১.
ক্ষিপ্র স্পার্টনের মতো বাসের হ্যান্ডেল ধরে উর্মিলা নগরে চলে যায়। ওর গাঢ় হলুদ ওড়না বাসের দরজায় কতক্ষণ ওড়াউড়ি করে। তারপর আর দেখা যায় না। বাসটি গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে আবছায়ার মতো মুখ দেখিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। উর্মিলা চলে যাওয়া নিয়ে জগৎ-সংসারের কোনো মাথাব্যথা নেই। ভাবেও না। ভেবে লাভ কী? দয়ার্দ্র, মমতাবান, করুণ কোনো মুখ ওকে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়েও দেয়নি। বিক্রমহাটির এই অখ্যাত স্টেশন অজানা থেকে গেল। উর্মিলা নামক একজন নারী এ শান্ত নির্জন গ্রামের কোনো কিছুই গ্রহণ করতে পারেনি। কেন? কারণ ওর এখন দহনকাল চলছে। গ্রামের সবচেয়ে উঁচু ঝাউগাছের মাথায় গোল চাঁদ ঝুলে থাকে, তা উর্মিলার কাছে অর্থহীন। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী বংশাইর মতো মাতঙ্গিনী রূপ, বিস্মরণের ওপারে ডুব-সাঁতারের গল্প পেছনে পড়ে থাকে। যেখানে কোনো আশা নেই। স্বপ্নহীন প্রজাতি সে। বাল্য এবং কৈশোরের স্মৃতির দাপাদাপি আছে। বংশাই নদীর বাঁক, ওপাড়া চন্দবাড়ির মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, উন্মাতাল ছোটাছুটি, অতি তুচ্ছ চাওয়া-পাওয়ার আনন্দের মুগ্ধতা। নীরব নীলাভ দহন। এ দহন উর্মিলা বিস্মৃত হতে পারলে ভালো হতো। আকস্মিক এসব উর্মিলার নিকট মূল্যহীন, ধোঁয়াশা।
বিক্রমহাটি স্টেশনে অন্য কাউকে কি আশা করেছিল? করতে পারে। উর্মিলা এখন নগরে যাচ্ছে এ খবর খুব মানুষ কি জানে? না জানলেও ক্ষতি নেই। তবে স্কুলফেরত উর্মিলা হঠাৎ হঠাৎ যার মুখোমুখিতে থমকে যেত। বিহ্বল চিত্তে প্রতিনিয়ত প্রণয়ভিক্ষায় কাতর সে তরুণের মুখ মনে পড়ে। ইতিউতি স্টেশনে তার মুখের উপস্থিতি খুঁজে দেখেছিল। সেও উর্মিলার নগরে চলে যাওয়া দেখেনি। তাই শূন্যতায় আক্রান্ত একজন দুঃখী নারীর কষ্ট ভাগ করতে পারেনি। উর্মিলা থেকে গেল একক।
বাবা পরেশ পালও আসেনি। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার পথ। একটা টিনের ট্রাংকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে উর্মিলা স্টেশনের পথ ধরেছিল। পরেশ পাল উর্মিলার ওপর ভরসা করতে পারেনি। কেন কী কারণে উর্মিলা নগরে যাবে তা তো জানে না।
উর্মিলা বলেছে, ‘বাবা তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। মানুষের পক্ষে থাকব।’ পরেশ পাল অবাক। উর্মিলার কী ভাতের কষ্ট করেছে। অথবা অন্য কিছু। এতটুকু মেয়ে কী যে বলে! মেয়ের চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইচ্ছে হয় বিশদ জানার।
উর্মিলা তাকে সে সুযোগ দেয়নি। কী বলেছিল তা বোঝার আগেই তার মেয়ে পথে নেমে যায়। পরেশ পাল অনেকটা স্থবির বসেছিল বাড়ির আঙিনায়। উর্মিলা খালপাড় পেরিয়ে স্টেশনের পথ ধরে।
