শুভ জন্মদিন
আরিফুর রহমান
ক. মেঘ স্বভাবের মেয়ে
ও বলল, কি সব কথা বল না ! আজাইড়া।
আমি শুদ্ধ করে দিলাম, উঁহু, অযথা।
ওঃ সরি।
আমিঃ সরি বলে কোন লাভ নেই। আপনি কোনওদিন ঠিক হবেন না।
ওঃ হবো, ঠিক হবো।
আমিঃ ওপারে গিয়ে।
ও সাথে সাথে বিষম খেল। চোখ-মুখ লাল করে হাঁস-ফাঁস করতে লাগল। আমি জিভ কাটলাম। ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। করুণ স্বরে বললাম, পানি খাবেন স্যার, পানি? জরীকে পানি দিতে বলি?
আমি জানি মা আশে পাশেই আছে। হয়ত দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার দিকে লক্ষ রাখছে। কারণ কিছুদিন থেকেই মা আমাকে চোখে চোখে রাখছে। এই যে স্যার বিষম খেল আর আমি পানির কথা বললাম, জরীকে দিয়ে মা-ই এক্ষুণি পানি পাঠাবে। আমাকে উঠে গিয়ে বলে আসতে হবে না।
জরী চলে এসেছে। ওর হাতে পিরিচের উপর এক গ্লাস শরবত। টেবিলে রাখতে রাখতে সে বলল, নেন ছার নেবুর শরবত খান। গরমের দিনে নেবুর শরবত খুউব ভালা ছার।
আমি বললাম, জরী তুই যা।
জরীঃ আমি তো এহানে থাকতে আসি নাই আপা। গেলাস খালি হইলেই নিয়া চলে যাব।
স্যারঃ জরী তুমি একটু বেশি কথা বলো। অবশ্য যারা বেশি কথা বলে তাদের মন সহজ-সরল হয়।
জরীঃ জ্বী, ছার। আসি। দোয়া রাইখেন।
আশ্চর্য! প্রশংসা শুনে জরীরাও কেমন গলে যায়! অবশ্য স্যার তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে নরম সুরে কথা বলে। আমি ওই কথাগুলোই জরীকে বললে সে এতক্ষণে আরেক প্রস্থ বক্তৃতা চালিয়ে দিত।
আর কয়েক ঘন্টা পরই আমার জন্মদিনটা শুরু হবে। বারটা এক মিনিটে একসাথে আমার জন্য অনেক চমক চলে আসবে। সব সময় বড় চমক আসে বাবার কাছ থেকে। কিন্তু গত তিন বছর ধরে বাবাকে ছাড়িযে যাচ্ছে স্যারের কর্মকান্ড। এবার আমার জন্মদিনের কথা ওর মনে আছে কিনা তাই তো বুঝতে পারছি না। আচ্ছা স্যার সম্পর্কে কি কেউ ও, ওর এগুলো বলে? আমি বলি। মনে মনেই তো বলি। সরাসরি বলতে পারি না। আগে মনের কথা না বলে কিভাবে ওকে ও বা তুমি বলি?
ওঃ কি ভাবছো এতো? আর পড়তে হবে না আজ। এই টেবুলার এনালাইসিস তিনটি করে রাখবে, ঠিকাছে?
আমিঃ জ্বী।
এই হলো আমার সহজ-সরল, সোজা-সাপটা স্যার। অথবা মনে মনে আমার মনের মানুষ। একটা ফোঁটা আবেগের চিহ্ন কোথাও নেই।
গত জন্মদিনে বাবা দিয়েছে স্মার্টফোন। ফোন একটা প্রত্যাশিত ছিল কারণ আমার ইন্টারমিডিয়েট কলেজ পর্যন্ত মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল পরিবার ও কলেজ উভয় পক্ষ থেকেই। অনার্সে ভর্তির পরের জন্মদিনে মোবাইল তাই প্রত্যাশিতই ছিল। তবে স্মার্টফোন পেয়ে খুশি হয়ে ছিলাম।
আগের দুই জন্মদিনের মতো গত জন্মদিনেও আমাকে অবাক করে দিয়েছিল ওর গিফ্ট। আব্বু, আম্মু, ছোট কাকা, জরীরও পরে ও এসেছে। আমার অপেক্ষা দীর্ঘ করাই যেন ওর একমাত্র কাজ। উইশ্ করার পর আমার দিকে বাড়িয়ে দিল র্যাপিং করা দুটো জিনিস। ভাবলাম বই আর লম্বা কলমটা হবে। অংকে ভুলের জন্য মারার সুবিধার্থে লম্বা কলম! যখনই আমি হাতে নিয়েছি হঠাৎ ও বইয়ের উপর থেকে লম্বা জিনিসটা নিয়ে সোজা লম্বালম্বি মেঝেতে ফেলল। সাথে সাথে সেটা একটা ফুল হয়ে গেল। আমি অবাক মুগ্ধ চোখে তাকালাম ওর দিকে। সবাই হাততালি দিচ্ছিল। ও নির্বিকার ফুলটা তুলে আমার হাতে দিয়ে চলে গিয়েছিল। যেন কিছুই হয়নি।
মাঃ তোর মুখটা অমন দেখাচ্ছে কেন?
