হলুদ পাতায় সবুজ ঘ্রাণ
আরিফুর রহমান
প্রস্তাবনা পর্ব.
বারান্দায় একজন ভদ্রলোক বসে আছেন।
বই পড়ছিলেন। আমার ধুপ ধাপ বারান্দায় উঠার শব্দে চোখ তুলে চাইলেন। আমি আশ্রয় চাওয়ায় মতো ভঙ্গি করে সালাম দিলাম। ভদ্রলোক সালাম নিয়ে সুন্দর করে হাসলেন।
‘এখানে এসো। ইস্ রে প্রায় পুরোটাই ভিজে গেছ। চিত্রা, একটা তোয়ালে দিয়ে যা তো মা।’
তিনি তাঁর পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘বসো।’ আমি বসলাম তাঁর পাশে। বাইরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। সহজে থামবে বলে মনে হচ্ছে না। কী যন্ত্রণার কথা! এতদিন পর বাড়ি ফিরছি; সোজা বাড়ি গিয়ে মাকে দেখবো তবেই তো শান্তি। তা-না পথের কোন এক চেনা বাড়িতে আটকে রইলাম।
তোয়ালে নিয়ে যে এল সে একজন তরুণী। আমাকে দেখে ঈষৎ লজ্জা পেল। কিন্তু ফিরে গেল না। তোয়ালেটা আমার হাতে দিয়ে বাবার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আলতো করে মাথা মুছে নিলাম।
‘চিত্রা কি করছে পলি?’
‘ওকে অংক করতে দিয়েছি বাবা।’
‘ভালো। তুই নিয়মিত এভাবে মাস্টারি করলে ও দুষ্টামী করার সুযোগ কম পেত।’
‘হু।’
আমি চুপচাপ বৃষ্টি দেখছি আর এঁদের কথাবার্তা শুনছি। আমি যে এঁদের অপরিচিত তা মনেই হচ্ছে না যেন অনেকদিন থেকেই আমাকে চেনে। মেয়েটি আন্তরিক ভঙ্গিতেই আস্তে করে আমার কোল থেকে তোয়ালেটা তুলে নিল। সামান্য লজ্জা পেলাম। তোয়ালেটা এগিয়ে দিতে ভুলে গেছি। একটু তাকালাম ওর মুখের দিকে। সে হাসছে। কী সুন্দর হাসি! কী মিষ্টি চেহারা! দীর্ঘ পল্লব, ছায়াময় চোখ। সেই চোখ সবসময় হাসছে।
সে আসছি, বলে ভেতরে চলে গেল। বাইরে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখনো একটানাই ঝরছে ঝর ঝর ঝর। এবার তিনি আমার দিকে মনোযোগ দিলেন। আমার নাম, পরিচয়, ঠিকানা জেনে নিলেন।
আমি একে একে গুছিয়ে সব বললাম। সব শুনে তাঁর চোখে-মুখে এক ঝলক রোদ্দুর দেখা গেল। তিনি খুশি-খুশি গলায় বললেন, ‘তুমি সাজীদ ভাইয়ের ছেলে? দীপক, আমি তোমার ইদরিশ চাচা। সেই ছোট বেলায় তোমাকে দেখেছিলাম। ক্লাস থ্রী-তে পড়তে। এখন কত বড় হয়েছ। তোমার মা ভালো আছেন?’
‘জি¦, আমি আনন্দমোহনে পড়ি। অনেক দিন পর বাড়ি ফিরছি। মার শরীর মনে হয় কিছুটা খারাপ। গতকাল ছোট কাকা ফোন করেছিলেন।’
‘ও! অনেক দিন যাওয়া হয় না। অ্যাই অ্যাই পলি শোন্, এ তোর দীপক ভাইয়া। চিনলি না? ও-ই যে বিরামপুরের সাজীদ ভাই। তোর সেই চাচার ছেলে। যা, দীপকে ভেতরে নিয়ে যা। যাও বাবা যাও, ভেতরে যাও। তোর মা কোথায় পলি?’
