একটি মেয়ের গল্প
আব্দুল্লাহ আল তানিম
এটা আমার ছোট্ট গল্প, একটা মেয়ে গল্প, আমার নিজের গল্প। আমার গল্পে কোনো ভিলেন নেই, নেই কোনো হিরো, তবু বড় মিস্টি গল্প।
আমার না, বাবা নেই জানেন; না না কোনো অসুখে মারা যায়েনি, আমাকে আর মা কে ইচ্ছা করে ছেড়েও যায়নি। বাবার ছিল ঘুরতে যাওয়ার নেশা, মা বাইরে বাবার এই নেশাটাকে নিজের সতিন বললেও, ঘুরতে যাওয়াকে ঘিরে বাবার যে আনন্দ সেটা দেখে মাও কম খুশি হত না। আমার তখন চার বছর বয়স, চার বছরেই আমি বেশ কিছু জায়গা ঘুরে নিয়েছি বাবা-মার সাথে।
যদিও আমার কিছু মনে নেই, যেটা শুনেছি, সেবার আমরা পুরি গেছিলাম। আমি ছোট, রোদ লেগে পুড়ে যাব, শরীর খারাপ করবে ভেবে মা আমাকে নিয়ে হোটেলেই ছিল, বাবা একা গেছিল সমুদ্রস্নান করতে, কিন্তু আর ফেরেনি। সবাই বলেছিল যে বাবা ভেসে গেছে, অনেক ডুবুরি, নুলিয়া, কোস্টগার্ড নাবিয়েও বাবাকে পাওয়া যায়নি। সবাই বলত যে বাবা মারা গেছে, মা এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিত না, প্রশ্ন করলে আদর করে এড়িয়ে যেত।
কি ভাবছেন? আহারে বাপ-মরা মেয়ে, কিভাবে সংসার চলত, কি করেই বা পড়াশুনা করত, তাই না? আমার মা না, একটা মাল্টিন্যাশনাল কম্পানির এক্সিকিউটিভ পদে চাকরি করত, আমার জন্মের আগে থেকেই, আর আমার খেয়াল রাখত বিমলের মা।
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে কিছুটা স্নেহবশে ও মাও তার যোগ্য প্রাপ্য দিত, সে আমাদের বাড়িতেই সকাল থেকে রাত, মা বাড়ি না আসা অবধি থাকত। পড়াশুনা জানত না, কিন্তু বসে থেকে আমার হোমওয়ার্ক করিয়ে নিত। মা যখন আমার জন্য টিউটর রাখল, বিমলের মা ঠায় দরজার কাছে বসে থাকত যতক্ষণ স্যার পড়াতেন, একমুহুর্তের জন্যও অন্য কোথাও যেত না। তার পেটে কোনো কথা থাকত না ঠিকই, কিন্তু মায়ের ব্যপারে কেউ কিছু বললেই ঝেড়ে ভুত ভাগিয়ে দিত।
বড্ড একঘেয়ে গল্প না? কোনো পুরুষ চরিত্র নেই; দাঁড়ান, গল্প এখনও বাকি। আমার হিরো ছিল দিবাকর আঙ্কেল, মায়ের ছোটবেলার বন্ধু, বাবারও বন্ধু। প্রতি রবিবার ছিল দিবাকর আঙ্কেল এর সাথে বিকালে বেড়াতে যাওয়ার দিন। খুব আনন্দ হত যখন দিবাকর আঙ্কেলের সাথে মিলে বাকি বন্ধু আর তাদের বাবাদের ভিডিও গেম এ হারিয়ে দিতাম।
একদিন হঠাৎ করে সৈকত আমায় প্রশ্ন করল, ‘দিবাকর আঙ্কল কি তোর নতুন বাবা? মা বলছিল তোর মা ওনাকে বিয়ে করবে’। শুনে তো আমি আল্লাদে আটখানা, তাহলে তো বেশ হয়, আঙ্কেল শুধু রবিবার না, রোজ খেলা করবে আমার সাথে। কেন জানি না, সৈকত বলল এটা নিয়ে আমার খুশি না, লজ্জা পাওয়া উচিৎ। হিংসুটে একটা, দিবাকর আঙ্কেল আগের রবিবারই আমার সাথে মিলে সৈকত আর সৈকতের বাবাকে বাজে ভাবে হারিয়ে দিয়েছিল।
মাকে প্রশ্ন করতে, মা আবার আদর করে এড়িয়ে গেল। তার কিছুদিন পরে, এক রবিবার, বেড়াতে যাব বলে আঙ্কেলকে বারবার ফোন করলাম, কিন্তু আঙ্কেল এল না, ফোনও ধরল না, মাকে প্রথমবার আমি কাঁদতে দেখি। বিমলের মা বলল, ‘দিবাকর দাদাবাবু তোমায় হস্টেলে পাঠায়ে দিতে চায় গো, দিয়ে তোমার মা রে বে করবে। আমি বলে দিলুম বাপু, এমন অনাছিট্টি হতে দিমু নি। মার থিকে মেয়েকে আলাদা করে দেবে, এ কেমন মানুষ গো”। এরপর অনেকদিন পরে দিবাকর আঙ্কেল কে রাস্তায় দেখি আমার প্রিয় আইসক্রীমের দোকানের সামনে, এক আন্টির সাথে, আমি কথা বলতে গেলে কেন জানি না আমায় চিনতে অস্বীকার করল।