আমিঃ কেমন?
মাঃ তোকে অনেক অস্থির লাগছে। কি হয়েছে আমাকে বল শুনি।
আমিঃ অতি সুখে অস্থির লাগছে। সরে দাঁড়াও, সুখ কমিয়ে আসি।
মাঃ কথা ঘোরাস না। কি হয়েছে বল। সবুজ কিছু বলেছে?
আমিঃ শুধু শুধু সন্দেহ করো না। তুমি তো জানোই স্যার কিছু বলেনি। সময় সুযোগ পেলে আমিই ওকে বলব।
মাঃ কি বলবি!
আমিঃ সেটাও তুমি জানো মা। তুমি সবই বুঝতে পারো। আমি জানি...
বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। এখন আমি ঝরনা ছেড়ে গোসল করতে করতে কাঁদবো। অকারণ অভিমানের কান্না। ঝরনার জলে ধুয়ে নেব আমার সব অভিমান। তারপর ওর ঘরে গিয়ে বলে আসবো আমার যত কথা। ওর ঘরটা খুব বেশি দূরে নয়।
খ. মেঘের আশ্রয়
আমাদের মেয়েটা আজকের এই দিনেই জন্মেছে। আজ ওর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। দেখতে দেখতে সতের বছর পূর্ণ হয়ে গেল ওর। অথচ দৃষ্টি স্থির করে স্মৃতির পাতা উল্টালে সব দেখতে পাই। খুব একটা মলিন হয়নি। সেদিনও এমনই ছিল আকাশ ভরা মেঘ। জলজ দমকা হাওয়া আমার টেনশন উড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হচ্ছিল বারবার। এই তো সেদিনের কথা।
আমার প্রিয়তমা বধূটি প্রিয়তর হয়ে উঠা সন্তানকে ঠিকঠাক পৃথিবীর আলোয় নিয়ে আসতে প্রাণপণ লড়াই করছে। সকাল থেকে দুপুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। সূর্যের দেখা নেই ঠিক, কিন্তু সময় তো বসে নেই। ঘড়ির কাঁটা তিনটার দাগ ছুঁই ছুঁই।
বাবাঃ এই, ফজলুকে দুই ঘন্টা আগে পাঠিয়েছি নৌকা আনতে। এখনো কোন খবর নেই। ব্যাটা আসলেই একটা কচ্ছপ।
বাবা হঠাৎ গম গম করে উঠলেন। বারান্দায় হাতলঅলা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। বেশ বড়সড় মানুষ। একটু জোরে কথা বললেই গম গম আওয়াজ উঠে যায়। আমি টেনশনে পায়চারি করছিলাম। বাবার কথা শুনে আমার পা দুটো থেমে গেছে। তাই তো, প্রায় দু’ঘন্টা হতে চলল, ফজলুর দেখা নেই। সাবিরাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। এভাবে আর কতক্ষণ কষ্ট করবে সে।
আমাদের বাড়ি থেকে পাকা সড়ক দেড় কিলোমিটার দূরে। গত কদিনের টানা বর্ষণে কাঁচা রাস্তাটুকুর অবস্থা বেগতিক। রিকশা-ভ্যান চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই বাবা ফজলুকে পাঠিয়েছেন ছলু মাঝির নৌকা নিয়ে আসতে। কিন্তু ফজলুটার আসলেই কচ্ছপ গতি।
ঘর ভরা মেয়ে মানুষ। এ বাড়ির ও বাড়ির। আকাশ ভরা মেঘ। জড়াজড়ি করে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা দূরীভূত করে ফজলু মিয়া ছলু মাঝিকে নিয়ে হাজির হলো। বাবা ফজলুর দিকে চোখ মটকে তাকালেন শুধু। আমাকে তাড়া দিলেন।
বাবাঃ যা তো, যা। বউমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। নৌকা ছাড়তে হবে। বৃষ্টি নেমে যাবে যেকোন সময়। যা, তাড়াতাড়ি যা।
আমিঃ জ্বী, আব্বা। আপনি ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে নৌকায় যান।
বাবাঃ ঠিকাছে। ছলু, নৌকার ছই ঠিকঠাক আছে তো?
