শরৎবন্দনা
মুহাম্মাদ এমদাদুল্লাহ্
নাগরিক কোলাহল ছেড়ে পৌঁছলাম একটি গ্রামে। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো বন্ধু শুভ্র। আমি ডাকি বইপোকা। বইপোকা বলার কারণ, শুভ্র বইয়ের প্রতি নেশা প্রচুর। যেন নেশা তার পেশায় পরিণত। দেশী- বিদেশী উপন্যাস, থ্রীলার, সায়েন্স ফিকশন তার নাগালে থাকে। তার বই পড়া দেখে আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে পারি না।
কিছুক্ষণের মধ্যে এসে হাজির হয় শুভ্র। এক- অপরের সাথে মোসাফাহ ও বুক মিলালাম। ব্রিজের উপরে নেমেছি গাড়ি থেকে। ব্রিজ থেকে দু’জন পা মিলিয়ে হাঁটতে থাকি একটু গ্রামের ভেতরে। পিচঢালা পথ, মাঝেমধ্যে খানখন্দে ভরা। আমাদের দু’পাশ মিলিয়ে যাচ্ছে গাছ-গাছালীর ছাউনিতে। আমাদের সামনে দেখা ফসলের মাঠ জল- টুইটম্বুর। বর্ষার একটানা অস্বস্তির পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শরৎ।
ষড়ঋতুর পালাবদলে এখন চলছে শরৎকাল। শরৎ বলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে; কাশফুল আর শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। নির্মল নীল আকাশের অপারে সাদা সাদা তুলোমেঘ আনন্দে ভেসে বেড়ানো সুখানন্দ। শরতের সৌন্দর্যতা ও মোহে ক্ষণিকের জন্য আমার দৃষ্টি আটকে রাখে প্রকৃতি। প্রকৃতির সাথে যে শরতের অন্তরাত্মা সম্পর্ক, অন্য কোন ঋতুতে এমন নিবিড় সম্পর্ক বুঝা ও দেখা যায় না।
গ্রাম- বাংলার শরতের সাথে জীবনের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাই অনেক কিছু। যেন স্বপ্নের মতো মায়াবী আর ছবির মতো ঝকঝকে। শরৎ উদার মনে, সুন্দরের ডানা মেলে সাজিয়ে দেয় প্রকৃতির মাঝে।
সময়টা তখন দুপুরের মধ্যাহ্ন। পিচঢালা পথ ছেড়ে আমরা গ্রামের আরো ভেতরে চলে যাই। যেতে যেতে গ্রাম পেরিয়ে মাঠে এসে পড়ি। জমির আলপথ ধরে হাঁটতে থাকি। কাঁদামাটির কারণে খালি পায়ে হাঁটছিলাম। এখনো জমে আছে শিশির। শিশিরভেজা ঘাস পায়ে অনুভব হয়। শরতের ভোরে শিশির ঝরেছে, এখনো ঘাসে সূর্যকিরণ আলো ছুঁয়নি বুঝায় যাচ্ছে। গাছ-গাছালী, ঝোপঝাড় দিকে তাঁকালে মনে হয়, প্রকৃতিতে যেন সারারাত স্নান করেছে। শুভ্র কথা বলে যাচ্ছে অনবরত। তাদের গ্রামটা হাত দিয়ে দেখাচ্ছিলো। আমি মুগ্ধমনে শুনে যাচ্ছি। আর দেখছি ঘুরে ঘুরে।
হাঁটতে হাঁটতে সামনে চোখে ভেসে আসে, সবুজ ধানক্ষেতের তেপান্তর মাঠ। শরতের এই সৌন্দর্যতার বুকে আরো সবুজের আস্তরণ ছড়ায় ধানের গাছগুলো। বাংলা মাসের ভাদ্র - আশ্বিন এই দু’মাস শরতকাল। আশ্বিনের শেষে হাসি ফুটবে কৃষকের। হেমন্তের সময় ধানগুলো সোনারং পেঁকে মৌ মৌ গন্ধ বিলাবে। এখন এসব কচি কচি। শরত সেই হৈমন্তিকের বাণী শোনায় কৃষকের কানে।
সকাল পেরিয়ে গড়িয়ে আসে দুপুর। বকুলের ঘ্রাণে মুগ্ধ করে দেয় শরতের দুপুর। একথোকা পাপড়ি, পাঁশুটে সাদা, মধুগন্ধি বুকল ফুল। আমরা ঝোপঝাড় থেকে বেরুতেই অজস্র বকুল ফুলের সমারোহ। মাটিতে ঝরে আছে। বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত বকুলের আগমণ। শরত ধরা দেয় বকুলের কাছে। বকুলের সৌরভ মেখে নেয়। শরত সুবাসিত হয়। তাই কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন-
