(গত সংখ্যার পর)
০৭.
দীপু ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে এল উর্মিলা। সে সব কিছু ম্যানেজ করে রেখেছিল, শুধু ছবি আর মার্কশিট নিয়ে উর্মিলার উপস্থিতি। ফরম পূরণ করতে ওর হাত কাঁপছিল। বানান যাতে ভুল না হয় তার জন্য প্রতিটি শব্দের বানান দীপু ভাই বলে যাচ্ছে।
উর্মিলা একবার বলল, ‘জানেন আমাকে এ ভাবে কেউ সাহায্য করেনি।’
দীপু ভাই বলে, ‘আরে আমি তো করবই দেবীর সব দায় যে আমার।’
উর্মিলা দীপু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কলেজ থেকে বের হতে রাত নামল।
দীপু ভাই বলল, ‘আমরা কি কোন রেস্তোরাঁয় যেতে পারি?
‘রাতের ভাত কে খাবে?’
‘খাবেন না।’
‘অন্ন নষ্ট করা কি ঠিক?’
‘না। তারপরও অদ্য রজনী আপনি আমার ইষ্টিকুটুম। বেবী আপার জমাকৃত জীব। তাকে কী করে অসম্মান করি।’ দীপু ভাই হাসতে থাকে।
‘আপনি এভাবে বলবেন না। আমি কেঁদে ফেলব।’
‘কাঁদবেন কেন? দুর্গা কি কাঁদে? সে হলো অকল্যাণনাশিনী। আলো। আপনিও আলোর পথে হাঁটবেন। অদ্য দিবস-রজনী বেবী আপা আপনার আদমসুরত ঠিক করে দিয়েছে। আহ! কী আনন্দ ঘরে ঘরে।’ সুর তুলে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে যায়। এ সময় দীপু ভাই উর্মিলার হাত ধরে।
উর্মিলা খুব অবাক হয়। কিন্তু খারাপ লাগে না। এটুকুর জন্য কি ও তৃষ্ণার্ত ছিল? ওর বয়স আঠারো বছর তিন মাস একুশ দিন।
রেঁস্তোরার এক কোণে বসতে বসতে বলল, ‘কী সৌভাগ্য আমার। নগরের সবচেয়ে সুন্দরী রমণীকে নিয়ে রাতে ডিনার খাব।’ দীপু ভাই উচ্চস্বরে হাসে। উর্মিলা লজ্জা পায়।
রে¯েঁÍারার আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মধ্যে লজ্জাজড়িত কণ্ঠে উর্মিলা বলে, ‘এমন করে বললে আপনার সঙ্গে আর কখনো রাস্তায় বের হব না।’
‘আমি মিথ্যে বলছি।’
‘হ্যাঁ, মিথ্যে বলছেন। নগরে সুন্দরীরা থাকে। গ্রাম্য মেয়েকে নিয়ে উপহাস করছেন।’ উর্মিলার কণ্ঠ অভিমানে পূর্ণ।
‘দেবী ভুল বুঝবেন না। আমি সত্যি কথাই বলি। একদিন আপনিও বুঝতে পারবেন।’
‘আমি সত্য-মিথ্যের পার্থক্য বুঝি না।’
‘আমার জন্মান্ধ বোনটির বয়স বাইশ। ও আমার দু’বছরের ছোট। ও রাতদিনের পার্থক্য বুঝতে পারে। একদিন মধ্যরাতে আমাকে চাঁদ দেখাতে উঠোনে নিয়ে আসে। বলে, ‘কী অপূর্ব জোছনা। জোছনার প্লাবনে পৃথিবী ধুয়ে যাচ্ছে।’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আসমা, আমি কিছুই বুঝতে পারি না।’
‘না পাবার কথা। বিয়ের যোগ্য জন্মান্ধ বোনের জন্য তোমার মধ্যে হাহাকার আছে। তাই সবকিছু গুলিয়ে যায়।’
মনে মনে ভাবি, ‘তাই হয়তো।’
দীপু ভাইয়ের কণ্ঠ আবেগপূর্ণ।
হঠাৎ উর্মিলার মনে হয়। ওর কী যেন নেই।
বিল মিটিয়ে দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বের হতে রাত নয়টা বেজে যায়।
রিকশা নেবার আগে দীপু ভাই বলে, ‘এত রাতে কি দেবীকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক! যদি আজ্ঞা হোন, তবে রিকসায় চড়নদার হতে পারি।’
উর্মিলা কিছুই বলে না। রিকশায় উঠে এক পাশে জায়গা রেখে অপেক্ষা করে।
রিকসায় উঠে দীপু ভাই বলে, ‘কী ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছি। দেবী পার্বতী শিব বাবাজীকে নিয়ে কৈলাসে যাত্রা করছেন।’
রিকশা কাওরানবাজার পেরিয়ে যায়। উর্মিলা চলমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোকোজ্জ¦ল বর্ণিল নগরের হরেক রকম দৃশ্য চোখের তারায় খেলা করতে থাকে। ওর মনে হয়, এই আলোটুকু শুভপুর গ্রাম আলোয় ভাসত। শুভপুরের কী বিদ্যুৎ পৌঁছাবে না?
