জীবনের আপন মন
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
বাইরে খুব কোলাহল।
গাড়ির হর্ন, হকারদের চিৎকার, কুকুরদের অসহায় গোঙানি, আকাশের মেঘের কঠিন গর্জন, এলোমেলো বাতাস আর গাছদের থর থর করে কাঁপুনি।
এর মধ্যেও জীবন রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে চলেছে। খুব অস্থির আর উদ্বিগ্ন মন।
রাস্তায় পথচারীদের মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়া। একটা বাস যখন এসে রাস্তার ধারে এসে থামছে। তখন মনে হচ্ছে বাসটা যেন লোভনীয় একটা খাবার। হুড়মুড় করে মানুষ একে অন্যকে ঠেলে বাদুড় ঝোলা হয়ে বাসের বাইরের হ্যান্ডেলটা আঁকড়ে রেখে কোনো মতে নিজেকে ধরে রেখেছে। সময় যেন জীবনের চেয়ে মূল্যবান হয়ে গেছে। হয়তো এটাই বাস্তবতা। সময় মানুষকে ফেলে যায় নাকি মানুষ সময়কে ফেলে যায় কে জানে।
হয়তো কেউ জানে, কেউবা জানেনা।
জীবনের কথা বলছিলাম। দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই। জীবনকে বাজি রেখে জীবন দৌড়ে চলেছে। জীবন কি জীবনের পিছনে দৌড়াচ্ছে নাকি জীবন জীবনের পিছে দৌড়াচ্ছে। কে জানে কেইবা বলতে পারে। মানুষের বাইরেরটা দেখা সহজ কিন্তু ভিতরেরটা তো দেখা যায়না।
আশেপাশের মানুষজন। চেনা কিংবা অচেনা। সফবাই অবাক হয়ে জীবনকে দেখছে। চেনা মানুষদের কেউ কেউ চিৎকার করে ডাকছে ‘এই জীবন শুনতো, এতো দৌড়াচ্ছিস কেন? এতো দৌড়াইসনা। থাম্তো এবার। কি হয়েছে ‘তোর। ‘নিরুত্তর জীবন, কোনোদিকে তাকানোর সময় যেন নেই তার।
সামনে চলন্ত ট্রেন। পু ঝিক ঝিক পু ঝিক ঝিক করে ডাক দিচ্ছে।
লোকজন চিৎকার করছে আরে ছেলেটা পাগল নাকি চলন্ত ট্রেনকেও মানছেনা। পাগল থাম থাম, নইলে কিন্তু ট্রেনে পিষে মরবি।
কি অদ্ভুত। লোকজন হট্টগোল করছে জীবনের পাগলামো দেখে।
আর জীবন সুপারসনিক বিমানের মতো ট্রেনলাইন এমনভাবে পার হলো যে আর একটু হলেই ট্রেনটা তার দেহকে থেতলে দিতো।
কে জানে জীবন ট্রেনলাইনটা পার হতে পেরেছে কিনা। মনে হচ্ছে আবার মনে হচ্ছেনা ।
লোকজন তো ভয়ে চোখ বন্ধ করেছে আর খোলার নাম নেই। ভাবছে চোখটা খুললেই মাংস খুবলে পড়া একটা রক্তাত্ত নিথর দেহ দেখতে পাবে। তারপরও সময়ের সীমা অতিক্রম করে আলতো পাতার চোখ খুলতেই যা দেখলো তাতে ভয়ে আঁতকে উঠার মতো অবস্থা। আরে এটাও কি সম্ভব! ট্রেন অনেকটা দূর চলে গেছে আর জীবনও ট্রেন লাইন পার হয়ে নদীর বাঁশের সাঁকোটা ঘেষে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই।
সময়ের পিছে পিছে একদল মানুষ একটা লাশ বহন করে চলেছে। কোথায় কে জানে। কার লাশ কেইবা বলতে পারে। হয়তো... চেনা অচেনা একজন মানুষের লাশ। সবাই বলছে গতকাল রাস্তার ধারে দুর্ঘটনায় পরে লোকটা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল। আহা মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে একটা বাচ্চা রাস্তার ওধারে দৌড়ানোর সময় বিপরীত দিক থেকে আসা একটা বাসের মুখোমুখি পড়েছিল। লোকটা নিজের জীবন বিপন্ন করে বাচ্চাটাকে বাঁচাতে গিয়ে জীবন মৃত্যুর সাথে লড়ে একসময় জীবনের কাছে হেরে যায়।
