গুড়ের জিলাপি
অনন্ত পৃথ্বীরাজ
তখন বিকেল। জাফর সাহেব বাজারে যাবেন। তাই কার কী লাগবে জানতে চাইলেন। লিস্ট থাকলে বাজার করতে সুবিধে হয়। ‘দাদু, তোমার আব্বুকে বলো আমার পান শেষ হয়ে গেছে। আর তুমি কী খেতে চাও? গুড়ের জিলাপি? ঠিক আছে। আব্বুকে বলে এসো। তবে একদম চুপিচুপি। দেখো, তোমার মা যেন জানতে না পারে। তাহলে বকবেন।’ কোহিনুর বেগম তার নাতি সুপ্তকে এসব কথা শিখিয়ে দিলেন। কিন্তু অত শত চিন্তা করার সময় নেই সুপ্ত’র। সে পাশের রুমে ঢুকেই নামতা পড়ার মত বাবাকে বলল, ‘দাদির পান শেষ হয়ে গেছে। আমার জন্য জিলাপি এনো।’ মা পাশেই ছিলেন। তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ‘দেখেছো বুড়ির আক্কেল জ্ঞান। এইটুকু বাচ্চার কাছে পানের বায়না পাঠিয়েছে। তোমাকে আগেই বলছি, মানে মানে আপদ বিদায় কর। বসে বসে শুধু ছেলের অন্ন ধ্বংস করছে। ক্যান, ছেলে কী তার এই একটাই? আর গুলার কাছে পাত্তা পায়না, বুঝলে। বাপের বড় ছেলেরা কী সব কী তোমার মত ভাদাইমা হয়?’ এরপর প্রায় আরও আধা ঘণ্টা মা কথার তুড়ি ছুটালেন। ততক্ষণে বাবা বের হয়ে গিয়েছেন। দাদির রুম আর বাবা-মার রুম পাশাপাশি লাগোয়া। দাদির কান এখনও পরিস্কার । সুপ্ত আবার যখন দাদির কাছে ফেরত আসল, তখন দাদি তড়িঘড়ি করে নিজের চোখ মোছায় ব্যস্ত।‘ দ্যাখ না দাদু ভাই! কী সব ছোট ছোট পোকা শুধু চোখের ভেতর চলে যেতে চায়।’ দাদি যে কিছু একটা লুকাচ্ছেন তা বোঝার বয়স তখনও সুপ্তর হয়নি। সুপ্ত’র দাদি কোহিনুর বেগম গ্রামের মানুষ। শহরে তার মন একদম পোষ মানে না। সারাক্ষণ গ্রামে যাওয়ার জন্য মনটা কেমন আনচান করে। কিন্তু গ্রামে আপন কেউ থাকে না। সব খালি পরে থাকে। দেখারও কেউ নেই। অথচ এক সময় সবাই ছিল। এক কৃষক পরিবারে বিয়ে হয়েছিল দাদির। তার শাশুড়ি ছিল বড্ড দজ্জাল। নুন থেকে চুন খসলেই বাড়ি মাথায় তুলতো। সুপ্তর বাবা তখন পেটে। একবার খুব অসুখ করেছিল তার। ডাক্তার সব দেখে-শুনে শাশুড়িকে খুব বকা দিয়ে ছিলেন। ‘আপনি কী মানুষ , না ডায়নি। এ সময় কেউ পোয়াতি বউকে এভাবে খাটায়। আপনি কী ছেলে বউ আর গর্ভের সন্তানকে মেরে ফেলতে চান?’ কোনো কথা বলতে পারেনি শাশুড়ি। ডাক্তারের পায়ে পরে ছেলের বউ আর গর্ভের সন্তানের জন্য মাথা ঠুকেছে। নামাজে বসে দোয়া করেছে। একটি সুস্থ পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছিল কোহিনুর বেগম। পরিবারের সবাই কী যে খুশি হয়েছিল বলে বোঝানো যাবে না। তারপর শাশুড়ির স্বভাব একদম বদলে গেল। তিনি নিজের মেয়ের চেয়েও আপন করে নিলেন কোহিনুর বেগমকে।
নিজে এসে চাবির গোছা আঁচলে বেঁধে দিয়ে সংসারের সকল দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন তাকে। আর শাশুড়ি মাতলেন তার নাতিকে নিয়ে। এক মুহূর্তে অবসর নেই। আজ এত বছর পর মৃত শাশুড়ির কথা মনে করে চুপিচুপি কাঁদলেন কোহিনুর বেগম। সুপ্ত’র বাবা তখন খুব ছোট। বড্ড জ্বালাতন করত তাকে। প্রচন্ড শীতের রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে। কোহিনুর বেগমও সন্তান কোলে নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। এমন সময় ছেলে পানির কল চালিয়ে দিয়েছে। মুহূর্তে সারা শরীর ভিজে একাকার। কোহিনুর বেগম শীতে ঠকঠক করে কাঁপছেন। কিন্তু ছেলেকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দেয় নি। বরং ভেজা গা মুছে নিয়ে গরম কাপড় দিয়ে পরম মমতায় আগলে রেখেছেন বুকের মানিক; সন্তানকে। আর আজ....? তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ছিল একটি সুখের সংসার। খুব কষ্ট করে সন্তানদের মানুষ করেছেন। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের পড়ার খরচ যুগিয়েছেন। মুরগির ডিম, গরু, ছাগল বিক্রি করে সন্তানের জন্য টাকা পাঠিয়েছেন। সন্তানেরা আজ সবাই উচ্চ শিক্ষিত। চাকরিও করছে। অথচ মানুষটি দেখে যেতে পারল না। তাকে একলা করে দিয়ে মানুষটি চলে গেল। নাহ! সে চলে যেয়ে ভালই করেছে। সন্তানদের এমন আচরণ দেখলে মানুষটি নিশ্চয়ই মেনে নিতে পারত না। সুপ্ত’র কণ্ঠস্বরে সংবিৎ ফেরে দাদির। ‘অমন করে কী ভাবছ দাদি।’ ‘নাহ, দাদু ভাই তেমন কিছু না। তোমার টিচার আজ পড়াতে আসবেন না?’ ‘হ্যাঁ, একটু পর আসবেন।’ ‘তাহলে তুমি হোমওয়ার্কগুলো করে ফেল, কেমন?’ সুপ্ত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আজ কোহিনুর বেগমের কেন যেন মন খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। পুরনো স্মৃতিগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠছে। স্মৃতিচারণ করা বৃদ্ধ বয়সের একটি রোগ। কেউ শুনুক বা নাই শুনুক এ বয়সে বকবক করা লোকের স্বভাব। মানুষটি তাকে খুব ভালোবাসতো। হাট বাজারে গেলে কোনো দিন খালি হাতে বাড়ি ফিরত না। বাড়িতে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে , খালি হাতে কী ফেরা যায়? অন্ততঃ একটা করে চকলেট সবার জন্য বাধা থাকত। সুপ্ত’র দাদা গুড়ের জিলাপি খেতে পছন্দ করতেন। তাই হাট-বাজার থেকে ফিরলেই এক পুটলি জিলাপির প্যাকেট হাতে দিয়ে বলতেন, ‘এই নাও জাফরের মা সবাইকে ভাগ করে দাও।’ আমি ঠিক মত পেয়েছি কী না, খেলাম কী না- তা না জিজ্ঞাসা করে মানুষটি কখনও জিলাপি মুখে তুলতো না। আজ এত বছর পর মানুষটির কথা খুব মনে পড়ছে। কতদিন তার হাতে কেউ জিলাপি প্যাকেট তুলে দেয় না। ‘কেউ বলে না তুমি খেয়েছ জাফরের মা?’ এতদিনে জিলাপির স্বাদই সে ভুলে যেতে বসেছে। কোহিনুর বেগমের প্রত্যাশা ছিল নাতির জন্য জিলাপি আনলে হয়তো তার ভাগেও এক টুকরো পরবে ! কিন্তু কেন যে তা আজ মুখ ফুটে বলতে গেল? খুব লজ্জা লাগছে তার।
দুই.
ব্যাগ ভর্তি সওদা নিয়ে জাফর সাহেব বাসায় ফিরেছেন। প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়াও স্ত্রীর জন্য বাহারি কসমেটিকস্, ছেলের জন্য কেক , চিপস সবই এনেছেন। তবে স্ত্রীর দেওয়া তালিকাটি থেকে কোন ফাঁকে পারফিউমের কথা ভুলে গেছেন- ঠিক খেয়াল নেই। স্ত্রীর মন খারাপ। জিলাপি তিনি ইচ্ছে করেই আনেন নি। কারণ স্ত্রীর বারণ আছে। স্ত্রীকে সহজে চটাতে চান না জাফর সাহেব। পানের পুটলিটি বের হতেই বউ তার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। জাফর সাহেব পাঁচ টাকার পান আর ফ্রি খয়ের, সুপাড়ি, চুন এনেছিলেন। পাশের রুমে পানের পুটলিটি মায়ের হাতে দিয়ে বেশ কড়া করেই বললেন, ‘পান খাওয়ার এই পুরানো অভ্যাসটা তুমি ছেড়ে দিতে পার না। পানের যে দাম!’ কোহিনুর বেগম ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হল না। তবে চেখের জলে কপোল ভিজে গেছে। কোহিনুর বেগম নিজেকে লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন।