স্বজন দ্বিষৎ
শফিক নহোর
আমি তখন মাল্টি-প্লানে ওয়েস্টার্ন আইটিতে কর্মরত, প্রতিদিন শত-শত কাস্টমার , পরিচিত অপরিচিত লোকজন আসছে ; প্রোডাক্ট কিনছে , কথা বলছে , সমাধান করা হচ্ছে কাস্টমারদের সমস্যা । তবুও কেউ-কেউ অখুশি । পৃথিবীতে সবাইকে খুশি রাখা সম্ভব না । একজন নয়ন-অভিমুখে অকস্মাৎ বলে ওঠলো ,
- ভাই কেমন আছেন ?'
মুখে একটু মেকি হাসি এনে বললাম ,
- জ্বি ! ভালো আছি ।
এটা আছে , সেটা আছে , এটা দেন । কিবোর্ডটা দেন , মনিটর নষ্ট হইছে ; ওয়ারেন্টি ছিল , দিচ্ছেন না কেন ওয়ারেন্টি ?'
নানা রকম কথা বলতে হয় কাস্টমারদের সঙ্গে । আপনি তো দেয়ার আগে কত সুন্দর করে বলেছিলেন ;
- এটা একবছরের ওয়ারেন্টি , নষ্ট হলে নিয়ে আসবেন ।
-ভাই এক বছরের ক'য়েক দিন পার হয়েছে ; দেখেন কোন সিস্টেম করে কোন কিছু করা যায় কি—না ।
কত রকমের আবদার যে থাকে মানুষের । বিল পেপারে সবকিছু লেখা আছে । তবু একের পর এক প্রশ্ন করে যাবে , একই জিনিস বারবার বলবে , '' একটা কথা আছে কাস্টমার অলওয়েজ রাইট
" সেই মোতাবেক আমাদেরকে চাকরি করতে হয় সেলস-ম্যান হিসেবে ।
আমি কাস্টমারকে বিদায় দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একজন অপরূপা সুন্দরী দোকানে প্রবেশ করল,
-এক্সকিউজ মি ম্যাডাম , আই ক্যান হেল্প ইউ ?'
মেয়েটি মুসকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে রইল , কোন জবাব দিল না । আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম ; আমি মাথা নিচু করে অন্য কিছু খোঁজার ভান ধরলাম ।
মেয়েটি খবরের কাগজ উল্টো করে ধরে পড়ার চেষ্টা করছে , আমি তা দেখে ব্যঙ্গময় হাসি হেসে ঠোঁটের কার্নিশে ধরে রাখলাম কষ্ট করে ।
আমাকে লক্ষ্য করে বলল ,
- ওয়্যারলেস মাউস হবে কি ?'
- আমি মাথা নেড়ে তাকে সম্মতি জানালাম যে -হ্যাঁ হবে।
- প্লিজ ! ওয়ান পিস ।
- হাউ মাচ প্রাইস ?'
- নাইন হান্ড্রেড ফিফটি টাকা অনলি ফর ইউ ম্যাডাম ।
কাস্টমারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম উনি বাংলাদেশে নতুন এসেছেন ;
কম্পিউটারের আনুষঙ্গিক কোন বিষয় প্রয়োজন হলেই উনি আমাদের দোকানে আসতেন । একটা সময় ওনার সঙ্গে আন্তরিকতা গভীর হয় , বিশ্বাস বাড়ে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গাঢ় হয় ।
আমার ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত হয় । মাঝে—মধ্যে বেয়ারা কথা হতো ,আমার বিভিন্ন ছবিতে তার মন্তব্য থাকতো , আমি তাকে মন্তব্য করতাম ।কী আশ্চর্য একটি নাম , ইলিজা টাউন
অফিস থেকে বাসায় আসতে অনেক রাত হত , বউ রেগে থাকতো প্রতিদিন , আমি অসহায় মানুষের মত সবকিছু সহজে মনে নিতাম । ছেলেমেয়ে , সংসারের কাজ রুপা , একাই সামাল দেয় । মেয়ের সিপি রোগ , তিন-বেলা থেরাপি দেওয়া , ছেলেকে স্কুলে নেয়া আসা । সংসারের অভাব অনটন । রুপা , ট্রেলাসের কাজ করে , কিছু টাকা আসে প্রতিমাসে যা রুপার হাত খরচের টাকাপয়সা আর এক্সট্রা লাগে না তেমন তবুও আমি কখনো কখনো দুই চার বিশ-টাকা রেখে দেই ওর ভ্যানিটি ব্যাগে ।চেহারার দিকে তাকালে বড্ড মায়া হয় । ছেলেটি আজ ক’দিন গরুর মাংস খেতে চেয়েছে ; হাতের যে অবস্থা । ছেলেকে নয় ছয় বুঝ দিয়ে বললাম ,
-বাজান , আমি বেতন পেলে তোমার জন্য গরুর মাংসের তোহারি নিয়ে আসব । এখন লক্ষ্মী ছেলের মত মায়ের কাছে একটু পড়তে বসো ।
কোনমতে ছেলেকে বুঝিয়ে , পাশের রুমে একটা বই নিয়ে পড়তে বসলাম । আজকাল এত ব্যস্ত হয়ে গেছি ; বই নিয়ে বসবার সময় একদম নেই । বউ মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকবে ! সারাদিন টিপাটিপি কথা বলতে গেলেই ,
-তোমার সংসারের কোন কাজ ফেলে-তো আমি মোবাইল চালাচ্ছি না । সংসারের কোন কাজটা তোমার দিয়ে হয় শুনি ?'
