এক শিশি আতর



এক শিশি আতর
প্রকৌ. আমিনুল ইসলাম

আশিক চট্টগ্রাম যাবে। আগামীকাল তার এক বন্ধুর ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান। সে কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডে এলো। বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। বাসটি কাউন্টারের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আশিক বাসের সুপারভাইজারকে বলল, ‘ভাই বাস কখন ছাড়বে?’
‘স্যার, জলদি উঠেন। গাড়ি এখনই ছেড়ে দিবে।’
‘ভাই, পুরো গাড়ি ফাঁকা দেখছি।’
‘স্যার, আপনি সিটে গিয়ে বসেন, যাত্রী কম হলেও গাড়ি ছেড়ে দিবে।’
আশিকের সিট নম্বর ই-ফোর। সে তার সিটে গিয়ে বসলো। ই-ফোর হলো মাঝামাঝি সিট, যেখানে ঝাঁকুনি কম লাগে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অনেক লম্বা জার্নি। মাঝের সিট হওয়ায় সে একটু আরামে যেতে পারবে। তাছাড়া গাড়ি এক্সিডেন্টে মাঝের সিটে ঝুঁকি কম থাকে। বাসের সুপারভাইজার আশিকের কাছে এসে বলল, ‘স্যার, আজ যাত্রী কম, আরামে যাবেন।’
‘যাত্রী কম কেন, ভাই?’
সুপারভাইজার মাথা নিচু করে বলল, ‘জানি না, স্যার।’
সুপারভাইজার সবকিছু জানে। ইচ্ছা করেই কারণটি বললো না। যাঁরা এখন গাড়িতে বসে আছেন কারণটি জানলে তাঁরাও নেমে যাবেন। তখন ড্রাইভার আর হেল্পারকে খালি গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রাম যেতে হবে।
গতকাল এই বাস পরিবহনের মালিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। দুটি গাড়ি থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপার পুলিশের কাছে স্বীকাররোক্তি দিয়েছে যে এই মাদক পাচারে গাড়ির মালিক জড়িত আছেন। এই খবরটি আজ সকল পত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো হয়েছে। আশিক আজ পত্রিকা পড়ার সময় পায়নি। তাই বিষয়টি জানে না। যেসব যাত্রী টিকেট কেটেছিল তাদের বেশিরভাগই টিকেট ফেরত দিয়েছেন। তাই গাড়িতে অল্প কয়েকজন যাত্রী হয়েছে। পুলিশ জায়গায় জায়গায় বাস থামিয়ে চেক করছেন। অনেক যাত্রীর অভিযোগ আছে- পুলিশ তাদের হয়রানি করছেন। যাত্রীদের হয়রানির কথাগুলো একটি টিভি চ্যানেলে প্রচার করেছে। এখন যেসব যাত্রী বাসে বসে আছেন তারা কেউই খবরটি জানেন না।
বাসটি পাঁচজন যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। আশিক অবাক হচ্ছে- এই কয়েকজন যাত্রী নিয়ে বাসটি সায়দাবাদ থেকে যাত্রা শুরু করায়। বাসটি যাত্রাবাড়ী পৌঁছতেই পুলিশ থামিয়ে দিলো। রাস্তায় অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের একজন কনস্টেবল ও একজন অফিসার গাড়ির ভিতরে উঠলো। তারা সব যাত্রীকে তল্লাশি শুরু করলো। পুলিশ অফিসার আশিকের কাছে এসে বললেন, ‘আপনার ব্যাগ বের করে দেখান।’
আশিক তার মাথার উপর থেকে ব্যাগটি বের করে পুলিশের হাতে দিলো। পুলিশ অফিসার ব্যাগটি আবার আশিককে দিয়ে বলল, ‘ব্যাগটটি খুলে দেখান।’
আশিক তার ব্যাগ খুলে দেখাচ্ছে। পুলিশ ব্যাগের ভিতরে দুই-তিনটি কাপড় ও একটি বই পেয়েছেন। পুলিশের কনস্টেবল বলে উঠলো, ‘স্যার, এই লোকটা খুবই সন্দেহজনক। দেখেন তার চেহারাটা, চোর চোর ভাব। চোখগুলোও লালচে। মনে হয় ইয়াবা খোর।’
পুলিশ অফিসার আশিককে বললেন, ‘আপনার নাম কি?’
‘আশিক।’
‘শুধুই আশিক?’
‘আশিক চৌধুরী।’
‘আপনি হিন্দু না মুসলিম?’
‘দু’টো-ই।’
এবার পুলিশের কনস্টেবল জোরে বলে উঠলো, ‘স্যার, বলছিলাম না লোকটা সন্দেহজনক। কেউ কি হিন্দু-মুসলিম দুইটাই হতে পারে?’
পুলিশ অফিসার তাকে একটি ধমক দিয়ে বলল, ‘বাদল, তুমি একটু চুপ থাকো, ব্যাপারটা আমাকে দেখতে দাও।’
পুলিশ অফিসারের ধমক খেয়ে কনস্টেবল বাদল চুপ হয়ে গেল। তবে সে আশিকের ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, সে বেশিক্ষণ চুপ থাকবে না, সুযোগ বুঝে আবারও কথা বলবে।
কনস্টেবল বাদল এমনিতেই বেশি কথা বলে। এটি তার বহু দিনের অভ্যাস। কথা বলার সময় তার কোনো লাগাম থাকে না। পুলিশ অফিসার ব্যাপারটি জানেন। কয়েকদিন আগের একটি ঘটনা- একটি ছেলে থানায় এসেছে। কনস্টেবল বাদল ছেলেটিকে বলল, ‘তুমি কে?’
‘আমি পাশের কলেজের ভিপি।’
‘ও আচ্ছা। ছাত্র নেতা?’
‘জি¦।’
‘তুমি তো খুব রোগা-পটকা ছেলে, নেতা হইলা ক্যামনে?’
‘কি বললেন?’
‘বললাম, তুমি থানায় কেন এসেছো?’
‘ওসি স্যারের সাথে একটি মামলা নিয়ে কথা বলতে এসেছি।’
‘স্যার তো অফিসে নাই।’

