অচিনপুর
আহমদ মেহেদী
মাঝেমধ্যে চলার পথে ভাংতি টাকা নিয়ে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সকাল বেলা টেক্সি ড্রাইভারকে যদি একশ অথবা পাঁচশ টাকার নোট দেওয়া হয়, ঘুষখোর পিয়নদের মতো মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলবে-আরে ভাই এত সকালে এত বড় নোটের ভাংতি পামু কই? ভাঙিয়ে দেন। তখন ভাংতির জন্য এখানে-ওখানে ছুটাছুটি করা খুবই বিরক্তিকর। লক্ষ করেছি যে সময় পকেটে ভাংতি টাকা থাকে সে সময় দরকার পড়েনা । যখন থাকেনা তখন দরকার বেশি পড়ে। শহরের দোকানদারেরাও ভারতীয় সিরিয়ালের সিআইডির মতো চশমার নিচ দিয়ে কেমনে জানি তাকায়। তখন ঠাস করে তাদের গালে একটি চড় মারতে ইচ্ছে করে। একজন মানুষ ত তোমার কাছে বিপদে পড়ে ভাংতির জন্য এসেছে, তুমি তাকে সহযোগিতা করবে এই যা! এটাই আশা করে একজন মানুষ মানুষের কাছে। কিন্তু সে তার দোকানে খরচ করা ছাড়া ভাংতি দিবে না? তাহলে ছেলেবেলা থেকে মানুষের প্রতি আমার যে ধ্যান-ধারনা লালন করে আসছি তা কী ভুল। কেন এমন হল এই পৃথিবীর মানুষের ! জাগতিক ভাবনার কারনে দিনে দিনে সবাই কেমন জানি নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছি না আমরা? জানো, শানু তুমি শুনলে অবাক হবে। সারাদিন চাকরির কাজে কত জায়গায় যাওয়া পড়ে। পাশের একটি দোকানে গেলে পানি চেয়েও পাওয়া যায় না মধ্যম আয়ের বাংলাদেশে। সোজাসুজি মুখের উপর বলে দেবে ব্যবস্থা নাই, মিনারেল ওয়াটার আছে দেব? সে দোকানদার আদৌ কি জানে কারো কারো পকেটে ঐ পনের টাকা কোন কোন সময় থাকেনা।
হইছে তুমি চুপ কর, অনেক হয়েছে। এখন ফ্রেশ হয়ে এসো, আমি তরকারি গরম করব। ও তোমাকে বলতে ভুলে গেছি বাড়িওয়ালা এসেছিল বিকালে। টাকাটা দিতে পারবে এই মাসে?
দেখি কী করা যায়।
শানু পাশের রুম থেকে কথা বলছে তাই আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। মৃদু কণ্ঠে বলছে কত করে বলি এসব খাইও না। তারপর ও কথা শুনবে না, শার্ট থেকেও সিগারেটের গন্ধ আসছে! যেদিন মরে যাব তখন বুঝবে বারন করার মানুষটি তোমাকে কত ভালবাসত। আমি ত চাইনা তোমার স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হউক। ঘর্মাক্ত শার্ট-প্যান্ট কাঁধে নিয়ে বলতে বলতে বাথরুমে চলে যায় সে। বাসায় আর ভাল শার্ট-প্যান্ট নাই বিধায় তাই ধুয়ে রাতে শুকালে সকালে তা পড়েই আবার বের হতে হবে। শানু এলে একসঙ্গে ভাত খেলাম । খেয়েই বিছানায় একটু পিঠ লাগাতে ইচ্ছে হল। কালামের কাছ থেকে একটি বই ধার এনেছি পড়া হয়ে উঠেনি, দেখি আজকে শেষ করে ঘুমাব। কাল শুক্রবার, নো প্রবলেম। কালাম হারামজাদাটা বইটি ধার দিতে কেমন গড়িমসি করল অথচ আমার কাছ থেকে বই পড়তে নিয়ে সে আর ফেরত দেয়নি। তার মতো এমন অনেকেই আছে। স্কুলের পরীক্ষায় তাকে কত হেল্প করেছি। মনে নেই হয়তো। আমার সময় খারাপ যাচ্ছে তা শরতের আকাশের করুণা দৃষ্টির দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। চারদিকে যখন মাতাল হাওয়া বইছে হুমায়ূন আহমেদের মাতাল হাওয়া পড়তে পড়তেই কখন ঘুমিয়ে গেলাম টের পেলাম না।