কথার পরে কথা বলতে গেলেই বাসায় অশান্তি শুরু হয়ে যাবে । আমি চুপচাপ ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে অনেক অন্যায় আবদার মেনে নেই । আমি নিজেই ভাবি , সংসারের জন্য ছোট চাকরি করে কি করতে পারলাম । ঠিকমত সংসার চারাতে পারছি না , প্রতিমাসে বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে । মনে হচ্ছে দেশে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে ; কোরবানির ঈদ ছাড়া ঘরে গরুর মাংস উঠে—না । বউয়ের পছন্দ মত কোনদিন বাজার করতে পারলাম না । বউয়ের প্রতি আমার সত্যিকার অর্থে কোন অভিযোগ নেই । অভিভাবক বিহীন একটি সমাজ, ধীরে ধীরে অতল গভীরে তলিয়ে যাবে সংসারের মত ।
সচরাচর মোবাইল ফোনের লক খোলা থাকে রুপা, সেদিন হুট করে আমার মোবাইলের বার্তা বিভাগে ঢুকে গিয়েছে , আমার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছিলো । হঠাৎ এরকম মনে হল আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম । কেমন যেন অস্বস্তি বোধ গ্রাস করছে আমাকে । মানসিকভাবে দিন-দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছি ; নাকি আমার কোন ডাক্তার দেখানো উচিত । নয় ছয় ভাবতে ভাবতেই হাত থেকে কাঁচের-গ্লাস পড়ে গেল ,
-রুপা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল ,
-সারাদিন বাল করে , সংসার ঠিকমত চালাতে পারে—না । বউ চালাতে পারে না । গ্লাস ভেঙে সংসার উদ্ধার করছে শায়াকাঠি ! আজ ক’দিন ধরে বলছি , মাথার চুল গুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে , বাসায় আসবোর সময় নারকেলের একটা তেল নিয়ে এসো ।কথা বলতে গেলেই আমি খারাপ , ছোটলোক ।কত রকমের যে বাহানা দেখাবে ।
-কি হলো কিছু বলছো না যে , তোমার মোবাইলের ইনবক্স দেখলে ঘৃণা হয় , চরিত্র এত নিচে নেমেছে তোমার, লজ্জা হয় না । মেয়ে দিনদিন বড় হচ্ছে , ছেলে কদিন পরে তোমার মত মোবাইল চালাতে চাইলে , আমার তো গলায় ধরি দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই ।
-বাতেন তুমি বলও ত , ইলিজা টাউন কে ?' যে তোমাকে বিভিন্ন অরুচি পূর্ণ বার্তা দিয়ে মোবাইলের গোডাউন ভরে ফেলছে ; তোমার সঙ্গে আমার সংসার করা উচিত না শুধু ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সংসার করছি ; তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি ।
-রুপা সত্যি বলছি , সে আমাদের দোকানের কাস্টমার পাকিস্তানি দূতাবাসে চাকরি করে ।সে একজন পাকিস্তানি মেয়ে ।
রুপা কোন কথাই মানতে নারাজ , আমি পরের দিন ইলিজা টাউনের সঙ্গে দেখা করলাম । অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করলাম , সে ভাল বাংলা বলতে পারে এখন ।
-তুমি আমাকে এত নোংরা বার্তা দিয়েছও কেন ? আমার স্ত্রী দেখে আমার সম্পর্কে খুব বাজে ধারণা করছে , এখন তো আমার সংসার টিকে থাকা দ্বায় ।
-বাতেন এত ভয় পাবার কিছু নেই । আমার সম্পর্কে তোমাকে একটু বলি , আমি সরকারি একটা চাকরি করি , এখন তোমাদের দেশে আছি । আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে যেতে পারি । আমার একটা বদভ্যাস আছে । আমি মূলত একজন হ্যাকার । বিভিন্ন মেয়েদের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ছেলেদেরকে ভয় দেখাই । কি ব্যাপার এত ভয় পেয়ে গেলে কেন ? আমি ঢাকাতে আসবার পর থেকে প্রায় তিন-হাজার আইডি হ্যাক করেছি ; তার সমস্ত তথ্য তোমাকে দেখাবো !
তোমাদের দেশের মেয়েরা প্রচুর পরকীয়া সম্পর্ক করে এবং তাদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে শুরু !
আমি অবাক !
-তুমি এসব কি বলছো , আমি কোন ভাবেই ইলিজা টাউনকে বিশ্বাস করতে পারছি না । তথ্য গুলো যখন আমাকে এক এক করে দেখাতে লাগল , আমার গলা শুকিয়ে আসছে , মানুষ কি তাই এত বেহায়া হতে পারে । আমি অনেক কিছু যোগবিয়োগ করি । দেখতে দেখতে একটি আইডির লিংক চোখে বেধে গেল ।
ছিঃ রুপা তুমিও ?' চোখ ঝাপসা হয়েছে , আমি কিছুই দেখতে পারছি না আর । আজ এলিজা টাউন , আজ ঢাকা ছেড়ে চলে গেল ।