০৫.
পরদিন সকাল সকাল রুবীর সঙ্গে অফিসে এল উর্মিলা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। তাতে মেয়েলি প্রয়োজনীয় জিনিস। চূড়ো করে চুল বেঁধেছে। হালকা গোলাপি সালোয়ার কামিজের সঙ্গে হলুদ উড়না। পায়ে অতি সাধারণ সেন্ডেল। সব মিলিয়ে বেশ রূপবতী লাগছে।
উর্মিলা রুবী সিটের পাশে চেয়ারে বসতেই পিয়ন রুবীকে দীপু ভাইয়ের রুমে ডেকে যায়। উর্মিলা একটু অস্থির লাগতে থাকে। হুড় হুড় করে আরও দুটি মেয়ে অফিসে ঢোকে। সবাই বেশ র্স্মাট। কলকল করে কথা বলতে বলতে দীপু ভাইয়ের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। অল্পক্ষণ পর রুবী ফিরে আসে কতকগুলো কাগজ নিয়ে।
উর্মিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এগুলো দেখো। মনে রাখতে হবে প্রশ্নের উত্তরের পাশে হাঁ-না টিক চিহ্ন আছে। যেটা সত্য তার পাশে টিক চিহ্ন দেবে। ছয়জনের মিশন। জাকির সাহেব মুখ্য ভূমিকায় থাকবেন। জাকির সাহেব ছাড়া আরও দু’জন। তুমিসহ তিনজন মেয়ে। মনে রাখতে হবে তোমরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা মিশনে যাচ্ছ। যাতে লিপিবদ্ধ হবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মানবিক বিপর্যয়ের দলিল। উর্মিলা বেশ অবাক হলো। রুবী এমন ভাবে বলছে যেন এ বিষয়ে ওর কত অভিজ্ঞতা। কাগজগুলো হাতে নিয়ে চোখ বোলাতে বোলাতে উর্মিলা বলল, ‘আমার ভয় করছে রুবী। খুব অল্পদিনে তোমার অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি তোমার মতো অতটা বুদ্ধিমান না। আমার হাত-পা কাঁপছে।’
রুবী ধমকের সুরে বলল, ‘ঘাবড়িও নাতো। জটিল কিছু না আমি পারলে তুমিও পারবে। তুমি আমার মতো না। অপেক্ষা করো। জাকির সাহেব এলেই তোমরা কেরানীগঞ্জ রওনা হবে। নিচে মাইক্রো অপেক্ষা করছে।’
‘ফিরব কখন?’
‘সন্ধ্যার মধ্যেই। অফিস থেকে সোজা বাসায় চলে এসো।’
উর্মিলার কৌতূহল হলো। এ নিয়ে ও চারদিন অফিসে এসেছে। জাকির সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়নি। অফিসের কৌণিক রুমে বসে। প্রয়োজন ছাড়া চেয়ার ছেড়ে উঠে না। অফিসের মধ্যে জাকির সাহেব আলাদা ভাব-ভঙ্গি আছে। যা তাকে বেবী আপার কাছাকাছি মর্যাদায় বসিয়ে রেখেছে। কিন্তু উর্মিলার কাছে!