‘দেবী কি রাগ করেছেন? করতে পারেন। তারপরও আপনাকে আপনার ডেরায় পৌঁছে দেব।’
‘ধন্যবাদ। আমি কৃতজ্ঞ।’
‘ধন্যবাদ।’
হঠাৎ উর্মিলা বলে, ‘অফিস আজ এত ব্যস্ত ছিল কেন?’
‘আমি, সুমি, বেবী আপা ম্যানিলাতে যাচ্ছি। তেইশ তারিখ কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য। আগামীকাল থেকে পেপারস তৈরি করতে হবে।’
রিকশা ফাস্ট গেট পেরিয়ে যায়। ওদের কথাহীন রিকশা এগোয়। ব্যাংক কলোনি পেরিয়ে বাসার গলিতে ঢুকতেই উর্মিলা বলে, ‘সুমি দিদি যাবে কেন?’
‘জানি না। বেবী আপা জানে।’
কোনও কথা না বলে উর্মিলা রিকশা থেকে নেমে যায়। রিকশায় বসে থেকে দীপু ভাই বলে, ‘ধন্যবাদ কি আমি আশা করব?’
উর্মিলা পেছন ফিরে তাকায় না। গেট পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে থাকে।
রুমে দরজার কাছে পৌঁছে কলিং বেল টিপ দেওয়ার আগে একবার মনে হলো, দীপু ভাইকে কিছু বলা হলো না। না বলা হলো। কলিংবেল টিপতেই রুবী দরজা খুলে দেয়।
একটু অবাক হয়ে বলে, ‘এত রাতে একা এলি।’
‘না একা আসব কেন? দীপু ভাই গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে।’
‘বলিস কী?’
‘আমি সত্যি বলছি।’
রুমের উজ্জ¦ল আলোয় রুবীকে খুব উৎফুল্ল দেখায়।
‘বাথরুম থেকে ফিরে ভাত খেয়ে শুয়ে নে।’
‘ভাত খাব না। দীপু ভাইয়ের সঙ্গে হোটেলে খেয়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘হুম।’
‘এমন ভাবে বলছিস যেন দীপু ভাই জনম জনম চেনা।’
‘নগরে এসে পরিচয় হয়েছে।’
‘দীপু ভাই ম্যানিলাতে যাবে। সঙ্গে সুমি।’
‘জানি।’
উর্মিলা বিছানায় গা এলিয়ে দেবার আগে বলল, ‘রুবী। আজ কলেজে ভর্তি হয়ে এলাম। এ সংবাদ বাবাকে জানানো দরকার।’
‘অবশ্যই দরকার। উনি খুশি হবেন।’
রুবী আলোর উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
উর্মিলা বাবাকে লিখে, ‘প্রিয় বাবা, অদ্য কলেজে ভর্তি হলাম। তুমি খুশি হওনি। ভর্তির পর বোধগম্য হলো, শিক্ষা মানুষকে আলোর দিকে নিয়ে যায়। তুমি সারা জীবন আলোর ফেরিওয়ালা। আমি ওই পথে হেঁটে যেতে চাই।’
০৮.