আমি ঘরে ঢুকে গেলাম। ভিড় ঠেলে সাবিরার কাছে গিয়ে দেখলাম অবস্থা সুবিধাজনক না।
তারপর আমাদের পাড়ার একমাত্র দাইকে নিয়ে নৌকা ছাড়া হলো। নৌকায় উঠার সাথে সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। নৌকা যত চলল বৃষ্টির বেগ তত বাড়তে লাগল। একই সাথে বেড়ে চলল সাবিরার ব্যথা।
নৌকার ছই-এর মুখ দুপাশে মোটা পর্দায় ঢাকা। একসময় দাই আমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল।
দাইঃ নাও ঘাটে কোন বাড়ির কাছে নিবার কও। বাচ্চা এহনই হয়া যাবো।
আমিঃ আশে পাশে কোন বাড়ি নাই দাদি। এইটা শিমুলতলীর পাথার।
দাইঃ তাইলে নাও থামাইতে কও আর দোয়া পরতে কও সবাইরে। তুমি আমার কাছেই থাহ। তোমার বউরে ধরন লাগব।
সে এক কঠিন সময় গিয়েছে। নৌকা থামিয়ে বাবা আর ছলু মাঝি দুই গলুইয়ে বসে দোয়া পড়ছে। আমি চেষ্টা করছি দাই দাদির কাজে সাহায্য করতে।
সেই মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে, সেই ভরা নদীটার মাঝখানে, নৌকার ছইয়ের মধ্যে ভরা বর্ষণের সময় জন্ম নিল আমার মেয়ে। একটা ‘ওঁয়াও’ চিৎকার যেন সেদিন পৃথিবীর সব রঙিন সুখ আমার ভেতর, সাবিরার ভেতর ঢেলে দিয়েছিল।
তাই মেয়ের নাম দিয়েছি তটিনী বিনতে বর্ষণ। প্রবল বর্ষায় নদীর মধ্যে জন্ম যার, এর চেয়ে ভালো আর কি নাম হতে পারে তার!
আমার বর্ষণ নামটাও হয়েছে প্রবল বৃষ্টির দিনে জন্মেছি বলে। বাবা বলতেন।
বাবা-মেয়ের জন্মের সময়টার কত মিল। অথচ সেই মেয়ে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত একাই নিতে এতটুকুও অপেক্ষা করেনি। আসলেই সত্যÑসময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। নাম যে তার তটিনী। স্বভাবও হয়েছে ঠিক তেমনি।
পরিশিষ্ট
গতরাতে কান্না-গোসল শেষে তটিনী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাড়ি থেকে একেবারে বের হয়ে যাবে।
...তারপর মাত্র একঘন্টার আয়োজনে রাত সাড়ে এগারটায় বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। জন্ম তারিখে বিয়ে শুভ নয় বলে। সবুজের বন্ধুরা গোপনে খেটেছে প্রচুর।
বর্ষণ চৌধুরী তটিনীর পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল বারান্দায়। সারারাত। তটিনীর ছোট কাকা লোকজন নিয়ে ওদের খুঁজতে বের হয়ে গেছে। ফেরেনি।
শেষ পর্যন্ত সবুজের বন্ধুরা ওদের জন্য বাসর সাজিয়েছে নৌকায়।
বড় একটা নৌকার গলুইয়ে যখন সবুজ আর তটিনী পা রেখেছে তখন রাত ঠিক বারটা। আকাশ ভরা মেঘ। ওরা ছইয়ের ভারী পর্দা সরিয়ে যখনই ভেতরে প্রবেশ করেছে সাথে সাথে জ্বলে উঠেছে আলো। বাইরে তুমুল বৃষ্টি।
সবুজের বন্ধুরা দুটো বার ভোল্টের ব্যাটারি দিয়ে ছইয়ের ভেতরে হালকা আলোকসজ্জা করেছে। হয়েছে পুষ্পশয্যাও। শয্যার পাশে লেখা হয়েছে ‘শুভ জন্মদিন’ তার নিচে ‘বাসর নৌকা’। অথচ সেখানে লেখা থাকার কথা ‘শুভ বিবাহ’ আর নিচে ‘বাসর ঘর’।
বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ভেতরে বাসর শয্যায় বসে ওরা দুজন। সবুজের দুজন বন্ধু ইঞ্জিন চালিত নৌকাটা চালাচ্ছে ছোট্ট নদীটা পেরিয়ে যমুনার দিকে। প্রেম যমুনা।
তটিনী ভাবছে জন্মদিনে এর চেয়ে বড় উপহার আর কোন দিন সে পাবে না। আজ পৃথিবী বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও মন্দ হবে না। যেমন একটুও খারাপ লাগছে না নৌকার ইঞ্জিনটার ফট ফট ভট ভট শব্দ। যা সব সময় তটিনীর কাছে বিরক্তিকর।
সে সবুজের কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধু বলল, আজ এই বৃষ্টিভরা জন্মদিনের বাসরে কোন কিছুই মন্দ নয়।
কথাটা শুনামাত্র সবুজ নিজের মুখটা নামিয়ে নিয়ে গেল তটিনীর মুখের কাছে।