স্বার্থের ঝুলন্ত ফানুষ
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
অনেক পুরোনো আমলের দালান।
কত দিন আগে! কে জানে? হয়তো অনেকদিন। দালানের মাটির ফলকে নানান রঙের কারুকাজ আর শিল্পকর্ম বলছে এটার একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এটা নাকি টেরাকোটার দালান।
একসময় হয়তো দালানটার যৌবন ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উঠতে পারেনি দালানটা। হায়রে যৌবন। কলা পাতার মতো ভেসে গেছে নীল সমুদ্রে।
এখনও অন্দর মহলে ঝাড়বাতির আলো আছে। কিন্তু সে আলোর জৌলুস নেই, চোখ ধাঁধানো রূপ নেই। একটা নর্তকীদের নাচের ঘরও আছে। একদিন হয়তো সেখানে নুপুরের ঝংকার ছিল। বাঈজীদের মান, অভিমান, কষ্ট আর কান্না ছিল। এখন কিছুই নেই। আছে কিছু না জানা চার দেওয়ালের ইতিহাস, শব্দহীন দুঃসহ যন্ত্রনা আর ভাঙা নুপুর। অযতেœ পরে আছে জমিদার বাড়ির জলসা ঘর।
কেউ আর বেঁচে নেই। জমিদারিও অনেকদিন আগেই চলে গেছে। কিন্তু এখনও কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন সমীরণ বিবি। জমিদার বংশের বউ।
খুব জাদরেল। স্বামী মরেছে অনেক আগেই। কিন্তু মৃত্যুটাও একটা রহস্য। ঘটনাটা আজও অজানা। হয়তো অজানায় থেকে যাবে। ঠিক এখন থেকে চব্বিশ বছর আগের ঘটনা। ঘরে তখন সাত জন সন্তান। দুটো মেয়ে আর পাঁচটা ছেলে। সবগুলো খুব ছোট ছোট। সবচেয়ে বড়টার তখন ১৫ বছর বয়স। আর সবচেয়ে ছোটটার এক বছর। খুব ভালোভাবে সবাইকে মানুষ করেছেন সমীরণ বিবি।
একে একে সবার বিয়ে দিয়েছেন। এখন শুধু একটা ছেলেই বাকি আছে।
যখন বউ হয়ে ঘরে আসে সমীরণ তখন রূপ যৌবন আকাশের তারার মতো ঝিলিক মারতো। এখন কিছুই নেই। খালি চোখে চশমা বসেছে। লাল রঙের জামদানি শাড়ির বদলে সাদা রঙের শাড়ি গায়ে ধরেছে। চুলগুলো লম্বা থেকে খাটো হয়েছে। কালো কয়লার মতো চুল সাদা দুধের মতো হয়েছে। কপালে কুঁচকে যাওয়া পাতার মতো ভাঁজ পড়েছে। শরীর চামড়ায় জড়তা এসেছে। এখন বাকি জীবনটা সুখে কাটলেই হয়। কে জানে কি হবে। অনিশ্চয়তায় ভুগেন সমীরণ বিবি।
ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেবার পর সব এক এক করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। মায়ের জন্য কিছুই করতে পারেনা তারা। এইতো ফোনে মাসে দুই একবার হাই হ্যালো করা। ভালো মন্দ জানা। এর বেশি কিছু নয়। সমীরণ বিবি ভাবেন কত আদরের তার ছেলে মেয়েরা ছিল। ছোট বয়সে ওরা বলতো, মা তোমাকে ছাড়া আমরা কাউকে ভালোবাসি না। তোমাকে আমরা কখনো ছেড়ে যাবো না। মায়ের আদর তো ফুরোবার না এটা কেমন জানি সময় যত বাড়ে মায়ের আদর বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছায় কেউ হয়তো তা জানে না। এটা তো সংখ্যা দিয়েও গোনা যায় না। কিন্তু বয়স ছেলে মেয়েদের যতই বাড়ে মনের রং তাদের ততোই বেড়ে যায়। মায়ের সাথে ভালোবাসার দেনা পাওনা যতই দিন যায় ততই কমতে থাকে।
হায়রে মা। কিসের নাড়ির বন্ধন। রক্তের ঋণ। সব কল্পনার গল্প। বাস্তবতা খুব কঠিন। রূপবতী বউ পেয়ে সমীরণ বিবির হাত থেকে ছেলেরা বউদের হাতে চলে গেছে। মেয়েদের তো আর করার কিছু নেই। যতই আমরা বলি নারীর ক্ষমতায়ন। কিন্তু সেটা কজনই বা পায়। মেয়ের ঘুড়ির এখনও মতো সুতো আর নাটাইটা পুরুষ নামের স্বামীর হাতেই থাকে। তারপরও সমীরণ বিবির বউদের নিয়ে ফিসফাস মেয়েদের সাথে চলে। এটাতে হয়তো পুরো শান্তি আসেনা কিন্তু মনটা ফুরফুরে থাকে।
সময় তো আর থেমে থাকে না। মানুষ হাঁটলে সময় দৌঁড়ায়। ছোট ছেলেটার বয়স এখন পঁচিশ বছর। টক টকে সাদা রং। চেহারাতেও খান্দানি জৌলুস। আহা একবার দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। সমীরণ বিবি খুব একটা বাইরে বের হন না। তবে পাড়া-প্রতিবেশীরা দল বেঁধে আসে। ছেলে বউ, সুখ-দুঃখ এমন কোনো বিষয় নাই যা নিয়ে আলাপ হয় না।
পাড়া প্রতিবেশীদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে, ছেলের বয়স তো দুই যুগ পার হলো। ঘরে বউ আনবা না?