‘মা ঘুমুচ্ছে।’
‘উহ্, মহিলা ঘুম ছাড়া আর কিছু বুঝল না জীবনে। অষুধ খেয়েছে?’
ততক্ষণে আমরা ভেতরে চলে এসেছি। সামনে বই-খাতা খোলা, কলম হাতে একটা মেয়ে আমার দিকে তাকাল। এ নিশ্চয়ই চিত্রা। পলি ওর মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় আমাকে বসতে বলল। আমি সহজ হয়েই বসলাম। চিত্রা উঠে এসে পলির গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
কী সহজ-সরল-তরল এঁদের সান্নিধ্য! যতোই দেখছি ততোই বিস্মিত হচ্ছি। যতোই শুনছি ততোই মুগ্ধ হচ্ছি। এটা পলির রুম। কী গোছানো, পরিপাটি সুন্দর। সুন্দর এই রুমটি আলো করে আমার সাথে গল্প করছে ওরা দু’বোন পলি আর চিত্রা। কী মিশুক প্রকৃতির এঁরা। কত সহজে আমাকে আপন করে নিয়েছে। অথচ আমি কে? দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কিন্ত মনে হচ্ছে আমি এঁদের অতি আপনজন। চিত্রা মেয়েটা খুব সুন্দর করে কথা বলে। এবার সে বলল, ‘ভাইয়া আপনার নামটা কিন্তু খুব সুন্দর। দীপক। মানে প্রদীপ। তিমির বিনাশী একটা নাম।’
‘হু’, ঠিক বলেছিস।’ চিত্রার সাথে মুচকি হেসে গলা মেলাল পলি।
কী সুন্দর হাসি! ছায়াময়, মায়াময় চোখ দু’টো সব সময় হাসছে। ভয়, পাপ, সংশয় এঁদের থেকে কত দূরে! অন্যরকম একটা ভালো লাগায় ভরে গেল আমার মন। প্রশান্ত মনটার সবকটা দরজা, জানালা খুলে দিয়ে বললাম, ‘তোমাদের নামও তো সুন্দর পত্রালি, চিত্রালি।’
আমার নামটা বেশি সুন্দর, চিত্রালি। চিত্রা নামে একটা নদী আছে না?’
চিত্রালি প্রশ্ন করেছে আমাকে। কিন্তু আমাকে উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে পত্রালি বলল, ‘হ্যাঁ একটা নদী আছে। আর সেই চিত্রা নদীর বালি আমার বোন চিত্রালি। হি-হি-হি!!!’
‘আর চন্দ্র পাতার কালি হল আমার আপু পত্রালি।’
‘দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি মজা।’
চিত্রালি হাসতে হাসতে আমার পেছনে এসে দাঁড়াল। ‘দেখুন তো ভাইয়া আমার আপুটা কেমন!’
আমি কেবল দেখছি না শুনছি আর ভাবছিও। কেমন তরো সুখ, আনন্দ, উচ্ছ্বাস এঁদের ঘিরে আছে। দু’বোনের কান্ড কারখানা দেখে হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে যাবার মতো অবস্থা। পত্রালি থেমে গেছে। ওর চোখে মুখে সুখের হাসি লেগেই আছে।
চিত্রালি আমার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘চা খাবেন?’
‘না, এই তো খেলাম।
‘তখন আপনি আর আপু খেয়েছেন। আমি খাইনি। এবার আমি বানিয়ে আনব। আমি ভালো চা বানাতে পারি। আপনাকে খেতেই হবে। অন্য কিছু না শুধু চা। আপুকে দেব না।’
‘তাই?’ ওর কথা বলার সুন্দর ভঙ্গি দেখে হেসে বললাম আমি। পত্রালিও হাসছে।
‘হু। ওয়েট। জাস্ট ট্যু মিনিটস।’
চিত্রালি প্রজাপতির মতো ডানা মেলে চলে গেল। আমরা চুপচাপ। পলিই মুখ খুলল।
‘মনে রাখার মতো কিছুই তো বললেন না আমাকে!’