পরেশ পাল স্কুলশিক্ষক। উর্মিলাকে জন্ম দেওয়ার চার বছরের মাথায় স্ত্রী মিনা বালা কলেরায় মারা যায়। পরেশ পাল অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারেনি। চিতায় মুখাগ্নির সময় চার বছরের উর্মিলা কিছু বোঝার আগেই মা মিনা বালা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরেশ পাল দ্বিতীয় বিবাহ করেনি। তখন উর্মিলাকেই মনে হয়েছে এক জনমের কঠিন জিজ্ঞাসা! তাই আগামী জীবন উর্মিলাকে নিয়ে কাটিয়ে দেওয়ার সংকল্পে অনড় থেকে এতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছে। সহস্র আশা-আকাক্সক্ষায় বঞ্চিত বাবা পরেশ পাল মাতৃহীন উর্মিলাকে নিয়ে একাকী সংসারে শক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সতের বছর অতিক্রম করে যে স্বপ্ন লালন করেছে, তার সেই বিশ্বাসে গলদ ছিল না। কিন্তু বাঁধ সাধে উর্মিলা নামক পরীর মতো রূপবতী স্কুল-উত্তর তরুণীর স্বপ্নতাড়িত দ্রোহ। যে সমাজ-সংসার, চাওয়া-পাওয়া, ন্যায়-অন্যায়, মানবিক অধিকারগুলোর ঊর্দ্ধে ন্যায্য হিস্যায় তেজদীপ্ত ব্যতিক্রমী নারীরূপিনী। তাই জন্মের পর যে শিশু অসহায়, কাঙাল, অতি সাধারণ, বয়স বাড়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে তৈরি করেছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এ শিক্ষা পরেশ পাল দিয়েছিল তাকে।
উর্মিলাকে নিয়ে পরেশ পালের কোনোরূপ কষ্ট হয়নি। না গোত্র না ধর্ম না সমাজ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উর্মিলা নিজেকে প্রস্তুত করেছিল অন্য এক বিভায়। শুভপুরের তাবদ বাসিন্দা জানে উর্মিলা সহজ মেয়ে নয়। চলনে-বলনে আর দশটা নারী-চরিত্রের সঙ্গে মিল খায় না। ওর অনিন্দ্য মুখশ্রী, মায়াময় আঁখির বিস্ময়কর দৃষ্টি, যে কেউ বিহ্বল হতে বাধ্য। তারপরও ওরকম কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হাঁটতে হয়নি উর্মিলাকে। শুভপুর জানে উর্মিলা তাদের কন্যা। উর্মিলা জানে, বালিকা হতে হতে অজানা পৃথিবী স্বপ্নময় অর্গলে দাঁড়িয়ে আছে। আকণ্ঠ তৃষ্ণায় দাহ্য হৃদয়পুর। না! কোনো দহন তাকে পরাস্ত করেনি। বয়সের প্রাকৃতিক গ্রাম তাকে ছুঁয়ে দেখে। নইলে কাঙাল তরুণের জন্য ঘর ছেড়ে গেলে কিবা বলার ছিল। তাই শুভপুরের আশ্চর্য কন্যা উর্মিলা পাল একবার নক্ষত্রের পানে, একবার বেদনার পানে অনুভূতির আলোকে আবিষ্কার করে।
বেবী আপা ঢাকা থেকে এসেছে। মানবাধিকার কর্মী। দেশে দেশে যুদ্ধের কারণে যে মানবিক বিপর্যয়, তা সিংহভাগ শিকার নারীদের নিয়ে কাজ করে। পঞ্চাশ উত্তর মহিলা। আশ্চর্য মমতায়, সুললিত ভাষায় নারীত্বের ভেলা নিয়ে নিজের বাড়ির ফারাকটুকু বর্ণনা করছিল। এ অজপাড়া গাঁয়ে বেবী আপাকে কেউ আবিষ্কার করতে পারিনি। শুধু সতেরোর উর্মিলার মনে হয়েছিল বেবী আপা তো সাধারণ নয়, চারদিকে ভূলুণ্ঠিত সত্তা কেবলি জানান দিতে থাকে, উর্মিলা পাল। শুভপুরে কোনো আদমসুরত নেই। নিস্তরঙ্গ, সহজ, বঙ্গীয় গ্রাম। এখানে ঘুণপোকা বাসা বাঁধতে পারে না। গ্রামের সীমানা ঘিরে যে দেয়াল তার পরতে পরতে সবুজ, পাখির কলরব, কৃষকবধূর সরল স্বীকারোক্তি। আর নবান্নের উৎসব।
শুভপুরের বাইরের পৃথিবী অন্ধকার, ধোঁয়াশা। উর্মিলা রূপান্তরিত জীবন পাঠের খেরোখাতায় লিখে ফেলে, দ্রোহ। বেবী আপা প্রথমেই বলে, ‘এই মেয়ে, শরীরের কাল ক্ষীণ, মেধা অনন্তের পালকি। তুমি কোনটা গ্রহণ করবে?’