রুবীর ভাষ্যনুযায়ী ভীতিকর। গ্রাম থেকে উঠে আসা উর্মিলার জন্য স্বস্তিকর নয়।
উর্মিলা আরেক কাপ চা খায়। এখন দেয়াল ঘড়িতে নয়টা পঁয়তাল্লিশ।
দীপু ভাই তার রুম থেকে ওই দু’মেয়েসহ বের হয়ে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সরস্বতী, এই দুই নারীকে নিয়ে নিচে যেতে হবে। অদ্য জাকির বস উপরে উঠবেন না। মাইক্রোতে বসে আছে। আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
উর্মিলা উঠে দাঁড়ায়। আলতো লজ্জায় ব্যাগে কাগজগুলো ভরতে থাকে।
দীপু ভাই বলে, ‘সুমি, নাজনীন, দেবী নতুন এসেছে। আপার প্রিয়। তাকে কষ্ট দেয়া যাবে না।’
সুমি কলকলিয়ে উঠে, ‘কী যে বলেন দীপু ভাই! দেবীকে কি কষ্ট দেয়া যায়। রুষ্ট হলে বংশ নির্বংশ হবে।’ হাসতে থাকে।
উর্মিলা কিছু বুঝতে পারল না। হঠাৎ কিছু রক্ত চোখ মুখে ছলকে ওঠে। দীপু ভাইয়ের দিকে তাকাতে পারে না। রুবীসহ দীপু ভাই লিফট পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দেয়।
সুমি ও নাজনীনকে অনুসরণ করে মাইক্রোতে উঠে যায় উর্মিলা। পেছনের সিটে ওরা তিনজন বসে। সামনের সিটে জাকির সাহেব গম্ভীর বসে আছে। তার পেছনে সিটে অন্য দু’জন। মাইক্রো ছেড়ে দিতেই নাজনীন বলল, ‘বস ডেমড়া কিলিং-এর রিপোর্ট কি বেবী আপাকে দিয়েছেন?’
জাকির সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মাইক্রোবাস পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে ভরপুর। নেশার মতো। ‘তালেব আলীর বর্ণনায় আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।’ সুমি বলে।
সামনের আয়নায় তেসরাভাবে জাকির সাহেবের মুখ দেখা যাচ্ছে। শান্ত, স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ববান মুখ। পুরু গোঁফের আড়ালে কোনো পাপ লুকিয়ে থাকতে পারে বলে এ মুহূর্তে উর্মিলার মনে হলো না। তারপরও অসহায়ত্ব ওর বুকে বাসা বেঁধেছে।
সুমি বলল, ‘উর্মিলা তোমার কি বসতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘না না।’ খুব শান্ত উত্তর দিয়ে উর্মিলা মিররে তাকায়।
জাকির সাহেব নির্বিকার বসে আছে। ড্যাবড্যাবা চোখ দুটো সামনের দিকে নিবদ্ধ। ভাবলেশ। নয়াবাজার পেরিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতুর ওপর দিয়ে মাইক্রো ছুটে চলছে।
নাজনীন বলল, ‘বুড়িগঙ্গার জল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। নীল পালিয়ে গেছে। কেমিক্যাল গলিজের পানি খেয়ে একদিন পটল তুলব।’
সবাই হেসে উঠে। আর তখন উর্মিলা কানের কাছে মুখ নিয়ে সুমি বলে, ‘দীপু ভাই তোমাকে নায়িকা ভাবছে।’
আকস্মিক উর্মিলা সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে যেতে থাকে। উর্মিলা কিছু বলে না। খুব কাতর নয়নে সুমির দিকে তাকায়।
‘না না তোমাকে খারাপ বলেনি।’ সুমি মৃদু সুরে হাসে।
ইতোমধ্যে কেরানীগঞ্জ পেরিয়ে সাথিয়া পালপাড়ায় এসে মাইক্রো থেমে যায়। আস্তে আস্তে সবাই নেমে যায়। জাকির সাহেবকে সবাই অনুসরণ করে। পেটফোলা, হাড়জিরজিরে কিছু ছেলেপেলে ছুটে আসে। ওদের শরীরে পুষ্টিহীনতার চিহ্ন। বসন্ত পালের বাড়ির সামনের বাংলো ঘরটায় বসার আয়োজন করেছে। আশপাশের বাড়ির উঠোনে হাঁড়ি, পাতিল, পুতুল রোদে শুকোতে দিছে। নাজনীন খুব অবাক হয়।
উর্মিলাকে বলে, ‘সুন্দর না।’
উর্মিলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
এ প্রোগ্রামে সব বিষয় বসন্তবাবুকে জানানো হয়েছিল।
টিমের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়ি, ও বাড়ি থেকে লোকজন জড়ো হতে শুরু করে।
এ সময় সুমি জাকির সাহেবের উদ্দেশে বলে, ‘বস, উর্মিলাকে দেখেনি?’