সমীরণ বিবি কথাটা শুনে হাসে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রাগতে থাকে। এরপর আত্মীয়-স্বজন সবাই ছেলের বিয়ের বিষয়টা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে।
সমীরণ বিবির মনটা মেঘ হয়। খুব কালো মেঘ।
এতো পাড়াপাড়িতে শেষ পর্যন্ত ছেলের জন্য বউয়ের খোঁজ করতে থাকে। লজ্জায় ছেলের টুকটুকে সাদা গাল লাল হয়ে যায়। একের পর এক সুন্দরী মেয়ে সমীরণ বিবি দেখতে থাকে।
ছেলের মন আন্চান করে। বুকে কাঁপুনি উঠে। সুন্দরী মেয়েদের যাকেই দেখে তাকেই তার পছন্দ হয়। রাতভর বালিশটা নিয়ে বিছানার এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। বউয়ের স্বপ্ন দেখে, বিয়ের স্বপ্ন দেখে।
ছেলে আর পরিবারের অন্যদের মেয়ে পছন্দ হলেও সমীরণ বিবির কিছুতেই পছন্দ হয় না। খুব ধপধপে দুধে আলতায় মেশানো রূপসী মেয়ে দেখলে বলে, এতো রূপ ভালো না। এখানে পোলার বিয়ে দিবো না।
আবার শ্যামলা মেয়ে দেখলে মুখ ভেংচিয়ে বলে, আমার পোলার বিয়ে এমন মেয়ের সাথে দিবো না। আর কালো মেয়ে দেখলে তো কথায়ই নেই।
যখন কোন মেয়ের কোন কিছুতেই খুঁত পাওয়া যায় না তখন নাকটা বোচা, মুখটা বাঁকা, আচার-আচরণ ভালো না, হাতের মধ্যে তিল এরকম হাজারটা অজুহাত করতে থাকে। ছেলেটার ভীষণ রাগ হয়। আহা! এবারও সুন্দরী বউ হাতছাড়া হয়ে গেলো। কিন্তু মায়ের সামনে কিছু বলতে পারে না। মনে মনে ফুসে উঠে।
এভাবে একটার পর একটা মেয়ে দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর পেরিয়ে গেলো। ছেলের বয়স এখন ত্রিশ। মনের মধ্যে আর আগের মত রঙ, রূপ, রস কাজ করে না।
ভিতরের আবেগটা এখন ভোতা হয়ে গেছে। তারপরও নিবু নিবু কুপির আলোর মত একটুকরো আশা বেঁচে থাকে। এখন আর বউ না, সংসার করতে পারলেই হয়।
সমীরণ আগের মতই একটার পর একটা মেয়ে দেখতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই তার পছন্দ হয় না। সব দেখে শুনে মনে হয় পানি একবার বরফ হয়েছে, এ বরফ আর কখনও পানি হবে না।
সময় পাগলা ঘোড়ার মত। ছেলের বয়স এখন চল্লিশ বছর। সমীরণ এখনও মেয়ে খুঁজছে। কিন্তু অপছন্দের জায়গায় পছন্দটা এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি। আগে দলে দলে মেয়ের বাবারা এসে সমীরণের বাসায় পড়ে থাকতো। এটা ওটা বলে সমীরণের মন গলানোর চেষ্টা করতো। যদি কোন ভাবে জমিদার বংশে মেয়েটার বিয়ে হয়।
এখন সব অন্যরকম ঘটছে। মাঝে মাঝেই ছেলের সাথে খিটমিট লেগে থাকে।
সমীরণের রক্ত গরম হয়। রাগ করে বলে, তুমি যাকে বলবা তার সাথে তোমার বিয়ে দিবো। ছেলে এবার সংসারের জন্য না শেষ বয়সে একটা সঙ্গী পাবার জন্য বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত সবার কাছে নিজের বিয়ের কথা বলে। মেয়ে খুঁজতে বলে। মেয়েকে পছন্দ হলে ছেলের বয়স চল্লিশ। এখন উল্টা মেয়ে পক্ষ থেকে না করে দেয়। অনেকে গালি দিয়ে বলে বুড়া ব্যাটার লগে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে জীবনটা নষ্ট করতে চাই না।