উর্মিলা বেবী আপাকে বুঝতে পারেনি। অসহায় উর্মিলাকে কিছুই বলতে হয়নি। স্কুল গভর্নিংবডি চেয়ারম্যান মকবুল কাকু বলেছিল, ‘বেবী মাগো, তুমি ঠিক ধরেছ, তোমার যোগ্য একমাত্র উর্মিলা।’
তিন দিন পর বেবী আপা ঢাকায় ফিরে যায়। উর্মিলার জন্য রেখে যায় বর্ণিল রঙধনুর সহস্র আশা এবং আলোকিত পথ। নিস্তব্ধ ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে উর্মিলা আর নারী থাকে না, নিজেকে অতৃপ্ত অসহায় ভাবতে চায় না। বুকের ভেতর বসতি গড়ে তোলে বেবী আপার স্বপ্নজাল।
সাত দিন পর ডাকে একটি পত্র পায় উর্মিলা। বেবী আপা লিখেছে, ‘স্কুল পাস না করলে মেয়েদের খুব সাধারণ জ্ঞান থাকে। তোমার এখন ওই পিরিয়ড চলছে। তুমি যেখানে জন্ম নিয়েছ ওইটা একটি সহজ, সরল গ্রাম। ভূস্বামী, মহাজন, রাজনৈতিক লুম্ফেন চরিত্রগুলো বিরাজমান। সব ঘরে সুখ আছে তাও বলা যাবে না। নানাবিধ পীড়নের মাঝে তুমি নামক নারী নিজেকে গ্রহণযোগ্য করতে পেরেছ তাতেই আমরা আগামীর নতুন বীজ উদ্গমের স্বপ্ন দেখতেই পারি। তুমি সত্যিই শুধু শুভপুরের নও। বাড়ির সীমানা থেকে বেরিয়ে দেখ, বিস্তৃত মাঠ, ধানি জমি। জমির পর তোমার অতি পরিচিত নদী। যে নদীতে অবগাহনের স্মৃতি তুমি আজন্ম লালন করবে। তারপর থেকে যে গ্রামগুলো তা ক্রমাগত অচেনা মনে হবে। সীমাবদ্ধ জীবনের এই দোষ। চিন্তা এবং যাপিত জীবন ছোট করে দেয়। আমি তোমাকে তা ভাবিনি। ভেবেছি, স্বপ্নতাড়িত। যদি বেঁচে থাকি তোমার সংবাদ রাখব। বিপন্ন পৃথিবীর পাশে দাঁড়ালে লাভ আছে, ক্ষতি নেই। তার সন্তান হিসেবে একদিন নিজকে ঋণী মনে হবে। স্কুল পাস করে নগরে চলে আসতে পারো। আমাদের সংস্থা তোমার অপেক্ষা করছে। প্রতিটি সময় পরিবর্তিত হচ্ছে। এক সময় গ্রাম থেকে নগর দখল করার জন্য মানুষ ছুটে আসত। এখন নগর থেকে গ্রামে যেতে হয়। আগামী নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়।’
উর্মিলা ভাবে, এ এক বছর কি নিজেকে প্রস্তুত করতে পেরেছে? অথবা বেবী আপার কিছুই বুঝতে পারেনি। কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে একজন বালিকা উড়নি উড়িয়ে দৌঁড়ে যায়। ব্যস, ওইটুকুই। শুধু অন্তরে গভীর গোপনে তিমির হননের গান শুনতে শুনতে এক সময় আবিষ্কার করে ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’
একদিন মধ্যরাতে বাবাকে বলে, ‘পরীক্ষা শেষ, আমি নগরে যাব।’
বাবা খুব অবাক হয়। অপলক উর্মিলার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রথমে উর্মিলার কথা বুঝতে পারে না বাবা।
বলে, ‘কেনরে মা?’
‘আমি বেবী আপার কাছে যাব।’
‘কেন?’
‘ভাত এবং মানুষের পক্ষে দাঁড়াব? তুমি আমাকে সাহায্য করো বাবা।’
পরেশ পাল বুঝতে পারে না। বিস্ময় নিয়ে ভাবে আমার উর্মিলা তো অন্যরকম। দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করে এ সত্যটুকু বহু আগেই আবিষ্কার করে রেখেছি।
তারপর উর্মিলা বাসে চড়ে, উড়নি উড়িয়ে নগরে চলে যায়।