পর পর দু’দিন রুবীর সঙ্গে বসে, অনেকগুলো পেপারস দেখতে হলো। উনিশ’ একাত্তরে রংপুরে বিহারী কর্তৃক বাঙালি নিধনের চালচিত্র। বেশিরভাগ পেপার কাটিং। ওই সময়ের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হেড নিউজ। অমানবিক। উর্মিলা অসুস্থতা অনুভব করে। দ্বিধান্বিত আত্মার পাশে প্রতিনিয়ত কাঁটা দিয়ে ওঠে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা। উর্মিলার মনে হয়, এ ভূখ-ের জন্য মানুষের এত ত্যাগ। এ সময় একবার সুমি দিদি বলেছিল, ‘উর্মিলা আবেগের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আছে। যা মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যায়। এ যুদ্ধ চলতেই থাকবে। সুমি দিদি কেন কী কারণে এ কথা বলল তার জবাবে উর্মিলা বলে, ‘মানুষের জন্ম অনেক বেদনার।’
সুমি অবাক হয়। উর্মিলাকে ওর বেশ পছন্দ হয়।
ওইটুকুই। তারপর সুমি দিদির দেখা নেই। ঘন ঘন দীপু ভাই, জাকির সাহেব, বেবী আপার রুমে ঢুকে যায়। পেপারস এর ত্রুটি নিয়ে কলকল করে কথা বলে। অ্যাম্বাসিতে বেবী আপার সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে।
দীপু ভাই এ ক’দিন উর্মিলার টেবিলের সামনে দাঁড়ায়নি। ভাবখানা এমন, উর্মিলা নামক তার একজন অফিস স্টাফ আছে সে জানেই না।
রুবী বলে, ‘দীপু ভাই কি অন্ধ হয়ে গেছে?’
‘কেন? উনি অন্ধ হবে কেন?’, উর্মিলা জবাব দেয়।
‘উর্মিলা ন্যাকামো করো না। দীপু ভাই ক্যামন আমাদের অবজ্ঞা করছে।’ রুবী শ্লেষ মিশিয়ে বলে।
দীপু ভাই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করে। ম্যানিলার কনফারেন্সের পেপারস তাকেই তৈরি করতে হবে।’
‘এত ঠিকুজি তুই জানলি ক্যামনে।’
‘জানতে হয় না বুঝতে হয়।’
‘ও।’ রুবী দীর্ঘলয়ে বলে।
উর্মিলা আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। লাঞ্চের পর দীপু ভাই তার রুমে ডাকে।
হঠাৎ করে উর্মিলার মধ্যে শিশুসুলভ অভিমান চাগিয়ে ওঠে। টেবিলে জমে থাকা ফাইল নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে।
‘বস অলওয়েজ রাইট।’ বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা বলেছিল। পুরোপুরি দশ মিনিট অপেক্ষা করে উর্মিলা। ইতিউতি তাকায়। রুবী ধ্যানমগ্ন হয়ে সংবাদপত্র দেখছে। এটাও চাকরির একটা কাজ। উর্মিলা বুঝতে পারে।