‘বেবী আপা ওর কথা বলেছে। খুব সম্ভাবনাময়ী বলে বাঁকা চোখে উর্মিলার দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্মিলা দু’হাত তুলে নমস্কার জানায়। ব্যস ওইটুকু। তারপর ওরা ব্যস্ত হয়ে যায়। টিমের অদ্যকার জরিপ কো-অর্ডিনেট করবে মঞ্জু রহমান। যিনি জাকির বসের সহকারী। যার যার মতো চেয়ারে বসে ফরমে উল্লিখিত বিষয়ে মার্কিং করবে। প্রস্তুতি গ্রহণ করার আগে মঞ্জু সাহেবকে সুমি বলে, ‘মঞ্জু ভাই, বসের তবিয়ত গোলমাল।’
‘তোমার তো অজানার কথা না! দেখো গা, রাতে বউয়ের সঙ্গে মারামারি করেছে।’
উর্মিলা কৌতূহল অনুভব করে। কান উৎকীর্ণ রেখে দু’জনের কথোপকথন শুনতে চায়।
নাজনীন বলে, ‘বদলোকের ভাগ্য সংসারে সুখ কম।’
‘তুমি এমন নিষ্ঠুরভাবে বলো নাজনীন, অভিশাপের মতো শোনায়।’ মঞ্জু রহমান হাসতে হাসতে বলে।
‘আমি সংসারের কঠিনতম সত্য বলেছি মঞ্জু ভাই।’ হঠাৎ করে উর্মিলার অসম্ভব ভালো লাগতে থাকে। নগরে আসার পর নানাবিধ উৎকণ্ঠার পীড়নে একধরনের হীনম্মন্যতা কাজ করছিল। সুমি, নাজনীনের স্পষ্টবাদিতা ওকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও সাহসী করে তুলেছে।
জাকির সাহেব একটু দূরে মঞ্জু রহমানের সহকারী তবারক হোসেনকে সঙ্গে চেয়ার টেবিল বসে কী সব কাগজ দেখাতে থাকে।
বসন্ত পালের বাংলোঘরের বারান্দায় তিনটে চেয়ারে ফরম আর কলম নিয়ে সুমি, নাজনীন, উর্মিলা, মঞ্জু রহমানের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। মঞ্জু রহমান উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘আমাদের এ মিশনের কাজ কি তা সুমি-নাজনীন জানে। সম্ভব তো নতুন ম্যামের জানা হয়নি। এত তাড়াতাড়ি বেবী আপা আপনাকে কাজে ইনভলবড্ করবে এটাও ভাগ্যের। আমাদের কাজে কী? মনে রাখতে হবে, আমাদের একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে। যা সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ নামক এ ভূখ-ে কত নিরীহ নারী মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। কতজন নিহত? কতজন ধর্ষণের শিকার? কত বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তার একটি চিত্র পাওয়া যাবে। যা পরবর্তীকালে দেশ ও জাতির ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হবে। আমরা এ গ্রামটিতে তারই জরিপ করব। মনে রাখতে হবে এ গ্রামের একাশি জন নিরীহ কুমোর সম্প্রদায়কে পাকিস্তানি আর্মি এবং তাদের দোসররা গুলি করে হত্যা করেছিল। ধর্ষণ করা হয়েছিল বত্রিশ জন নারীকে। এ তল্লাটের প্রতিটি বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। আমরা শহীদ পরিবার এবং ধর্ষিতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করব।’
মঞ্জু রহমানের মমতাবান, স্পর্শকাতর ব্রিফিং শুনে উর্মিলা বিস্মিত হয়। এভাবে কেউ বলেনি। হঠাৎ ওর বেবী আপার কথা মনে পড়ে। বেবী আপা মানুষের পক্ষে।
একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে একজন একজন করে সাক্ষাৎকার নেয়া হবে। সারা পালপাড়ার আবাল-বৃদ্ধা-বণিতা ভিড় করেছে। যাদের পূর্ব পুরুষ হত্যা অথবা ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছিল। স্বাধীনতার এত বছর পরও তাদের খোঁজ কেউ রাখেনি।
উর্মিলা শুধু নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দিদি আমার কান্না পাচ্ছে।’
নাজনীন বলল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে উর্মিলা।
উর্মিলা একবার ভাবল, সুমি, নাজনীনও ওর মতোন সাধারণ। যা ভেবেছিল ওরা তা না। দুরুদুরু বুকে উর্মিলা ফরমশিট নিয়ে যে অশীতিপর বৃদ্ধার সম্মুখীন হয় তার সঙ্গে ঠাকুরমার চেহারার মিল আছে। হিন্দু বিধবা। একাত্তর সালে এই গ্রামে হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের শিকার মণিবালা পাল। আটমাসের বিবাহিত জীবনে স্বামীহীন ধর্ষিতা এক নারী চরিত্র নিয়ে এত বছর যাপন করছে।
বর্ণনার পাশে টিক চিহ্ন দিতে হাত কাঁপছিল। বারবার নাজনীন এবং মণিমালার দিকে তাকাতে থাকে। নাজনীন বলে, ‘প্লিজ উর্মিলা, ইজি হও। এর চেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অপেক্ষায় আছে।’
‘দিদি, আমার কষ্ট হচ্ছে।’
‘তুমি কি আমার মতো দুঃখী?’
