঝাড়ে ডাকে কালো ডাহুক,
পুকুর পাড়ে তাল নারিকেল গাছে বসে থাকা শিকারী মাছরাঙা।
বাতাসে ছোট ঢেউ তুলে নদীতে,
পাল তুলে চলে নৌকা,
মোহনীয় চাঁদনী রাত, মায়াবী রূপ আঁধারের বুকে
উড়ে বেড়ানো জোনাকীর আলো রাঙা।
চারদিকে বহে যাওয়া মৃদু মন্দ বায়ু,
শিউলী কামিনী হাসনাহেনা,
ফুলের গন্ধে মাখামাখি মিষ্টি বাতাস, প্রকৃতির মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা।
দিগন্ত জুড়ে সাতরঙা হাসি,
ফুটে ওঠা নীলকমলিনী রংধনু
প্রভাতের শীতল উষ্ণতা, কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙানো ভোরে ওঠা।
হে শরৎ,
এ দৃশ্য শুধু তোমার’ই।
তুমি’ই শুভ্রতার ঋতু ও
তুমি’ই মোহনীয় ঋতু।
তুমি’ই ঋতুর রানী।
শরৎ কুমারী
নীলা হোসেন
শরৎ সন্ধ্যায় দূর দিগন্তে-
অল্প কিছু মেঘ উঁকি দিয়ে আছে
ঐ পাহাড়ি সাদা কাশফুল প্রান্তে।
শরতের বিলাসী পবনে এক টুকরো
শিমুল তুলো কাশফুলের কানে কানে
বিমুগ্ধ কম্পিত সুরে দীপ্ত ভাষায় বললো-
চলে এসো শুভ্র বলাকার ছন্দিত
ডানায় ভর করে আমরা হারিয়ে যাবো
ঐ দূর আকাশে গোলাপি মেঘ পটে।
মেঘ বালিকার কণ্ঠে সুরভিত বৃষ্টি সুর ভাসে
দূর নীলিমায় বেহালা অঙ্গনে।
শরৎ সুবাসিত এলোমেলো কাশফুল
চঞ্চলা হেমন্তের উঠোনে
স্বর্ণময়ী ধানের শীষে ঢেউ দোলানো
মন মাতানো প্রমোদ তরী বয়ে চলে।
ফিরবো না কখনো শাশ্বত রয়ে যাবো
শরতে ভাসন্ত খ- খ- শুভ্র মেঘ অঞ্চলে,
যেখানে শরৎ কুমারীর হীরক অঙ্গে
কাশফুলের শাড়ীর আঁচল বাতাসে দোলে।
পিতৃপক্ষ
মঞ্জিমা গাঙ্গুলী
সোনার সূর্যের পাশে যে লোকটি হেঁটে যায়
ভর করে টিকে থাকা ডানার প্রজাপতি-
পিতৃপক্ষে যার গায়ে হলুদ ফুল ফোটে
অলকানন্দা মাখামাখি হয়ে যায় নির্মেঘ।
সেই লোকটি লোডশেডিংএ ভয় পায় না
গিটার, হিমালয়, নাটকের মহড়া ছেড়ে
লোকটি এখন বটগাছ।
আমার শরত শুধু মাতৃপক্ষ না।
শরত আমার বাবার মতোন টলটলে নদী,
একথালা আশ্বিনের ডালিম রঙের চাঁদ।
শরতের কবিতা
ইয়ার ইগনিয়াস
হাটে হাটে ফুটে আছে পেয়ারার সবুজ
গল্পের কুঁড়ি ঝরে গেছে কতো পেয়ারাকাল!
ইশারায় ডাকতো সুপুরিবনের হাওয়া
শালিকের ডাকে ডাকে কতো খুনসুটি
লুকিয়ে রেখেছি দীঘল কুন্তলতলে
চাঁপাফুলের সৌরভে
স্মৃতির ডরমেটরিতে শুয়ে আছে
সেইসব ঘুড়ি-উড়া বিকেল
বিশ্বাসের বিশুদ্ধতায় বন্দী ছিলেম আমরা
ভ্রমর-ভ্রমণে পুষ্পের পায়তারা যেমন
হলকা-হাওয়ার শরতেই ছুট ‘শর্তহীন শর্তে’
পরতে পরতে জড়িয়ে আছি শূন্যতার সামিয়ানা।
কাঙাল
নাঈম হোসেন লেনিল
একবার ভুল করে হলেও
তুই আমার তৃষ্ণার্ত হৃদয়টা খুলে দ্যাখ-
তুই আমার বিবর্ণ ম্লান হৃদয়টা খুলে দ্যাখ-
তুই আমার বেদনাহত হৃদয়টা খুলে দ্যাখ-
আমি তোর কতটা কাঙাল?
আমি রক্ত দিয়ে স্কেচ করেছি শুধুই তোর নাম
মুছে দিতে পারলে মুছে দে
মুছে দিতে না পারলে-
তুই আমার চোখে অশ্রুকণা মুছে দে
অদৃশ্য কন্দলেই মৌনতা পিষে ফেল
শুভ্রতা ছড়িয়ে দে, বিষাক্ততা পুড়ে দে
তোর কোলেই আলোর বাতি জ্বালিয়ে দে
আজীবন অফুরন্ত ভালবাসা ঢাল
আমি তোর রক্তেই তোর গন্ধেই কাঙাল।
শরৎ এনেছে প্রেমের মেলা
রোকেয়া রিক্তা
তুমি দেখেছ বেত্রাবতী?
কাশফুল আর সাদা মেঘের আজকে আবার দেখা, বৃষ্টি ধোয়া শরতে
দুই সখা-সখির
প্রেম চার চোখ এক হয়েছিল, ঝিরঝিেের বাতাস স্নিগ্ধ বিকেল পরতে ।
কতশত প্রেম-বিরহের সুখ-দুখ জমানো কথা
দুজন দুজনে কয়;
পাঁচটি ঋতুর পর্ব শেষে এসেেেছ ওদের
শরৎ প্রেমময়।
তবুও দেখ, ভুলেনি ওরা কেউ কাউকে
ভালোবাসাবাসি সারাদিন ।
আজ কাশ আর সাদা মেঘের প্রেমে
ভরে গেছে আকাশ জমিন!
নদী তীর জুড়ে সাদা কাশবনে হাসি-খুশির
উপচে পড়া মেলা
আকাশের গায়ে পেজাতুলো মেঘ ভাসায়ে
প্রেমের ভেলা
হাসিতে-খুশিতে হয় কুটি কুটি । নেচে-গেয়ে
দিন সারা;
সারাটা আকাশ-জমিনে তাদের সে প্রেম
ছড়ায়ে দিল কারা !
কাশ যেন চাই উড়াল দিতে প্রিয়তম মেঘের বুকে !
পেজাতুলো মেঘ অপলক চেয়ে থাকে
কাশ প্রেয়সীর মুখে ।
জমিনে কাশের বাড়ি, আকাশে সাদা মেঘ
মাঝপথ দূর্গম ধু ধু!
হোক দুরত্ব ! তবু ভালোবাসে । ভালোবাসাবাসি,
ভালোবাসাবাসি শুধু।
মনে হয় যেন, দুর দিগন্তে আকাশের মেঘ
প্রেয়সীর ঘরে আসে ,
হয়তো কোনো নির্জন নদী তীরে কাশ
লাজুক আদরে ভাসে!