‘তাই? উঁ-উঁ, তাহলে বলি শোন। তোমার পলি নামটা সুন্দর না। কেমন যেন শোনায়।’
‘তাহলে কোনটা সুন্দর?’
‘পত্রালি সুন্দর।’ মনে মনে বললাম, তুমি তো নিজেই খুব সুন্দর। মুখে বললাম, ‘আর......’
‘আর?’
‘আমার মনে তোমার সুন্দর একটা নাম কেবলই ঘোরপাক খাচ্ছে। অবশ্য তোমার ভালো নাও লাগতে পারে।’
‘কি সেটা?’
‘পত্রালির শেষ অংশটুকু বাদ দিলে কি হয়? পত্র। মানে পাতা।’
পত্রালি কিছু না বলে শরীর সামান্য দুলিয়ে হেসে উঠল। কী সুন্দর হাসি। আমি বললাম, ‘হাসছো যে?’
হাসতে হাসতেই সে উত্তর দিল, ‘চিত্রা কি বলছে শুনুন।’
‘পাতা-পু তোর চায়ে চিনি দিলাম কিন্তু?’
আমি ওর হাসির কারণটা বুঝতে পারলাম। আমাকে বিস্মিত করে সে একটা কথা বলল, ‘আপনারা একই জলের মাছ!’
‘কার কথা বলছিস্ আপু?’ চিত্রালি রুমে ঢুকেই প্রশ্নটা করল।
‘তোর আর দীপক ভাইয়ার কথা।’
‘সেটা কেমন?’
‘মস্ত একটা ঘোড়ার ডিমের মতন!’
চিত্রালি খিল খিল করে হেসে উঠল। সে চায়ের কাপে চা তুলছিল। হাসির কারণে কাপের অর্ধেকটা চা চারদিকে ছড়িয়ে গেল। সেই কাপ রেখে অন্য একটা কাপ আমাকে দিল। আরেকটা দিল পত্রালিকে আর অর্ধেকটা সে নিল।
আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘চিত্রা, তুমি তো সত্যি ভাল চা বানাও।’
‘জি¦। আমি ভাল কথা বলতে পারি মোটর সাইকেলের মত ফটফট করে। আর ভাল অভিনয়ও করতে পারি।’
‘তাই নাকি?’
‘জি¦। মাঝে মাঝে নিজের অভিনয় দেখে মনে হয় আমি স্পর্শিয়া মিম এদের চেয়েও ভাল অভিনয় করতে পারি। আমি দেখতে আরেকটু মিষ্টি হলে টিভিতে চান্স পেতাম।’
‘তুমি দেখতে মিষ্টি না?’
‘উহু।’
‘বুঝলে কি করে?’
‘আমি মিষ্টি হলে রাতে নিশ্চয়ই পিঁপড়া ধরতো ঝাঁকে ঝাঁকে।’
এমন কথা শুনে কেউ না হেসে থাকতে পারে না। হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল ধরে যাবার মতো অবস্থা। হাসি অল্প থামিয়ে বললাম, ‘তুমি গন্ধহীন মিষ্টি তাই পিঁপড়া ধরে না।’
‘ওমা, আমার রসে আমাকেই ডুবালেন।’ সবাই একসাথে হাসতে লাগলাম।
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগে। আমি বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরুতে চাচ্ছি কিন্তু চিত্রালিটা কিছুতেই ছাড়ছে না। এদিকে বিকেলটা খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত মার অসুখের কথা বলে ছুটি নিলাম আজকের মত। ঘর থেকে বেরোনোর সময় চিত্রা বলল, ‘আসবেন আবার কবে?’
‘যেদিন তোমার নতুন ঘরে পুতুল বিয়ে হবে।’
‘ওমা, আমি কি এখনো ছোট্ট খুকি আছি, যে পুতুল বিয়ে দেব? আপনি এমনিই আসবেন।’
পত্রালি হাসি মুখে আস্তে করে বলল, ‘আবার আসবেন তো?’
আমি ওর ছায়াময় দীর্ঘ পল্লব যুক্ত চোখ দু’টোর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আসবো।’
মধ্য পর্ব.