নিজেকে একটু গোজ-গাজ করে নিয়ে দীপু ভাইয়ের রুমে ঢুকে যায়।
দীপ ভাই কলকলিয়ে বলে, ‘আসুন দেবী তাকাহাসি, এজ লাইক জাপানি ডল।’
উর্মিলার অপ্রস্তুত মনে হয়।
কিছু বলার আগেই দীপু ভাই বলে, ‘বলি না সব দায়ভার আমার। তাকিয়ে দেখুন দুটো বইয়ের প্যাকেট আছে। একটি আপনার কলেজের বই। অন্য প্যাকেটে, বেবী আপা দিয়েছেন আপনাকে পড়ার জন্য। মনোযোগী ছাত্রী। নিয়মিত ক্লাস করবেন। লেখাপড়া আপনার প্রথম জরুরি। মাথায় ছাতা আছে, চিন্তা কম। অফিসের নিয়ম-কানুন রপ্ত করুন। তাতে কৌটিল্যের ছায়া দোষের নয়। সময় আপনাকে বলে দেবে, ‘মানুষ চাঁদে গেলেও পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না।’ দীপু ভাই কী বলে গেল তার অনেকটা বোঝার আগেই বলে, ‘আমি কিন্তু আপনার লোকাল গার্জিয়ান।’
উর্মিলা জানত না কলেজে বেবী আপা ওর লোকাল গার্জিয়ান দিয়েছে দীপু ভাইকে। উর্মিলা চমকে উঠে। অল্প সময় চোখের পাতি স্থির রেখে দীপু ভাইকে দেখে। সুঠাম উদীপ্ত তরুণ। যেকোনো নারীর প্রার্থিত পুরুষ। এসময় ওর শরীর জুড়ে ভয় বাসা বাঁধতে থাকে। নগরে এসে শুভপুর গ্রামের উর্মিমালা স্নায়ুর কোষে কোষে সাঁতরায়। ভাবে, তাইতো! নিয়তি।
দীপু ভাই বলে, ‘দেবী কি বাকরুদ্ধ?’
‘জি না।’
‘কাল বাড়ি যাব। আসমা এবং মা’র সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
‘যাবেন।’
‘আপনি আমাকে করুণা করেন?’
‘করি’
‘কেন?’
‘আপনি আমাকে আপনি বলতে পারেন না।’
‘মানুষকে আপনি বলা ভদ্রতা।’
‘এতো বিদ্যা দিয়ে কী হয়?’
‘আপনি আমাকে মুক্তি দেবেন দেবী।’
‘আপনি আমাকে ডেকেছেন?’
(চলবে)
০৭.
দীপু ভাইয়ের সঙ্গে গিয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে এল উর্মিলা। সে সব কিছু ম্যানেজ করে রেখেছিল, শুধু ছবি আর মার্কশিট নিয়ে উর্মিলার উপস্থিতি। ফরম পূরণ করতে ওর হাত কাঁপছিল। বানান যাতে ভুল না হয় তার জন্য প্রতিটি শব্দের বানান দীপু ভাই বলে যাচ্ছে।
উর্মিলা একবার বলল, ‘জানেন আমাকে এ ভাবে কেউ সাহায্য করেনি।’
দীপু ভাই বলে, ‘আরে আমি তো করবই দেবীর সব দায় যে আমার।’
উর্মিলা দীপু ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। কলেজ থেকে বের হতে রাত নামল।
দীপু ভাই বলল, ‘আমরা কি কোন রেস্তোরাঁয় যেতে পারি?
‘রাতের ভাত কে খাবে?’
‘খাবেন না।’
‘অন্ন নষ্ট করা কি ঠিক?’