সমীরণ বিবি ভাবে আর ভাবে। ভাবতে ভাবতে আকাশ পাতাল এক করে দেয়। ছেলেকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে। কিন্তু কোথায় যেনো একটা অন্ধকার মেঘ। পাথরের পাহাড়। বৃষ্টির সাথে শিলা বৃষ্টি। ভিতর আর বাইরের ভিন্ন রূপ।
এখন ছেলের বয়স পঞ্চাশ বছর। এতো দিনেও বিয়ে হয়নি। এখন আর না বউ, না ঘর, না সঙ্গী কিছুই ছেলেটার ভালো লাগে না। সব যেন পান্সে পান্সে লাগে।
সমীরণ বিবির এখন বয়স হয়েছে। মেরুদন্ডটা বেঁকে তাকে কুঁজো বানিয়েছে। শক্ত দাঁতগুলো মাড়ি থেকে আলাদা হয়ে ফকফকা হয়ে গেছে। এখন ছেলেকে দেখলে সমীরণ বিবি কাঁদে আর কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে পাহাড়, নদী, সমুদ্র এক করে দেয়।
কেউ জানে না কার দোষে ছেলেটার বিয়ে হলো না। কিন্তু সমীরণ বিবির ভিতরের মন জানে কার জন্য ছেলেটার বিয়ে হয়নি।
নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয় সমীরণ বিবির। নিজের স্বার্থের কথা ভেবে অনেক মেয়েকে পছন্দ হলেও সমীরণ বলেছে, তার পছন্দ হয়নি। বাইরের মনটা পছন্দ করে আনন্দে নেচে উঠেছে। আর ভিতরের মনটা অজানা আশংকায় কালো মেঘ হয়ে জমাট বেধেছে। বার বার বাইরের আর ভিতরের মনের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ভিতরের মনটাই জিতেছে।
সমীরণ বিবি কপাল চাপড়ায়। অনেকবার সমীরণ বিবি ভিতরের মনটাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু পেরে উঠেনি। যখনই বোঝানোর চেষ্টা করেছে তখনই সামনে আয়নার ভিতর থেকে আরেকটা সমীরণ বিবি বের হয়ে এসেছে। মুখটা গম্ভীর করে আয়নার ভিতরের সমীরণ বিবি বলেছে, পোলার বিয়ে দিয়ো না। পোলার যদি বিয়ে দাও তাইলে সে বউয়ের দিকে চলে যাবে। তোমার আর কোন অধিকার ছেলের উপর থাকবে না। পোলা তোমার কথা শুনবে না। বউয়ের কথা শুনবে। ছোট কালে পোলা তোমার কোলেপিঠে মানুষ হয়েছে। তখন তোমার সাথে পোলার সম্পর্ক বাড়ছে। কিন্তু বিয়ে হলে তোমার পোলার সাথে বউয়ের সম্পর্ক হবে। আর তোমার সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।
সমীরণ ভাবে, আমি মা। পোলারে আগেও ভালবাসতাম। এখনও ভালবাসি। সবাই বলে মায়েরা নাকি স্বার্থপর হয় না। কিন্তু সমীরণ বিবি ভাবে সে স্বার্থপর হইছে। পোলার ভালটা না ভেবে নিজের ভালটা ভেবেছে। নিজেকে সমীরণের অপারাধী মনে হয়। ছেলের চোখে চোখ রাখতে পারে না।
দিন যায়, রাত আসে। সময় দূরন্ত নদীর মত এঁকে বেঁকে ছুটে চলে। একদিন সমীরণ বিবির আত্মাটা দেহ থেকে বের হয়ে পাখি হয়ে যায়। ভালবাসার স্বার্থপর পাখিরা ডানা মেলে গন্তব্যহীন অন্যকোন শীতের দেশে চলে যায়।
এখনও ছেলেটা বেঁচে আছে।
অপেক্ষা করছে এই জীবন শেষ করে আরেকটা জীবনের।
দিন যায়, রাত আছে। সময় বদলায়। কিন্তু মনে রঙ আসে না। বসন্ত আসে না।
পাহাড়ের উঁচু ঢালটাতে মাথা নিচু করে ছেলেটা বসে থাকে। একটা মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা বলে কি বাবু আমাকে বিয়ে করবা?
ছেলেটা মাথা উঁচু করে তাকায়। উপরে আকাশ।
কে জানে এটা স্বপ্ন না বাস্তবতা। হয়তো সময় এর উত্তর খুঁজে দিবে। কিংবা জমিদার বাড়ির দালানে যদি কেউ কখনও যায় তবে জানতে পারবে শেষটা কি হয়েছে। হয়তো ভালো নয়তো খারাপ। কিংবা কোনটাই না।