গাড়ি থামিয়ে বারান্দায় উঠতেই কানে এল ঘরের মধ্যে ভাঙনের শব্দ। পাতা রেগে মেগে কিছু ভাঙছে নিশ্চয়ই। স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছি রাগের কারণটা হতচ্ছাড়া এই আমি। আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। ওকে কথা দিয়েছিলাম হাফ ডে অফিস করেই চলে আসব। কিন্তু ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা। সাড়ে সর্বনাশ! ভাঙনের শব্দ ক্রমেই বাড়ছে। আজ আর রক্ষা নেই। সুড়–ৎ করে ঘরে ঢুকে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার ডানপাশে ডাইনিং টেবিলের কাছে পাতা অগ্নিমূর্তি হয়ে আছে। হাতে একটা কাঁচের গ্লাস। ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে দরজা খোলার শব্দে থেমে গেছে সে। ওর অল্প পেছনে পাশের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে চিত্রালি। চোখে-মুখে একরাশ মেঘ।
‘এই এতক্ষণে ফেরার সময় হল আপনার! এবার ঠ্যালা সামলান!’
সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল চিত্রালি। স্পষ্টতই খবরদারি করল আমার উপর। ‘হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও বুড়ো আঙুল দেখায়’ অবস্থা হয়েছে আমার। হাতের গ্লাসটা টাস্ করে টেবিলের উপর রেখে পাতা ওর শরীরের মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আমার সামনে দিয়ে বেড রুমে চলে গেল। আমি বরাবরের মতো চোখ মুদে সৌরভটুকু উপভোগ করতে পারলাম না।
‘আচ্ছা, সেই তখন থেকেই পাশ ফিরে শুয়ে আছো। কোন কথাও বলছ না, আমাকেও বলার সুযোগ দিচ্ছ না। কেন দেরি হয়েছে শুনবে তো, নাকি?
আমার কথার কোন উত্তর দিল না পাতা। থেমে থেমে ওর শরীর অল্প দুলে উঠছে। অবুঝ হয়ে কাঁদছে ও। আমার দিকে পাশ ফেরানোর জন্য ওর কাঁধে হাত রাখতেই কান্নার বেগ কিছুটা বেড়ে গেল। পাতার মুখটা আমার দিকে করে দেখি দু’গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা নামছে, আর লাইটের আলোয় তা চিক্চিক্ করছে।
হাত দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললাম, কেন বুঝতে চাও না? প্রাইভেট ফার্মের চাকরি, ইচ্ছে করলেই তো চলে আসতে পারি না। তাছাড়া অফিস ছুটির পর এক জায়গায় গিয়েছিলাম। অফিসের উল্টো দিকে কাঁচা রাস্তায় বিশ মিনিট মোটর সাইকেল চালিয়ে গেলাম আমাদের পিয়ন আনিসের বাড়িতে। তারপর ওর বাড়িতে গাড়ি রেখে কয়েক মিনিট হেঁটে, নৌকা করে নদী পার হয়ে আবার কিছুক্ষণ হেঁটে তবেই তো নন্দী চরের নিতাই বাবুর বাড়িতে পৌঁছলাম।’
পাতার কান্না কমে আসছে। আমার এমন জার্নির কথা শুনেই হয়ত। আমি উৎসাহ পেলাম। ‘কাজ সেরে আনিসের বাড়ি ফিরতেই সন্ধ্যা। এদিকে আনিসের স্ত্রী আমাদের জন্য খাবার দাবার রেডি করে বসে আছে। আনিস কিছুতেই আমাকে না খাইয়ে ছাড়বে না। বুঝো আমার অবস্থা।’
‘তুমি সকালে বললে বলেই তো দুপুরের আয়োজন করেছিলাম, নয় তো রাতের আয়োজনই করতাম।’
‘রাত ফুরিয়ে যায়নি। রাতের বিশেষ ব্যবস্থা করতে পারবে।’
‘ঢঙের কথা রাখো। বাবা, ছোট কাকা, কাকী সবাইকে কতক্ষণ বসিয়ে রেখেছিলাম। শেষে দুপুরের খাবার খাওয়ালাম বিকালে। একা বলে কাউকে সালামও করতে পারলাম না, দোয়াও নিতো পারলাম না।’
‘আচ্ছা, দোয়া কালকেও নেয়া যাবে। তুমি কি খেয়েছ?... চুপ করে আছ, তার মানে খাওনি কিছুই। না খেয়েই শুয়ে পড়েছ!’
‘না না না খেয়েছি, প্রচুর খেয়েছি। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত প্রচুর কষ্ট খেয়েছি। খেতে খেতে আমার চোখ দিয়ে কেমন পানি পড়ল দেখলে না!’
আমি চট করে উঠে বসলাম। এমনতর অভিমানের কথা শুনে শুয়ে থাকা যায় না। ঘুরে বসে দু’হাতের তালুতে পাতার মুখটা তুলে ধরলাম। ও চোখ বুঁজে ফেলল। আমার দু’হাত ভরা জ্যোৎ¯œাময় একখানা চাঁদ। অপূর্ব, অনিন্দ্য, অতুলনীয়, অসহ্য সুন্দর একখানা মুখ।
বারান্দায় বেরিয়ে দেখলাম উঠোনটা ফরসা জ্যোৎ¯œায় ঝলমল করছে। সিঁড়ির গোড়া থেকে উঠোনের মাঝামাঝি পর্যন্ত পেয়ারা গাছের ছায়া পড়েছে। পাতার ফাঁক গলে আসা জ্যোৎ¯œার কারুকাজে ছায়াটাকে ছাপা শাড়ির মতো লাগছে। পাতাকে ইশারা করে ছায়াটা দেখালাম। সে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখেছে। ওর মুখ না দেখেও বুঝতে পাচ্ছি ও মুগ্ধ হয়েছে।
ভৌতিক একটা শব্দে পাতা আমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে বারান্দার উত্তর দিকে তাকাল। আমিও তাকালাম, পিঞ্জিরার পাখিটা ডানা ঝাঁপটাচ্ছে।
‘পিঞ্জিরা? পিঞ্জিরার মধ্যে ওটা কি পাখি?
পাতা প্রশ্ন করে দ্রুত পায়ে পিঞ্জিরার দিকে এগুতে এগুতে নিজেই বলল, ‘ময়না, ময়না!’
ময়না পাখিটা পাতার কণ্ঠ নকল করে বলে উঠল, ‘ময়না, ময়না।’
আমি ধীর পায়ে এগিয়ে পিঞ্জিরার পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা মোটর সাইকেলের উপর আলতোভাবে বসলাম।
‘তোমার ময়না পোষার শখ। তাই তো আজ অফিস শেষে নন্দী চরে গিয়েছিলাম এই ময়না পাখিটা কিনে আনতে।’
‘তুমি একটা মহা দুষ্টু, ইতর, বানর... এত কষ্ট করে পাখিটা এনে আমাকে এতক্ষণে একবারও বলনি।’
পাতা মহা আনন্দে কথাগুলো বলল। আমার খুব ভাল লাগছে। হতচ্ছাড়া এই আমি শেষ পর্যন্ত সফল। আমার মন পাতার উত্তর দিল, তুমি আমাকে সে সুযোগটা দাওনি চন্দ্র পাতার কালি!
আমি উঠতে যাচ্ছি অমনই পাতা গর্জে উঠল, ‘নো নো, এখন তুমি আমাকে ছুঁবে না। ছুঁলে আমি আত্মহত্যা করব!’
বারান্দার লাইটের আলোয় আর বাইরের ফর্সা জ্যোৎ¯œার আভাতেও পাতার কৃত্রিম রাগে মুখের রঙ পরিবর্তন স্পষ্ট বোঝা গেল না। ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ লুফার মত ওর হাত দু’টি ধরে টান দিয়ে আমার পাশে বসালাম।
‘অন্য কিছুতে নয় আমার বুকের ভালবাসার সবটুকু গরল পান করে আত্মহত্যা করো।’
পাতা আমার বুকে মাথা রেখে শরীর দুলিয়ে হালকা শব্দে হাসছে। বাইরের অল্প ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ উত্থাল পাথাল জ্যোৎ¯œা ঢালছে। সিঁড়ির গোড়া থেকে উঠোনের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছাপা শাড়ির মতো ছায়া পড়েছে। বাড়ির পেছন দিকটায় ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে একটানা। আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর এই শারদীয় মোহন রাত আমার খুব খুব ভালো লাগছে।
শেষ পর্ব.
হেমন্তের দিনগুলো ফুরিয়ে গেছে, আজ পৌষের প্রথম দিন। কিন্তু আমার বুকে জমছে জলভরা মেঘ শ্রাবণের আকাশের মতো,দলা দলা আবেগ-শুস্ক নয় খুব বেশি আদ্র, মৃত নয় ঘুমন্ত অগ্নিগিরির মতো যার স্বভাব!
পত্রালি, আমার পাতার অসুখ করেছে। অসহায়ের মতো দেখি অসুখটা ওকে খুব ভোগাচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মাঝে মাঝে ককিয়ে উঠে তখন বেদনায় মুখটা নীল হয়ে যায়। প্রতিদিন ডাক্তার আসছেন, ঔষধ দিচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আমি সারাদিন ওর কাছে ঘুর ঘুর করি। একলা পেলে হাসি ঠাট্টায় ভুলিয়ে রাখতে চাই সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, বেদনাÑকিছুই পারি না। দিনে ও যতটুকু বা ভালো থাকে রাতগুলো যেন এক একটি কষ্টের হিমালয় হয়ে আসে ওর সামনে। ঘুমোতে পারে না, শুতেও ওর কষ্ট হয়, উঠে বসে, পায়চারি করে সেই হিমালয়ের আড়ালের সূর্যের প্রতীক্ষা করে।
অথচ এই ক’রাত আগেও পাতার কোন কষ্ট হত না। অবশ্য ওর ঘুম বেশ কিছুদিন থেকেই অনেক কমে গিয়েছিল। খুব সাবধানে এপাশ ওপাশ করত। গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম টের পেতাম না। কখনো মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখতাম পাতা ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তেÑকখনো দেখতাম স্থির চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমাদের ঘরে সারারাত মৃদু লাইট জ¦লে। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করে পাতা ঘুমুতে পারে না। এমনকি বাসর রাতেও সে আমাকে মৃদু লাইট অফ করতে দেয়নি। সারা বিরামপুর গ্রাম ইলেকট্রিসিটির আলোয় জ¦ল জ¦ল করে শুধু আমাদের এই বাড়ি ছাড়া। বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির সংযোগ নেয়ার ঘোর বিরোধী ছিল পাতা। ওর যুক্তি ‘সৌর বিদ্যুৎ নিরাপদ, হুট হাট করে অন্ধকারে হাবুডুবু খেতে হয় না।’ সব সত্যি। কিন্তু প্রথম প্রথম আমার মনে কিছুটা খুঁত ছিল। তবে মা পাতার কথা খুব পছন্দ করেছিলেন। তাই তো সৌর বিদ্যুতের শীতল আলোয় উজ্জ্বল এই বাড়ি।
এই তো ক’রাত আগেও শুয়ে শুয়ে আমরা অনেকক্ষণ গল্প করতাম। প্রতিটি গল্পে কিছু কথা কখনো ঝড়ের মতো-কখনো মৃদু ছন্দে ঢুকে পড়ত। হয়ত অফিসের কোন একজন কলিগ সম্পর্কে কথা বলছি, একটু শোনার পরই পাতা আমার চোখে অপলক দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকত। বুঝতাম ওর মন অন্য জগতে বসে স্বপ্নের ওল বুনছে। জিজ্ঞেস করতাম,‘কী?’