‘না। তারপরও অদ্য রজনী আপনি আমার ইষ্টিকুটুম। বেবী আপার জমাকৃত জীব। তাকে কী করে অসম্মান করি।’ দীপু ভাই হাসতে থাকে।
‘আপনি এভাবে বলবেন না। আমি কেঁদে ফেলব।’
‘কাঁদবেন কেন? দুর্গা কি কাঁদে? সে হলো অকল্যাণনাশিনী। আলো। আপনিও আলোর পথে হাঁটবেন। অদ্য দিবস-রজনী বেবী আপা আপনার আদমসুরত ঠিক করে দিয়েছে। আহ! কী আনন্দ ঘরে ঘরে।’ সুর তুলে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে যায়। এ সময় দীপু ভাই উর্মিলার হাত ধরে।
উর্মিলা খুব অবাক হয়। কিন্তু খারাপ লাগে না। এটুকুর জন্য কি ও তৃষ্ণার্ত ছিল? ওর বয়স আঠারো বছর তিন মাস একুশ দিন।
রেঁস্তোরার এক কোণে বসতে বসতে বলল, ‘কী সৌভাগ্য আমার। নগরের সবচেয়ে সুন্দরী রমণীকে নিয়ে রাতে ডিনার খাব।’ দীপু ভাই উচ্চস্বরে হাসে। উর্মিলা লজ্জা পায়।
রে¯েঁÍারার আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মধ্যে লজ্জাজড়িত কণ্ঠে উর্মিলা বলে, ‘এমন করে বললে আপনার সঙ্গে আর কখনো রাস্তায় বের হব না।’
‘আমি মিথ্যে বলছি।’
‘হ্যাঁ, মিথ্যে বলছেন। নগরে সুন্দরীরা থাকে। গ্রাম্য মেয়েকে নিয়ে উপহাস করছেন।’ উর্মিলার কণ্ঠ অভিমানে পূর্ণ।
‘দেবী ভুল বুঝবেন না। আমি সত্যি কথাই বলি। একদিন আপনিও বুঝতে পারবেন।’
‘আমি সত্য-মিথ্যের পার্থক্য বুঝি না।’
‘আমার জন্মান্ধ বোনটির বয়স বাইশ। ও আমার দু’বছরের ছোট। ও রাতদিনের পার্থক্য বুঝতে পারে। একদিন মধ্যরাতে আমাকে চাঁদ দেখাতে উঠোনে নিয়ে আসে। বলে, ‘কী অপূর্ব জোছনা। জোছনার প্লাবনে পৃথিবী ধুয়ে যাচ্ছে।’
আমি অবাক হয়ে বলি, ‘আসমা, আমি কিছুই বুঝতে পারি না।’
‘না পাবার কথা। বিয়ের যোগ্য জন্মান্ধ বোনের জন্য তোমার মধ্যে হাহাকার আছে। তাই সবকিছু গুলিয়ে যায়।’
মনে মনে ভাবি, ‘তাই হয়তো।’
দীপু ভাইয়ের কণ্ঠ আবেগপূর্ণ।
হঠাৎ উর্মিলার মনে হয়। ওর কী যেন নেই।
বিল মিটিয়ে দিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বের হতে রাত নয়টা বেজে যায়।
রিকশা নেবার আগে দীপু ভাই বলে, ‘এত রাতে কি দেবীকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক! যদি আজ্ঞা হোন, তবে রিকসায় চড়নদার হতে পারি।’
উর্মিলা কিছুই বলে না। রিকশায় উঠে এক পাশে জায়গা রেখে অপেক্ষা করে।
রিকসায় উঠে দীপু ভাই বলে, ‘কী ভাগ্য নিয়ে জন্ম নিয়েছি। দেবী পার্বতী শিব বাবাজীকে নিয়ে কৈলাসে যাত্রা করছেন।’
রিকশা কাওরানবাজার পেরিয়ে যায়। উর্মিলা চলমান রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আলোকোজ্জ¦ল বর্ণিল নগরের হরেক রকম দৃশ্য চোখের তারায় খেলা করতে থাকে। ওর মনে হয়, এই আলোটুকু শুভপুর গ্রাম আলোয় ভাসত। শুভপুরের কী বিদ্যুৎ পৌঁছাবে না?
‘দেবী কি রাগ করেছেন? করতে পারেন। তারপরও আপনাকে আপনার ডেরায় পৌঁছে দেব।’
‘ধন্যবাদ। আমি কৃতজ্ঞ।’
‘ধন্যবাদ।’
হঠাৎ উর্মিলা বলে, ‘অফিস আজ এত ব্যস্ত ছিল কেন?’
‘আমি, সুমি, বেবী আপা ম্যানিলাতে যাচ্ছি। তেইশ তারিখ কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য। আগামীকাল থেকে পেপারস তৈরি করতে হবে।’
রিকশা ফাস্ট গেট পেরিয়ে যায়। ওদের কথাহীন রিকশা এগোয়। ব্যাংক কলোনি পেরিয়ে বাসার গলিতে ঢুকতেই উর্মিলা বলে, ‘সুমি দিদি যাবে কেন?’
‘জানি না। বেবী আপা জানে।’
কোনও কথা না বলে উর্মিলা রিকশা থেকে নেমে যায়। রিকশায় বসে থেকে দীপু ভাই বলে, ‘ধন্যবাদ কি আমি আশা করব?’
উর্মিলা পেছন ফিরে তাকায় না। গেট পেরিয়ে দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে থাকে।
রুমে দরজার কাছে পৌঁছে কলিং বেল টিপ দেওয়ার আগে একবার মনে হলো, দীপু ভাইকে কিছু বলা হলো না। না বলা হলো। কলিংবেল টিপতেই রুবী দরজা খুলে দেয়।
একটু অবাক হয়ে বলে, ‘এত রাতে একা এলি।’
‘না একা আসব কেন? দীপু ভাই গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে।’
‘বলিস কী?’
‘আমি সত্যি বলছি।’
রুমের উজ্জ¦ল আলোয় রুবীকে খুব উৎফুল্ল দেখায়।
‘বাথরুম থেকে ফিরে ভাত খেয়ে শুয়ে নে।’
‘ভাত খাব না। দীপু ভাইয়ের সঙ্গে হোটেলে খেয়েছি।’
‘তাই নাকি?’
‘হুম।’
‘এমন ভাবে বলছিস যেন দীপু ভাই জনম জনম চেনা।’
‘নগরে এসে পরিচয় হয়েছে।’
‘দীপু ভাই ম্যানিলাতে যাবে। সঙ্গে সুমি।’
‘জানি।’
উর্মিলা বিছানায় গা এলিয়ে দেবার আগে বলল, ‘রুবী। আজ কলেজে ভর্তি হয়ে এলাম। এ সংবাদ বাবাকে জানানো দরকার।’
‘অবশ্যই দরকার। উনি খুশি হবেন।’
রুবী আলোর উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
উর্মিলা বাবাকে লিখে, ‘প্রিয় বাবা, অদ্য কলেজে ভর্তি হলাম। তুমি খুশি হওনি। ভর্তির পর বোধগম্য হলো, শিক্ষা মানুষকে আলোর দিকে নিয়ে যায়। তুমি সারা জীবন আলোর ফেরিওয়ালা। আমি ওই পথে হেঁটে যেতে চাই।’
০৮.
পর পর দু’দিন রুবীর সঙ্গে বসে, অনেকগুলো পেপারস দেখতে হলো। উনিশ’ একাত্তরে রংপুরে বিহারী কর্তৃক বাঙালি নিধনের চালচিত্র। বেশিরভাগ পেপার কাটিং। ওই সময়ের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হেড নিউজ। অমানবিক। উর্মিলা অসুস্থতা অনুভব করে। দ্বিধান্বিত আত্মার পাশে প্রতিনিয়ত কাঁটা দিয়ে ওঠে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা। উর্মিলার মনে হয়, এ ভূখ-ের জন্য মানুষের এত ত্যাগ। এ সময় একবার সুমি দিদি বলেছিল, ‘উর্মিলা আবেগের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক আছে। যা মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যায়। এ যুদ্ধ চলতেই থাকবে। সুমি দিদি কেন কী কারণে এ কথা বলল তার জবাবে উর্মিলা বলে, ‘মানুষের জন্ম অনেক বেদনার।’
সুমি অবাক হয়। উর্মিলাকে ওর বেশ পছন্দ হয়।
ওইটুকুই। তারপর সুমি দিদির দেখা নেই। ঘন ঘন দীপু ভাই, জাকির সাহেব, বেবী আপার রুমে ঢুকে যায়। পেপারস এর ত্রুটি নিয়ে কলকল করে কথা বলে। অ্যাম্বাসিতে বেবী আপার সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে।
দীপু ভাই এ ক’দিন উর্মিলার টেবিলের সামনে দাঁড়ায়নি। ভাবখানা এমন, উর্মিলা নামক তার একজন অফিস স্টাফ আছে সে জানেই না।
রুবী বলে, ‘দীপু ভাই কি অন্ধ হয়ে গেছে?’
‘কেন? উনি অন্ধ হবে কেন?’, উর্মিলা জবাব দেয়।
‘উর্মিলা ন্যাকামো করো না। দীপু ভাই ক্যামন আমাদের অবজ্ঞা করছে।’ রুবী শ্লেষ মিশিয়ে বলে।
দীপু ভাই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চাকরি করে। ম্যানিলার কনফারেন্সের পেপারস তাকেই তৈরি করতে হবে।’
‘এত ঠিকুজি তুই জানলি ক্যামনে।’
‘জানতে হয় না বুঝতে হয়।’
‘ও।’ রুবী দীর্ঘলয়ে বলে।
উর্মিলা আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। লাঞ্চের পর দীপু ভাই তার রুমে ডাকে।
হঠাৎ করে উর্মিলার মধ্যে শিশুসুলভ অভিমান চাগিয়ে ওঠে। টেবিলে জমে থাকা ফাইল নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে।
‘বস অলওয়েজ রাইট।’ বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা বলেছিল। পুরোপুরি দশ মিনিট অপেক্ষা করে উর্মিলা। ইতিউতি তাকায়। রুবী ধ্যানমগ্ন হয়ে সংবাদপত্র দেখছে। এটাও চাকরির একটা কাজ। উর্মিলা বুঝতে পারে।
নিজেকে একটু গোজ-গাজ করে নিয়ে দীপু ভাইয়ের রুমে ঢুকে যায়।
দীপ ভাই কলকলিয়ে বলে, ‘আসুন দেবী তাকাহাসি, এজ লাইক জাপানি ডল।’
উর্মিলার অপ্রস্তুত মনে হয়।
কিছু বলার আগেই দীপু ভাই বলে, ‘বলি না সব দায়ভার আমার। তাকিয়ে দেখুন দুটো বইয়ের প্যাকেট আছে। একটি আপনার কলেজের বই। অন্য প্যাকেটে, বেবী আপা দিয়েছেন আপনাকে পড়ার জন্য। মনোযোগী ছাত্রী। নিয়মিত ক্লাস করবেন। লেখাপড়া আপনার প্রথম জরুরি। মাথায় ছাতা আছে, চিন্তা কম। অফিসের নিয়ম-কানুন রপ্ত করুন। তাতে কৌটিল্যের ছায়া দোষের নয়। সময় আপনাকে বলে দেবে, ‘মানুষ চাঁদে গেলেও পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না।’ দীপু ভাই কী বলে গেল তার অনেকটা বোঝার আগেই বলে, ‘আমি কিন্তু আপনার লোকাল গার্জিয়ান।’
উর্মিলা জানত না কলেজে বেবী আপা ওর লোকাল গার্জিয়ান দিয়েছে দীপু ভাইকে। উর্মিলা চমকে উঠে। অল্প সময় চোখের পাতি স্থির রেখে দীপু ভাইকে দেখে। সুঠাম উদীপ্ত তরুণ। যেকোনো নারীর প্রার্থিত পুরুষ। এসময় ওর শরীর জুড়ে ভয় বাসা বাঁধতে থাকে। নগরে এসে শুভপুর গ্রামের উর্মিমালা স্নায়ুর কোষে কোষে সাঁতরায়। ভাবে, তাইতো! নিয়তি।
দীপু ভাই বলে, ‘দেবী কি বাকরুদ্ধ?’
‘জি না।’
‘কাল বাড়ি যাব। আসমা এবং মা’র সঙ্গে দেখা করার জন্য।’
‘যাবেন।’
‘আপনি আমাকে করুণা করেন?’
‘করি’
‘কেন?’
‘আপনি আমাকে আপনি বলতে পারেন না।’
‘মানুষকে আপনি বলা ভদ্রতা।’
‘এতো বিদ্যা দিয়ে কী হয়?’
‘আপনি আমাকে মুক্তি দেবেন দেবী।’
‘আপনি আমাকে ডেকেছেন?’
(চলবে)