পাহাড় ও মেঘের কথোপকথন
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
কিছু
মেঘ দলবেঁধে গান ধরে আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক সময় হঠাত্ একটা মেঘ একটি
পাহাড়ের চূঁড়ায় এসে ধাক্কা খেল। মেঘ পাহাড়ের কাছে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চাইলে,
পাহাড় খুব গম্ভীর ভাবে হেসে ক্ষমা করে দিল। মেঘ তখন সাহস নিয়ে পাহাড়ের
সাথে গল্প করা শুরু করলো।
মেঘঃ ও পাহাড় ভাই, কেমন আছো তুমি?
পাহাড়ঃ এই তো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। তুমি নিশ্চয়ই বেশ ভালোই আছো। মনের আনন্দে গান গেয়ে ভালোই তো ঘুরে বেড়াচ্ছো।
মেঘঃ হুম, তা ঠিক বলেছো কিন্তু তোমার গলায় কেমন যেন অভিমানী সুর। তোমার কি হয়েছে বলো?
পাহাড়ঃ কি বলবো বলো, দিনে দিনে আমার ভূপৃষ্টের মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে কিছু মানুষ, দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে।
মেঘঃ
তোমার কথা শুনে খুব কষ্ট পেলাম। তবুও তোমার সময় কাটে ভালো। তোমার সমস্ত
শরীর জুড়ে সবুজ অরণ্য, কতো গাছগাছালি, কতো পশুপাখি, কতো গান আর কতো সুর,
আহা.. তোমার কি আনন্দ...
পাহাড়ঃ
হা হা হা... সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছো কিন্তু ওই যে কিছু মানুষের কথা বললাম।
ওরা শুধু মাটি কেটে নেওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হয়নি। দিনে দিনে আমার গাছগাছালি
কেটে উজাড় করে দিচ্ছে, পশুপাখি গুলো মেরে ফেলছে। মাঝেমধ্যে আমার শরীরে আগুন
ধরিয়ে দেয়, পশুপাখি গুলো পালিয়ে যাচ্ছে আরও গহীন অরণ্যে। আমিও ওদের বিদায়
দিচ্ছি, মানুষের কাছ থেকে দূরে গিয়ে বাঁচুক।
মেঘঃ
সত্যি তোমার কথাগুলো শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে। মানুষ যে কতোটা
নিষ্ঠুর, কতোটা নির্মম, ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা, এই নিষ্ঠুর মানুষদের
সম্পর্কে কিছু বলো।
পাহাড়ঃ এদের সম্পর্কে কি বলবো বলো, লজ্জা..!! লজ্জা..!! লজ্জা..!!
মেঘঃ কি হলো পাহাড় ভাই, তোমার চেহারা এভাবে ফ্যাকাশে হয়ে গেল কেন?
পাহাড়ঃ
মানুষ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করো না মেঘ, আমার ভীষণ কষ্ট হয়। কি বলবো ওদের
কথা, কতো অন্যায় অবিচারের সাক্ষী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি।
মেঘঃ
তবুও তুমি বলো, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। এই মানুষদের অন্যায় অবিচার
থেকে আমরাও রেহাই পাচ্ছি না। ওদের কারণে দিনে দিনে আমাদের পরিবেশ সাংঘাতিক
রকম দূষিত হয়ে যাচ্ছে। তাই এই মানুষ গুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
পাহাড়ঃ
বেশ, তবে শোন। আমি ওদের হাজার হাজার অন্যায় অবিচার দেখেছি আর নীরবে সহ্য
করে গেছি। এই তো, কিছু দিন আগের একটা রাতের ঘটনা বলি, শোন তবে।
মেঘঃ হ্যাঁ, আমিও খুব অধীর আগ্রহে বসে আছি, শুরু করো। ওই রাতে কি হয়ে ছিল?
পাহাড়ঃ হঠাত্ করেই মাঝ রাতে একটি বাচ্চা মেয়ের চিত্কার করা কান্না শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
মেঘঃ বাচ্চা মেয়েটির কি হয়ে ছিল পাহাড় ভাই?
পাহাড়ঃ উহ্, কি বলবো তোমাকে, লজ্জা..!! লজ্জা..!! লজ্জা..!!
