পয়সা
হালিমা মুক্তা
পদ্মা নদীর পাড়। দক্ষিনে ও পূর্বে পশ্চিমে অবারিত পানি। উত্তরের চরে জব্বার মিয়ার বসবাস। মোট ২৮-২৯ টি বাড়ি। বাড়িতো নয় খুপড়ি যাকে বলে। আগে জব্বার মিয়ার বাড়ি ছিল। জায়গা জমিন সব ছিল। পদ্মার পূর্ব পাড়ে। কিন্তু পদ্মা নদীর পাড় ভেঙ্গে তারা হলো ভিটে মাটি হারা। আজ ১০ বছর হলো এই উত্তরের চরে আছে তারা। প্রথম এই চরে ঘরখানা উঠিয়েছিলো জব্বার মিয়ার বাবা লতিফ সরদার। লতিফ সরদার বলেই সবাই জব্বার মিয়ার বাবাকে ডাকতো। লতিফ সরদার ছিলো সৎ এবং ন্যায় পরায়ণ। চর এলাকায় তার বেশ শুনাম ছিলো। বিচার বিয়ে শাদিতে সবাই তাকে ডাকতো, মান্য করতো। জব্বার মিয়ার এখন আর আগের মতো সংসার ভালো চলে না। চরে মসজিদে ইমামতি করে আর কয়টাকা যোগানো যায়! পূর্বে ভিটে থাকতে লতিফ সরদার সবার থেকে ঈলিশ মাছ কিনে বড় পাইকারি হাটে বিক্রি করতো। জব্বার মিয়ার বাবার সাথে ঈলিশ মাছ ধরতে যেত মাঝে মাঝে । সে সব অতীত এখন আর ঈলিশ আগের মতো ধরা পড়ে না। জব্বার মিয়া মসজিদে ইমামতির কাজটা নিয়েছে তাছাড়া ঈলিশ ধরা এখন আর ভালো লাগে না। শরীরটা আর চলে না। সারাদিন কাশতে কাশতে জীবন ত্যাক্ত। জব্বার মিয়ার রাতে রাতে জ্বর আসে। হাঁপানী টাও বেড়ে গেছে। রাতে কাশির চোটে ঘুম আসে না। জব্বার মিয়া এপাশ ওপাশ করতে থাকে। রহিমা পাশ ফিরে ঝাঝালো স্বরে বলে উঠে আপনের জ্বালায় আজ বোধ হয় ঘুম হবে না। আজ দুই রাত এরকম শুরু করছেন। দিন ভরতো আমাকে গাধার খাটুনী খাটতে হয়। তাছাড়া একটা ট্যা ট্যা তো আছেই। রহিমার চোখ একটু ধরে আসে। পাশ থেকে রহিমার এক বছরের মেয়ের কান্না শুরু করে। মেয়েটারে দুধ দে, জব্বার মিয়া ডাক দেয়। পারবো না একটু ঘুম আইছিলো । রহিমা বাচ্চার মুখে দুধ গুজে দেয়। তার পরেও কান্না থামে না মেয়েটার, শুকনা দুধ এক ফোটা দুধ নেই বুকে। কি করেই বা থাকবে। চার জনের সংসার রহিমার ৭ বছরের এক ছেলে আর এক মেয়ে জমজ। তার উপর জব্বার মিয়ার ওষুধ পত্র। এখনতো মসজিদে তেমন যেতে পারে না জব্বার মিয়া। কমিটি লোক দেখতেছে হয়ত ইমামতি টাও থাকবে না। রহিমা একবেলা সেলাই মেশিন এর কাজ করে আরেক বেলা চরের ছোট ছোট বাচ্চাদের আরবী শেখায়। তার পরে এখানে আবার হিন্দুদের ঘরও আছে। যে পাঁচ দশ জন পড়ে তারা আবার টাকা দিতে চাইনা। কেও ৫০ কেও ১০০ টাকা এতে কি আর হয়। এ যুগে চলে! নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
এই হাফসা তোর দাগে পাও পড়ছে। এবার আমার দান। হাসান বলে। হাফসা বলে পড়েনাই তুই মিথ্যা কইতাছোস। দুই ভাই বোনে হাতা হাতি শুরু করে দেয়। রহিমা বাড়ির ভিতর থেকে দৌড়ে এসে মেয়ে হাফসা কে একটা চড় মেরে বলে সারাদিন খ্যালোন। বুড়ি হয়ে গেছে তাও খ্যালোন মারাই। যাহ পাতিল গুলো ধুয়ে দে। জব্বার মিয়া মসজিদ থেকে এসে মেয়েকে কাঁদতে দেখে। হাসানের মা হাফসার গায়ে হাত তুলছোস ক্যা। মেয়েটা এখন সিয়ানা হচ্ছে। রহিমা উঠান ঝাড়– বাদ দিয়ে মুখ ভেঙ্গচে বলে মেয়ে বড় হচ্ছে, না দিন দিন ছোট খুকি হচ্ছে। স্কুলে লেখাপড়ার মনোযোগ নেই। সারাদিন খ্যালোন । আর আমি একা খেটে মরি। এই হাসান এদিকে আয়তো মার সাথে একটু কাজে হাত দে। ছোট বোন টাকে ধরলেও তো পারোস। বলে উঠে জব্বার মিয়া। রহিমা বলে উঠে ও পোলা ব্যাটা ছেলে ওর কি কাম। মেয়ে টাকে কিছু কইতে পারেন না। ছাওলটাকে ধমকান।