‘ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল’
‘আঁচল আকাশে হতেছে আকুল’
শরতের দুপুরের নির্মলতার হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের নীলকাশের অপারে। শুভ্রমেঘের সাথে মুগ্ধমনে হাঁটছি। শুভ্রর মনটাও শরতের মতো নির্মল হাসছে। তার হাসিতে যেন মুক্তামালা ঝরে পড়ছে। আমরা হাসছি- খেলছি আবার কখনো বা কোথাও গিয়ে বসছি।
দুপুর যতো যাচ্ছে নীলের গভীরতা ধীরে ধীরে বেড়ে চলছিলো। আকাশজুড়ে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি। মেঘগুলো যেন এক-অপরের সাথে কম্পিটিশন দিয়ে চলছে। কখনো উধাও হয়ে যায়, আবার হারিয়ে যায় শূন্যতার আড়ালে। এ নিয়ে ভাবতে থাকি গভীরভাবে দীর্ঘ শরতের আসা-যাওয়ায়। সেই ভাবা থেকে আজও ভাবি।
কিছু দূরে দেখা মিললো কাশবনের কোমল দৃশ্য। কাশ শরতের অনন্য ফুল। কাশবনের স্নিগ্ধ শোভায় প্রকৃতিকে যেন প্রাণবন্ত করে রেখেছে। হালকা বাতাসে কাশবনে শুভ্র ঢেউ ওঠছে। কাশফুলের বাহারি দৃশ্যে রাঙিয়ে আছে অপরূপে। দলবেঁধে এসে বসলো চড়ুই পাখি। এসেছে প্রজাপতি ও মৌমাছিরাও। কাশের বুকে জেগে ওঠেছে শরতের দুপুর। শরতের সাথে প্রকৃতির ভালোবাসা, আমার অন্তরে স্পর্শ করে।
পাশে হালদা নদী। তার ধারে কাশবনটি। শান্ত- নীরব নদীর স্রোত। কোন জলধারা ডেউ নেই। কিন্তু নদীর পাড়ে কাশবনে তোলেছে ছোট ছোট রুপালীর ডেউ। এমন ভাবে যেন, শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে মোহনীয় করে তোলছে মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। আর বাতাসের দোলায়, শরতের আগমনকে যেন প্রকৃতির সৌন্দর্য আরো সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত করে তোলেছে।
অনেকটা সময় গড়িয়ে যায়। গড়িয়ে আসে শরতের বিকেল। বিকেলের গড়ান হাওয়া। খুউব মনোমুগ্ধকর ও মায়াবীভরা মুহূর্ত। মৃদুমন্দ বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে তনু-মন। সূর্যটাও ধীর গতিতে হেলে পড়ছে পশ্চিমে। রোদ নিজেকে অনেকটা শীতল করে নিয়েছে। মিষ্টি- মধু রোদ খেয়ে বেশ সজীব হয়ে ওঠেছে প্রকৃতি।
শিউলি ফুলেরা হাসছে ধীরে ধীরে। ফুলকলিরা মুখ তোলে সন্ধ্যায়। শিউলি গাছগুলো একটু নরম ধরণের। এদের জাত শত্রু পানি। সারারাত গন্ধ বিলাবে। আর শরতের শিশিরভেজা জমিনে ঝরে পড়বে সূর্য উঠার আগেই। তাই এই নিয়ে কবি বলেনথথ
‘আলোক পরশে মরমে মরিয়া’
‘হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া’
হালদা পাড়ে শিউলির ঘ্রাণে কেটে দেয় পুরো বিকেল। উদাস বিকেল, নদীর টলটলে জল একেবারেই স্থির, নিশ্চুপ। যেন শিউলির কোমল পাপড়ির অপেক্ষায় সে অনন্তকাল ধরে। শরতের সন্ধ্যা এসে দাঁড়ায় লালিমার নিচে। লাল কমলায় রাঙা হয়ে ওঠেছে শরতের মুখ। অনেকটা সময় সবুজ গালিচার উপরে কেটে যায়। এভাবেই শারদীয় দিন-রাত আসে, আসে শুভ্রতার প্রতীক হয়ে।...
অতঃপর। শুভ্র বলে : চলো এবার উঠা যাক্। আমার মন বলে, আরেকটু বসি। শরতে পাশে। বুকুলের তলায়। শিউলি ফুলের সঙ্গী হয়ে।