কি বলেন, এই মেয়ে প্রেমে পড়তে পারে? খুব সহজেই প্রেমে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক, তাই না? একদম ঠিক। আমি প্রেমে পড়ি আমার থেকে দুই বছরের বড় অভিদার। নেহাত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি, না তো বলতাম, ‘আমি তখন নবম শ্রেণী, আমি তখন শাড়ী’; হ্যাঁ, আমি সেদিন শাড়ী পরেছিলাম,। তারপর আমি আর অভিদা বেড়াতে বেরুইছিলাম। বাড়িতে ফেরার সময় ফাঁকা রাস্তাটায় অভিদা হঠাৎ করে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘শোন,আমার তোকে খুব ভাললাগে,আমার জিএফ হবি?’ আমারও অভিদাকে বেশ ভালই লাগত, কিছু না বলে মুচকি হেসে মুখ টা নাবিয়ে নিলাম, একটা আলাদা অনুভুতি।
অভিদা আস্তে করে আমার থুতনি ধরে মুখ টা তুলে ধরে ঠোঁটে আমার জীবনের প্রথম চুম্বন এঁকে দিল। কাঁপা কাঁপা পায়ে বাড়ি ফিরলাম। দরজা বন্ধ করে সন্ধে অবধি পড়ে থাকলাম নিজের ঘরে, হাজার ডাকাডাকি তেও ভোগ খেতে গেলাম না। বিমলের মা থাকলে হয়ত জোর করে নিয়ে যেত, কিন্তু সেও কাজ ছেড়ে গুজরাট চলে গেছে ছেলের কাছে। এরপর মাসকয়েক কেটে গেছে, আমাদের প্রেম ও পড়াশুনা সমান তালে চলছে।
একদিন মা রাতে বাড়ি ফিরে সবে কফির কাপ নিয়ে বসেছে, অভিদার মা ও পাড়ার আর কিছু মহিলা এলেন। তাঁদের অভিযোগ আমি নাকি আমার মায়ের মত নষ্টামি শুরু করেছি, পাড়ার ছেলেদের থেকে যেন দূরে থাকি, ওরা সবাই ভদ্রবাড়ীর ছেলে। আমি বুঝিনি আমি ও মা কি অভদ্রতা ও নষ্টামি করেছি, কিন্তু মা জীবনে প্রথমবার আমার গায়ে হাত তোলে। সেই রাতে মাও কিছু খায়েনি, আমরা নিজের নিজের ঘরে খুব কেঁদেছিলাম। বুঝতে শিখি, যেহেতু বাবা নেই, তাই অনেকের কাছে আমাদের বেঁচে থাকাটাও দোষের।
খুব নারীবাদি লাগছে না? যে পুরুষদের ঘৃনা করে? হ্যাঁ তা একটু ইতস্তত হত বটে, কিন্তু ঘৃনা ঠিক না। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন কম প্রস্তাব পাইনি, তবু ইচ্ছা হত না কোন সম্পর্কে জড়াতে। প্রেম এল আরো এক বসন্তে, আমার বান্ধবীর হবু বরের বন্ধু, পেশায় ব্যবসায়ী।
আমি তখন হাসপাতালে রোগী আর ছুটির দিনে প্রেমী সামলাতে সামলাতে মা কে প্রায় ভুলেই গেছি। হুঁস ফিরল, একদিন একটা ফোন আসায় থানা থেকে, আমার মা নাকি রাস্তায় বেরিয়ে ফেরার পথ মনে করতে পারছে না, এক সহৃদয় ব্যক্তি মাকে থানায় দিয়ে গেছে, মায়ের ফোন থেকে আমার নম্বর পেয়ে যোগাযোগ করে। মায়ের অ্যলঝাইমার ধরা পড়ে। মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়, কিন্তু জানি এ রোগ সারবার নয়। বিমলের মা ততদিনে ছেলের সংসার থেকে বিতাড়িতা হয়ে ফিরে এসেছে; আমার দেখাশুনা করত, এখন মায়ের। এর মধ্যে আমার প্রেমী এল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, সঙ্গে একটি শর্ত; আমার সঙ্গে সংসার পাতবে ঠিকই, কিন্তু সেখানে জায়গা হবে না আমার মা আর বিমলের মায়ের।
অনেকদিন পর দিবাকর আঙ্কেলের মুখটা মনে পড়ল আমার, ভাগ্যের পরিহাসে এরও নাম দিবাকর; নাম যখন এক, প্রস্তাবও যখন এক, পরিণাম টাও একই ছিল।
অনেকদিন পর ফেসবুক খুললাম, অনেক মেসেজ জমে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নাকি বলেছে, সন্তানধারনের জন্য ছাড়া তার কোনো পুরুষের দরকার নেই, এই নিয়ে তুমুল ঝামেলা। পাগলী একটা, একটু ভুল বলেছে; বলা উচিৎ, “যে পুরুষ আমার প্রাপ্য সম্মান দেয় না, সেই পুরুষের কোনো দরকার নেই।