উর্মিলা অসহায় নাজনীনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
উর্মিলা এখন আর মণিমালা দেবীর কথা শুনতে পাচ্ছে না। টিক চিহ্ন দেওয়ার কথা ভুলে গেছে। ফরমশিট এ পৃষ্ঠা থেকে অপর পৃষ্ঠায় চলে গেছে। একটাও ডট দেবার কথা মনে নেই।
এ পাশ থেকে সুমি বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না। তোমার এ সিটটা পরে আমি ঠিক করে দেব। অন্যটার জন্য প্রস্তুতি নাও। বেদনায় কর্তব্য ভুলে গেলে চলবে কেন?’
মনে মনে সুমিকে ধন্যবাদ জানায়। আত্মার ভিতরে অন্যরকম একটি শক্তি বইতে থাকে।
এরপর আর উর্মিলাকে পেছন তাকাতে হয়নি। এক টানা তিনটে পর্যন্ত কাজ করে। একত্রিশ জন ধর্ষিতা নারীর লোমহর্ষক যন্ত্রণার কাহিনি শুনতে শুনতে ভাবালুতা লোপ পেয়েছিল প্রায় সবার মধ্যে। শুধু নাজনীন বলল, ‘পৃথিবীতে এত বেদনা জমে আছে?’
তবে বুকের ভেতর রোরুদ্যমান ক্রন্দন সবাইকে একাকী করে দিয়েছে।
মঞ্জু রহমান বলল, ‘তোমরা গাড়ির নিকট যাও। প্যাকেট লাঞ্চ পানি আছে খেয়ে নাও। শরীর খারাপ লাগছে। কিছু খাব না।’
জাকির সাহেব এবং অন্য জনের কাজ শেষ হয়নি। তারা ওপাশের আমগাছের তলায় জটলা করে কাজ করছে। বসন্ত পালের কুয়ো জলে হাত মুখ ধুয়ে দুপুরের লাঞ্চ করতেই বিকেল চারটা বেজে গেল। জাকির সাহেব তার জরিপের কাজ তখনও শেষ করতে পারেনি।
সুমি বলল, ‘কী নির্জন গ্রাম। প্রকৃতি এখানে ক্যামন নিস্তরঙ্গ। আর প্রকৃতির সন্তানরা। আহ।’
নাজনীন বলল, ‘আমার গ্রামের মতো!’
উর্মিলা বলে, ‘দিদি, আমি তো এ জীবন দেখিনি।’
আর এ সময় মঞ্জু রহমান দৌড়ে এলেন।
‘বস সবাইকে গাড়িতে উঠতে বলেছে।’
ক্লান্ত, বিষণœ, তিক্ত মন নিয়ে উর্মিলা যখন নাখালপাড়ার বাসায় ফিরে এল তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে।
রুবীর প্রশ্ন করার আগেই উর্মিলা বলল, ‘রুবী, জীবন এতো গ্লানিকর, জানা ছিল না।’
(চলবে)