জীবন জাহাজে সারেং এর কাজ করে। ছয় মাস নীল সুমুদ্রে তার বসতি আর ছয় মাস ছুটি। জীবনের ছয় মাস ছুটির সময়টা চলে এসেছে। এখনো দুদিন আগে জন্মানো সন্তানের মুখটা দেখতে পায়নি জীবন। তাই হয়তো সময়কে আর জীবনকে পিছে ফেলে নিজের অস্তিত্বের টানে নতুন জীবন দেখবে বলে জীবন ছুটে চলেছে। ছুটছে তো ছুটছেই। বাতাসের বেগকে ছাড়িয়ে এ জন্য অন্যরকম আনন্দের দুঃসহ ছুটে চলা।
জীবনের বউটা জীবনের জন্য বিয়ের বেনারসি লাল শাড়ি পরে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। নাকে নথ, গলায় লাল গোলাপের মালা, খোঁপায় গাদা ফুল, হাতে লাল টুকটুকে মেহেদী আর হাতে রেশমি চুড়ি । কিন্তু প্রতীক্ষা যেন ফুরায় না। হয়তো অপেক্ষাটা দীর্ঘ যুগের মতো। মন প্রেমে অস্থির হয়, আবেগের ব্যাকুলতা বাড়ে। কে যে কমে না কে জানে।
জীবনের বউ ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখে। ঘুমকে হারা মানাবার কত চেষ্টা। হার মানে ঘুম কিন্তু মন তো মানে না।
বউ বউ চিৎকার শুনে জীবনের বউ। জীবন এসেছে জীবন। কিন্তু আবছা ছায়ার মতো। বউটা ধরতে যায় কিন্তু ধরতে পারেনা। কোলের সন্তানকে জীবনের বুকে তুলে দিয়ে মহামিলনের মাহেন্দ্রক্ষণ দেখতে চায় জীবনের বউ মন। জীবনের মন পাখি, নামটাও মন। কিন্তু জীবনের আদরের হাত দুটো তার সন্তানকে কেন যেন ধরতে গিয়েও ধরতে পারছেনা। একটা দুঃসহ আনন্দ চোখের জলের যন্ত্রণার মতো যেন ছটপট করছে। সন্তানের নামও রেখেছে জীবন খুব সুন্দর একটা নাম আপন। খুব মেলানো একটা শব্দের মতো। জীবনের আপন মন।
কিছু বুঝে উঠতে পারছেনা জীবনের বউ। জীবন দূর থেকে ছায়া হয়ে দেখছে তার আরেক নতুন জীবন।
বাইরে হট্টগোল। আহা বেচারা মারা গেলো ।
আতংকে আঁতকে উঠে মন। কে মারা গেলো।
তারপর নিঃশব্দ। চিৎকার করে আহাজারি। লাল গোলাপ লাল রক্তের উপর আছড়ে পরে। গাদা ফুলগুলোর গন্ধ হারিয়ে যায়। বেনারসি শাড়ি বিবর্ণ হয়। রেশমি চুড়ি ভেঙে টুকরো টুকরো কাচের বৃষ্টি হয়। আনন্দ, অপেক্ষা আলো থেকে আধার হয়।
জীবন এসেছে কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। জীবন এখন মরণ হয়ে গেছে।
জীবনের লাশটা বয়ে নিয়ে আসছিলো কিছু মানুষ।
কিন্তু জীবনের অতৃপ্ত আত্মাটা সন্তানকে দেখবে বলে দেহ থেকে বের হয়ে বাতাসের মতো শুধুই দৌড়েছে। দৌড়েছে আর দৌড়েছে।
জীবনের বেঁচে থাকা দেহহীন আত্মাটা আগে এসেছিলো মনের কাছে। আপনার কাছে।
তারপর আত্মাটা পাখি হয়ে উড়ে গেছে নির্বাসিত জীবনে।
এখন এসেছে মৃত দেহটা।
জীবন মরেছে। কিন্তু দুটো জীবনের জন্ম দিয়েছে।
একটি রাস্তায় পার হতে চাওয়া আরেক মায়ের সন্তান। আরেকটি তার সন্তান।
জীবনরা এভবেই জীবন দিয়ে মরে যায়। মন্দের কপাল পুড়ে। জোড়া লাগেনা কোনোদিন।
সময় গোড়ায়।
আপন এখন বড় হয়েছে। ঘরে তার বৌ এসেছে। নিজের সন্তান হয়েছে।
জীবনের কথা কেউ মনে রাখেনি। মনও না। আপনও না।
মন বিয়ে করে আরেক মনে জায়গা করে নিয়েছে।
সব কিছু যেমন ছিল তেমনি আছে। কিন্তু একটা জীবন ছিল তা সবাই ভুলে গেছে। হয়তো এটাই জীবনের মরণ।
আজ আবার রাস্তায় দেখতে পেলাম জীবনকে। তবে কি জীবন বেঁচে আছে। যদি বেঁচে থাকে তবে হয়তো মরণের ভান করে জীবন পরখ করেছে কেমন করে একদিন আপন মন পর হয়ে যায়।
এটাই হয়তো সময়। জীবন চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে দূর আকাশের তারাদের সাথে।
পৃথিবীতে কেউ আপন নয়। না নিজের মন, না জীবন। তারপরও অসমাপ্ত জীবনের গল্প লেখা থাকে সময়ের অদৃশ্য খাতায়।