মেঘঃ ধেত্, আসল ঘটনা বলতো তুমি, সেই কখন থেকে বসে আছি। কি হয়ে ছিল ওই বাচ্চা মেয়েটির সাথে?
পাহাড়ঃ
আমার ঘুম ভাঙতেই দেখলাম কিছু নরপিশাচের দল ওই বাচ্চা মেয়েটিকে উলঙ্গ করে
পালা ক্রমে ধর্ষণ করে যাচ্ছে। খুব সুন্দর পরীর মতো চেহারা বাচ্চা মেয়েটি
চিত্কার করে কান্না করে যাচ্ছে আর বারে বারে জ্ঞান হারাচ্ছে।
মেঘঃ কি বলছো পাহাড় ভাই...!!! এটাও কি সম্ভব...!!! বাচ্চা মেয়েটির কান্না শুনে ওদের কি একটুও দয়া মায়া হয়নি???
পাহাড়ঃ ওদের আবার দয়া মায়া, হেহ্... বাচ্চা মেয়েটি যতোই চিত্কার করে কান্না করে যাচ্ছিল, ওরা তখন আনন্দে উল্লাসে মেতে উঠে ছিল।
মেঘঃ তোমার কথাগুলো শুনে মানুষের উপর প্রচন্ড রকম ঘৃণা জন্মে গেছে। যাইহোক, তারপর কি হলো বলো?
পাহাড়ঃ
বাচ্চা মেয়েটির তলদেশ দিয়ে রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল আর সেই রক্ত দিয়ে ওরা
হোলি খেলা করে ছিল। আর বলতে পারছি না মেঘ, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
মেঘঃ
আমার চোখে পানি চলে এসেছে, তবুও শুনতে চাই। দয়া করে আমাকে পুরো ঘটনাটা
বলো, যতোই কষ্ট হউক তোমার। বাচ্চা মেয়েটির সাথে শেষ পর্যন্ত কি হয়ে ছিল?
পাহাড়ঃ
বাচ্চা মেয়েটি এক সময় থেমে গেল। আর কোন শব্দ করছে না। নিথর শরীর আমার বুকে
রেখে শুয়ে রইলো কিন্তু তখনও অত্যাচার অব্যাহত ছিল। এক সময় নরপশু গুলো
ক্লান্ত হয়ে গেল। তখন বুঝতে পারলো, বাচ্চা মেয়েটি এখন মৃত।
মেঘঃ উফফঃ কতোটা নিষ্ঠুর... কতোটা নির্মম... তুমি ঠিকই বলেছো, ওরা মানুষ নয়, ওরা পশু। তারপর কি হলো বলো???
পাহাড়ঃ ওদের চেয়ে আমার পাহাড়ি পশু গুলো ঢের ভালো। ওরা হচ্ছে নরপশু, সবচেয়ে নিকৃষ্ট পশু।
মেঘঃ হ্যাঁ, তা তো বটেই। যাইহোক, তারপর কি হলো???
পাহাড়ঃ তারপর ওরা মেয়ে বাচ্চাটিকে আগুনে পুড়িয়ে চলে গেল। পরীর মতো সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটির শুধু কঙ্কাল টুকু অবশিষ্ট রইলো।
মেঘঃ
সত্যি, তুমি ঠিক বলে ছিলে, লজ্জা..!! লজ্জা..!! লজ্জা..!! এই ঘটনা শুনে
আমার চিত্কার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে হচ্ছে বজ্রপাত করে এর
প্রতিবাদ করি।
পাহাড়ঃ তবে তাই করো। আমি হয়তো পারছিনা কিন্তু তুমি চাইলে পারবে মেঘ, তুমি পারবে, অবশ্যই পারবে।
মেঘঃ একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ধ্বংস হবে এই মানুষ গুলোর অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারে। যাইহোক, আজকে গেলাম, তুমি ভালো থেকো।
পাহাড়ঃ হুম, একদম ঠিক বলেছো। আমার আর ভালো থাকা, জানিনা কতো দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো। তুমিও ভালো থেকো।
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
চৌধুরীপাড়া, মালিবাগ, ঢাকা।