‘আমি কিন্তু ছেলে চাই!... আমার মন প্রাণ ঢেলে ওকে আমি তোমার আদর্শে মানুষ করব।’
‘উঁ-হুঁ, না। আমি মেয়ে চাই। সে হবে তোমার মতো সুন্দরী/দেখে তারে হার মানবে নীল আকাশের পরী।’
‘তুমি কবিতা লিখলে ভাল করতে। মহাকবি-র স্ত্রী হিসেবে লোকের সালাম, স্যালুট, নমস্কার পেতাম। হি-হি-হি।’
‘না লিখলেও একটা কবিতা তো প্রতিদিন পড়ি। তোমার মতো জলজ্যান্ত একটা কবিতা যার শব্দ-ছন্দ-উপমা, আবেগ-উচ্ছ্বাস-বিরহ, হাসি-কান্না-আনন্দ আমাকে ঘিরে থাকে চারপাশে থেকে।
আমার কথা শুনে পাতা তখন আমার বুকের কাছে মুখ রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকত। আর এখন সব গল্প-কবিতা পরবাসী হয়েছে।
মেয়েলি ব্যাপার-স্যাপার আমি কিছুই বুঝি না। ছোট কাকীর বয়স হয়েছে, তবুও পাতার বেশ যতœ করছেন। সানু আপাকে সব জানিয়েছি। আপা আগামীকাল আসছে। ও দুই ছেলে, জামাইসহ শহরে থাকে। ছোট ছেলেটার বয়স তিন, বড়টার বার্ষিক পরীক্ষা কাল শেষ হয়েছে। শহরের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার সময় বাবা-মা পর্যন্ত নিঃশ^াস নিতে ভুলে যায়, অন্য কিছু দূরে থাক।
পরশু ডেলিভারির তারিখ। পাতাকে জেলা শহরে নিয়ে সপ্তাহখানেক আগে একজন গাইনোকোলজিস্টকে দেখিয়ে এনেছি। কয়েক ধরনের টেস্ট করা হয়েছে। সানু আপার বাসায় দু’দিন ছিলাম। আপা পাতাকে রেখেই দিতে চেয়েছিল।
কোন অসুবিধা হলে হাতের কাছে ডাক্তার, হাসপাতাল।
কিন্তু পাতার প্রবল আপত্তি; ও কিছুতেই থাকবে না। সেখান থেকে ফেরা পরের রাত থেকেই অসুখটার বহিঃপ্রকাশ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ছোট কাকী মাগরিবের নামাজ আদায় করতে গেছেন। আমি পাতার একটি হাত আমার হাতে ধরে আছি।
‘আমার মনে হয় রক্তিমার মুখ কালকেই দেখতে পাবো।’
‘কালকে মানে? ডাক্তার পরশুর কথা বলেছেন না!’
‘আ-রে আমার শরীরে ওর বসবাস, ডাক্তারের চেয়ে আমি ওর মতিগতি ভাল বুঝি।’
পাতার কথা আমাকে মানতেই হল এবং প্রমাণ পেলাম রাত দশটার পর পরই পেইন উঠল। প্রসব ব্যথা কিনা বুঝার জন্য নিয়ামতুল্লাহ ডাক্তার ও প্রশিক্ষিত দাই ভোলার মাকে খবর দেয়া হল। তারা এসে ভাল করে দেখল। অভিজ্ঞ ভোলার মা থেকে গেল। নিয়ামতুল্লাহ ডাক্তার আপাততঃ সমস্যা নেই বলে চলে গেলেন, সকালে আসবেন।
কিন্তু সমস্যা শুরু হল মধ্যরাতে। পাতার শরীরের তাপমাত্রা কমতে শুরু করল। হাত, পা বেশ ঠা-া হয়ে গেছে। এমনিতেই শীত পড়েছে তার উপর অসুস্থ শরীর, তাপমাত্রা কমারই কথা। ভোলার মা হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে, ছোট কাকী স্টোভে কাপড় গরম করে শরীরের বিভিন্ন অংশের উষ্ণতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমি একপাশে বসে পাতার মাথায় সান্ত¡নার পরশ বুলাচ্ছি। পাতার কঁকানো বেড়ে গেল। নিশ্চয়ই ব্যথা বাড়ছে। ওর নিভু নিভু চোখের তারার দিকে তাকালে বুক ধড়ফড় করে উঠে।