এদিকে চরের অবস্থা ভালো না আবার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। চরের সমস্থ মানুষের মুখে চিন্তার ছাপ। বেশি দিন বোধ হয় এ চরে থাকা যাবেনা। এদিকে চরের মসজিদটার একেবারে কাছে পানি চলে এসেছে। কোন সময় নদীর ভাঙ্গনে মসজিদটা পানির গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। চিন্তার শেষ নেই। রহিমা বিবির চারিদিকে অন্ধাকার দেখতে পাই। যত চিন্তাতো তার । সে তো সারাদিন ঘরেই শুয়ে বসে কাটাই। সবি কপাল। রহিমার ঘরে সৎ মা। মা মরছে সেই ছোট কালে। বাপ আর একটা বিয়ে করেছে। সে মা দুই চোখ পেড়ে রহিমা কে দেখতে পারে না। রহিমা ছিল পাড়ার সুন্দরি মেয়ে। সৎ মায়ের অত্যাচারে স্কুল করে পরের বাসায় কাজ করতো। লতিফ বাবা সরদার রহিমাকে ছেলে জব্বার মিয়ার সাথে বিয়ে দেয়। রহিমা ও জব্বার মিয়াদের বাড়ি ছিল এ পাড়া ও পাড়া। বিয়ের পরেও কপালে সুখ হলো না। রহিমা কাঁদতে থাকে। পাশের বাড়ির রুবিনা এমন সময় রহিমাদের বাড়ি একটা জামা সিলাই করতে আসে। কি রে রহিমা তুই কান্দস ক্যা। রহিমা শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছে বলে কপালে কান্দন থাকলে কি করমু। রুবিনা নানা রকম বুঝ দেয় রহিমা কে।
সত্যিই কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে দেখতে চরের বেশির ভাগ বাড়ি নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। অনেকে চর ছেড়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায় অনেকে আবার যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। জব্বার মিয়া চোখে অন্ধকার দেখে। কোথায় যাবে! তার শরীরের যে অবস্থা কি করে খাবে সে। হাতে একটা পয়সা কড়ি নেই। হাসানের মা শুনছো, আর তো থাকা যাবে না এখানে, তো কই যাবা। রহিমা জানতে চাই। সামনের সপ্তায় রমজানরা ঢাকা যাবে। চলো ওদের সাথে আমরাও ঢাকা চলে যায়। কিছু না পারি কামলা তো খাটতে পারবো। নাহলে রিক্সা জমা নিয়ে চালামু। রহিমা ছল ছল চোখে জব্বার মিয়ার দিকে তাকাই তুমি যা ভালো মনে করো তাই করো। ঢাকা যে যাবে পয়সা কড়ি কিছু লাগবে না। রহিমা জানতে চাই, জব্বার মিয়া বলে একটা ব্যবস্থা হবেনে। রহিমা বলে আমার কাছে কিছু আছে এতে কি হবে। এমন সময় হাফসা তার মাটির ব্যাংক মাচার উপর থেকে পেড়ে আনে। মায়ের হাতে দেয়। বলে মা ধরো এতে পয়সা আছে। এ পয়সা দিয়ে আমরা ঢাকা যেতে পারবো। রহিমা বিবি মেয়ের কথা শুনে চোখ মুছে বলে, তোমার পয়সা লাগবে না মা। তুমি রেখে দাও। বরং ঢাকা গেলে লাগবে। মেয়ে হাফসার মাথায় চুমু খায় রহিমা বেবি। জব্বার মিয়া বলে দেখছোস মেয়ে আমার কি লক্ষী। তুই তো মেয়েটাকে দেখতে পারোস না। রহিমা বলে উঠে ছেলে বা কার মেয়ে বা কার। আপনি এমন কথা কন ক্যা হাফসার বাপ।
এডা ঢাকা শহর কাম একটা ঠিকই পাওয়া যাইবো তুমি চিন্তা করো না, রহিমা বিবি জব্বার মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে। মিরপুর বস্তিতে একটা খুপরিতে উঠেছে জব্বার মিয়া। প্রতিবেশি রমজান ব্যবস্থা করে দিয়েছে। জব্বার মিয়া ঢাকা আসার পর অসুখটা আরো বেশি বেড়ে গিয়েছে। রহিমা বিবি একটা বাসায় বান্দা কাজ ধরেছে। সকালে যায় আর বিকালে ফেরে। পাশের খুপরির রানুর মা ভালো মানুষ। রহিমা বিবির কষ্ট দেখে কাজটা নিয়ে দেছে । বলেছে এটা ঢাকা শহর একজন কাজ করলে পেট চলতো না তুমি কিছু করো। রহিমা বলে উঠে কি কাম করুম। সেলাই কাজ জানি। কিন্তু সেলাই কাজতো এখানে হবে না। রানুর মা বলে আমার হাতে ভালো একটা বাসা আছে তুমি চাইলে করতে পারো। রহিমা আতকে উঠে! বাসায় কাজ করুম। রানুর মা বলে উঠে তা কি করবা। এছাড়া উপায় কি। ভালো বেতন দিবে। ভেবে দেখো। রহিমা বিবি ভেবে চিন্তে একদিন পরেই রাজি হয়ে যায়। এভাবে বসে থাকলে আর চলবে! জব্বার মিয়া নিষেধ করে বলে আমি একটা কাজ পেলেই আর সমস্যা হবে না। কিন্তু রহিমা বিবি বলে তোমার যে শরীলের অবস্থা কাজ পেলেই কি করতে পারবে! রহিমা বাসা বাড়িতে কাজে যায়। হাফসা আর হাসান ছোট বোন টাকে দেখে রাখে। কিছুদিন যেতে না যেতেই রহিমার ছোট মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছু খাই না। বাচ্চাটা আগের থেকেই বাড়তি খাবার খেতে চাইতো না। সারাদিন খুব কান্নকাটি করে। দিন কে দিন বাচ্চাটি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। রহিমা বাসা থেকে দুই দিনের ছুটি নেয়ে মেয়েকে হসপিটালে ভর্তি করায়। কিন্তু চার পাঁচ দিন চিকিৎসায় ও বাচ্চাটির কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। এদিকে একমাস হয়নি রহিমা বিবি কাজ ধরেছে। তাই বেতন ও পাইনি, নতুন বাসা। হাফসার খুব শখের ব্যাংক ভেঙ্গে খুচরো পয়সা টাকা মিলেয়ে চারশোর মতো টাকা হয়েছে। তাই দিয়ে আর রানুর মার কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছে। কোন রকম চলছে, রহিমা বিবি মনে মনে ভাবছে আজ যাবে সাহেবদের বাসায় অর্ধেক বেতন ও যদি দেয় তবুও কিছু দিন যাবে। এদিকে জব্বার মিয়ার শরীর ও বেশি ভালো না। শ্বাস কষ্ট খুব বাড়ছে, তাকেও আর ঘরে বসিয়ে রাখা যায় না। হসপিটালে ভর্তি করানো দরকার। রানুর মা বলেছে কোন একটা সরকারি হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেবে, ছোট বাচ্চাটা একটু সুস্থ হলেই। কিন্তু তার একদিনের মাথায় বাচ্চাটি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।
জব্বার মিয়াকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়। রহিমা বিবি বাসা বাড়ির কাজটাও আর করতে পারে না। স্বামীর সেবা করার জন্য স¦ামীর পাশেই থাকে সর্বক্ষন। এভাবে ১৫ দিন কেটে যায়। জব্বার মিয়ার কোন উন্নতি নেই। সরকারি হসপিটাল নামে মাত্র চিকিৎসা। কি করবে রহিমা! একমাসের বেতন পেয়ে তাও তো ফুরিয়ে গেল প্রায়। ভালো অন্য কোন হসপিটালে নিবে। কিন্তু কিভাবে! চোখে সরষে ফুল দেখে রহিমা বিবি। ছোট মেয়েটা মারা যাওয়াতে রহিমা অনেকটা কাহিল হয়ে পড়েছে। কিন্তু হাত শূন্য। চিন্তায় রহিমার রাতে ঘুম হয়না। কত গুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়েছে। সে গুলো বাহির থেকে করনো লাগবে। তাহলে কি পয়সার অভাবে স্বামীকে চিকিৎসা করাতে পারবেনা। রহিমা আর ভাবতে পারে না। দুই দিনের মধ্যে পরীক্ষা রিপোর্ট ডাক্তার কে দেখাতে বলা হয়েছে। কি করবে সে এখন। রানুর মার কাছ থেকেও টাকা ধার নিয়ে আছে। সে গুলো ও দেওয়া হয়নি। তার পরে ঢাকা শহর নতুন পরিচিত তেমন কেও নেই। স্বামীকে রেখে দুই দন্ড সরার কায়দা নেই। যে সাহেবের বাসায় কাজ করেছে তারা খুব ভালো মানুষ। রাতটা পুহালেই সাহেবের বাসায় যাবে ভাবে রহিমা।
পরের দিন সকাল ১০ টা। হাফসা আর হাসান কে জব্বার মিয়ার কাছে রেখে রহিমা বিবি সাহেবের বাসায় উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু কপাল মন্দ গেটের দারোয়ান বলে সাহেবেরা ৬ মাসের জন্য দেশের বাহিরে গেছে। রহিমা বিবির মাথায় যেন বাজ পড়ে। কি হবে এখন! রহিমা বিবি আর ভাবতে পারে না। ভাঙ্গা হৃদয়ে হসপিটালে ফিরে এসে দেখে স্বামী তার আর এই দুনিয়াই নেয়।