নেও এখানে এক লাখ টাকা আছে। তোমার মার অপারেশনটা কইরা ফালাইও কেমন। এই টাকা নিয়ে অনেক টেনশন করেছ তুমি।
শানু ! বাড়ি ভাড়ার টাকাতো অনেক জমা হয়ে গেছে।
সেটাও দিয়ে দিছি ।
আমাকে আরো পনের হাজার টাকা দিও। দোকান বাকিটা দিয়ে দেই আর একটা স্মার্টফোন কিনব। তোমার বাবার তো অনেক টাকা । আমার চাকরি হলে সব শোধ করে দেব।
অবশ্যই শোধ করবা। তবে আমার কাছ থেকে নিয়েছ আমার কাছেই দিবা ঠিক আছে ? ইদানিং তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছ, ভোরে হাটাহাটি করবে, সিগারেট খাবেনা। সকালে একটা পরোটা আর একটা ডিম, দুপুরে এক প্লেট আর রাতে এক প্লেট ভাত খাবে কেমন। ফ্রিজে পাবদা আর শিং আছে ।
টাকা পয়সা হাতে থাকলেই খরচ করোনা। টাকা না থাকলে বুঝা যায় টাকা কি জিনিস! বাবার কাছ থেকে আনছি ঠিক আছে কষ্টও কম হয়নি। বুঝনা ভাইয়েরা এখন বিয়ে করেছে। জানি তোমার জীবন চলছে উইদআউট সুদ, তোমার চলতে কষ্ট হয়। তা সাময়িক , দেখ একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এই মেহরাব কেই আমি চেয়েছি এবং পেয়েছিও। এই মেহরাবকেই আমি আমার জীবন থেকেও বেশি ভালবাসি।
ঠিক আছে শানু। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই হবে গো জান ।
আমার মুচকি হাসি দেখে শানু আমার মাথার কাছে এস বসল। আমার কপালে হাত রাখল। এলোমেলো চুলগুলো টানতে লাগল। দেখলাম তার চোখে জল। আমি জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি মনে হল শরতের রাতও তার দুঃখে কাঁদছে । আকাশেও অন্ধকারের জল।
অনেকদিন পর শানুকে স্বপ্নে দেখেছি গতকাল। আমাকে একা করে দূর আকাশে চলে গেলেও প্রতিটি মুহুর্তে আমাকে শাসন করে বেড়ায় এখনো। বাবার অবাধ্য হয়ে আমাকেই ভালবেসে বিয়ে করেছিল। সিংহাসন একটাই ; রাজা আমি আর রাণী ছিল সেই। শেষ বার বিসিএস পরীক্ষার সময়ে দোয়া পড়ে আমার মাথায় ফু দিয়েছিল অদ্ভুত ভঙ্গিতে। প্রায়ই ইনবক্সে একটি এসএমএস পেতাম নামাজ পড়ব এখন, তোমার জন্য কি দোয়া করব বল ? তার নামের ফিক্সড ডিপোজিটের আমাকে নমিনি করে যায়। আমার জীবন অনেকটা পাল্টে যায়। আকাশের ইনবক্সে আমার ও তাকে একটি এসএমএস পাঠাতে ইচ্ছে করে-তোমাকে একনজর দেখার তৃষ্ণাটা মিটিয়ে দিয়ে যাও হৃদয়-রাণী! তুমি ছাড়া এই অন্ধকার সিংহাসনের রাজা থাকতে আমি চাই চাই না। চলে এস-একদিন তুমিই হেমন্তের বিকালে ঘাসের ওপর শুয়ে স্বপ্ন দেখেছিলে দুজনে মিলে হেমন্তের আকাশ-জমিতে একটি ফুলের বাগান করবে। আমি হব সে বাগানের মালী। কোদাল-কাঁচি প্রস্তুত। এপারে যানজট ; যানজট শেষ হলেই ফিরব তোমার সে বাগানে।’ আকাশের মাঝে তোমায় এখনো খুজি। ওপারে কেমন আছ আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে হৃদয়-রাণী! তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটিবার আদর করতে ইচ্ছে করে এখনো। অবুঝ মনটাকে কি করে বুঝাই ? তাই যাব অচিনপুর।
নোয়াগাঁও , দেবিদ্বার, কুমিল্লা