‘তুমি ঐ রুমে যাও বাবাজী। সময় বেশি নাই।’
ভোলার মার ব্যস্ত কণ্ঠ শুনে আমি উঠতে যাচ্ছি, পাতা আমার একটা হাত চেপে ধরল। অন্যহাতে ইশারা করে কাছে ডাকল। আমি ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়লাম। ও ফিসফিসিয়ে উঠল।
‘তোমার পাতা হলুদ হয়ে গেছে, ঝরে পরার অপেক্ষা মাত্র। দীপ, আমাদের রক্তিমা!’ ও ককিয়ে উঠল।
‘তোমার কিস্যু হবে না পাতা, আল্লা আল্লা কর।’
আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। টলতে টলতে ড্রইং রুমে এলাম। ছোট কাকা শুকনো মুখে সোফায় বসে আছেন। বাড়িতে মানুষ এই কয়জনই। মা মারা গেছেন ২৩ শে মার্চ, আমার শাশুড়ী পুরোপুরি বিছানা নিয়েছেন, সানু আপা কাল আসছে, ছোট কাকার ছেলে মেয়েরা সবাই ঢাকায় থাকে। আমার শ^শুর চিত্রাকে নিয়ে আসবেন ফযরের পর, মোবাইলে কথা হয়েছে। চিত্রা আনন্দমোহনে পড়ে, আজই বাড়ি এসেছে।
পাতা আল্লা, আল্লা, বলে গোঙাচ্ছে। আমার হাত-পা কাঁপছে। পাশের বাড়ির সাবিনা ভাবি, রুবেলের মা, বালি দাদী, কলির মা ঘরে ঢুকল। ছোট কাকা আর আমি বাইরে চলে এলাম। বেশ কুয়াশা পড়েছে। হরিণের বাঁকা শিংয়ের মতো চাঁদটাকে কুয়াশায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লা আল্লা করছি মনে মনে।
পাতার গোঙানো কমে এসেছে। ভোলার মার গলা শুনলাম।
‘ব্যথা বাড়া-কমা ভালা না, সবাই আল্লা আল্লা করেন, দরুদ পড়েন।’
ছোট কাকা ফিস ফিস করে ইয়াসীন পড়া শুরু করলেন, আমি মনে মনে দরুদ পড়ছি।
চাঁদের আলো ফিকে হয়ে এসেছে। পূর্বাকাশে বিজয় দিবসের সূর্য প্রথম রক্তিম আভা ছড়াতে শুরু করেছে। আমি বাইরের বারান্দায় ড্রইং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। অল্প দূরে ছোট কাকা, বছির কাকা, মণি দাদা বসে গল্প করছেন। আমার সামনে বারান্দার নিচে হাসনাহেনার ঝাড়। ওর একটি ডাল বারান্দার গ্রীল গলে ভেতরে ঢুকেছে। সেই ডালে একটি হলুদ পাতা।
আমার পাতা রাতে বলেছিল সে হলুদ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন নিশ্চয়ই সে গাঢ় সবুজ হয়েছে, কারণ তার বুকে আছে রাঙা সূর্যের মতো আমার মেয়ে রক্তিমা। অল্পক্ষণ আগে যে জন্মেছে। ছোট কাকী বেড রুমের দরজা থেকে হাসতে হাসতে আমাকে ডাকলেন আমার মেয়ে দেখার জন্য। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। তখনি আমার পেছনে আমাদের বাড়িতে আসার রাস্তার দিকটায় রিকশার ঝুপ্ ঝাপ্ আর বেলের টুন্ টুন্ টুন্ শুনতে পেলাম। আমি জানি ওদিকটা কুয়াশায় ঢাকা। হলুদ পাতাটি ফেলে দিয়ে পেছনে না ফিরে সামনে পা বাড়ালাম। সামনের দিকটা আমার জন্যে বড় বেশি গর্বের, বড় বেশি সুখের, বড় বেশি আনন্দের!