ছেলেটির গালে একটি বড় দাগ আছে। এটি তার জন্মগত দাগ। এই দাগটির জন্য চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে।
কনস্টেবল বাদল ছেলেটিকে বলল, ‘তোমার গালের দাগটা মনে হচ্ছে চাপাতির কোপের দাগ। আল্লাহ বাঁচাইছে, কোপটা আরেকটু উপরে লাগলে কি যে হতো?’
‘মানে?’
‘মানে হলো- চাপাতির কোপটা যদি আরেকটু উপরে লাগতো তাহলে তোমার চোখ নষ্ট হয়ে যেতো। সবসময় আল্লাহ পাকের কাছে শুকরিয়া আদায় করবা। তিনি বড়ই মেহেরবান। তিনি চাননি তুমি অল্প বয়সে অন্ধ হয়ে যাও।’
‘এটি আমার জন্মগত দাগ। কেউ আমাকে কোপায় নাই। আপনি পুলিশ বলে মাফ পেয়ে গেলেন।’
বাদলের এইরকম অনেক ঘটনা আছে। সে কোথায় কি বলতে হবে জানে না। তবে মানুষটা কিন্তু ভালো।

পুলিশ অফিসার আশিকের পুরো শরীর তল্লাশি করে তার প্যান্টের পকেটে একটি সিগারেটের প্যাকেট পেল। তিনি প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে নাকে নিয়ে গন্ধ শুঁকছেন। এটি নিছক একটি সিগারেটের প্যাকেট। পুলিশ অফিসার সিগারেটের প্যাকেটটি তাকে আবার ফেরত দিলেন। তিনি আশিককে জিগ্যেস করলেন, ‘একজন মানুষ কি হিন্দু-মুসলিম দু’টো-ই হতে পারে?’
‘আমার মা হিন্দু। বাবা মুসলিম। তার মানে আমি দুটোই।’
‘আপনার মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নাই?’
‘না।’

আশিকের কাছে অবৈধ কিছু না পেয়ে পুলিশ অফিসার চলে যাচ্ছেন। অন্যদিকে কনস্টেবল মাথা ঝুকে আশিকের মুখের কাছে এলো। সে আশিকের মুখের গন্ধ শুঁকছেন। কনস্টেবল বলে উঠলো, ‘স্যার, লোকটাকে ছেড়ে দিবেন না। লোকটা বড়-ই সন্দেহজনক। মুখের গন্ধটা কেমন যেন লাগছে?’
পুলিশ অফিসার এবার তাকে আরো জোরে দমক দিলেন, ‘বাদল, তুমি বেশি কথা বলছো। তুমি নামো গাড়ি থেকে।’
‘দেখেন স্যার, লোকটা চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে ছাড়বেন না।’

পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবল বাস থেকে নেমে গেলেন। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। পুলিশের গাড়ি তল্লাশির কারণ আশিক এখনো জানে না। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার বন্ধু জাহিদকে ফোন দিলো, ‘দোস্ত, আমি বাসে উঠেছি। চট্টগ্রাম আসতে রাত এগারো-বারোটা বাজতে পারে। সমস্যা নাই তো?’
‘তোর যত রাতই হোক, কোন সমস্যা নাই। তুই বাসের ড্রাইভারকে বলবি, জিইসি মোড় নামিয়ে দিতে। আমি জিইসি মোড়ে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকবো।’
‘আচ্ছা।’
সে জাহিদের সাথে আলাপ শেষ করে মোবাইলে একটি অনলাইন পত্রিকা পড়ছিলো। হঠাৎ একটি লেখায় তার চোখ আটকে গেলো- ‘প্রজাপতি পরিবহনের মালিক হানিফ গ্রেপ্তার।’ এটির নিচে ছোট করে লেখা আছে, ‘আজ থেকে প্রতিটি গাড়িতে চিরুনি তল্লাশি হবে, প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ পুরো প্রতিবেদনটি পড়ে আশিক আসল ঘটনা বুঝতে পারলো। যাত্রী কম হওয়ার বিষয়টিও তার পরিস্কার হয়ে গেল।
আশিক বাসের যাত্রী গুনে দেখলো মাত্র পাঁচজন। সে বাদে আরও চার জন যাত্রী আছে। মাত্র পাঁচজন নিয়ে একটি বাস চট্টগ্রাম যাচ্ছে। এমনটি সচরাচর দেখা যায় না।


আশিক খুব ক্লান্ত। তার দু’চোখে রাজ্যের ঘুম। রাতে তার ভালো ঘুম হয় নি। তার উপর সকাল আট’টায় গাজীপুর থেকে রওয়ানা দিতে হয়েছে। তাই বাসের সিটে হেলান দিতেই তার ঘুম এসে গেল।
একটু পর বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির পানি জানালা দিয়ে বাসের ভিতরে ঢুকছে। এতে আশিকের ঘুম ভেঙে গেল। সে জানালা লাগিয়ে দিলো। বাসটি এখন কোথায় এসেছে তা বুঝতে পারছে না। বৃষ্টির কারণে বাহিরের কিছু ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। তবে গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটছে। আশিক মোবাইল বের করে গুগল ম্যাপে লোকেশন দেখলো গাড়িটি এখন দাঊদকান্দি অতিক্রম করছে। হাতের ঘড়িতে সময় দেখে সে বুঝতে পারলো- গাড়িতে দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছে। টানা অনেকক্ষণ অঝরে বৃষ্টি হওয়ায় আশিকের হালকা একটু শীতও লাগছে।
বাসের পিছনের সিট থেকে একজন লোক এসে আশিকের পাশে বসলো। সে লোকটিকে দেখে অবাক হলো। আগে এই লোকটিকে সে বাসে দেখে নি। লোকটির শরীর থেকে তীব্র আতরের গন্ধ আসছে। তাঁর গায়ে সাদা আলখেল্লা, মাথায় সাদা টুপি, মুখে লম্বা সাদা দাঁড়ি। লোকটিকে দেখতে অনেকটা পীরের মতো লাগছে।
আশিক পুরো গাড়ির যাত্রী গুনে দেখলো, এখন ছয়জন যাত্রী। তার মানে লোকটি বাড়তি লোক। আশিক ভাবছে, লোকটি কখন বাসে উঠলো?
লোকটি আশিকের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘আস্সালামু আলাইকুম।’
আশিক উত্তর দিলো, ‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম।’
‘আমার জানালা ঠিক মতো লাগানো যাচ্ছে না। বৃষ্টি ঢুকছে। তাই আপনার পাশে বসলাম। কোন সমস্যা নাই তো?’
‘না। কোন সমস্যা নাই।’
‘আমি সিদ্ধেশ্বরী থেকে উঠেছি। আপনাকে তখন ঘুমাতে দেখেছি। আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। আপনি কোথায় যাবেন?’
‘আমিও চট্টগ্রাম যাবো।’
‘ভালোই হয়েছে দুইজন কথা বলতে বলতে চলে যাবো।’
‘জি¦।’
‘ভাইজান, মাগরিবের সময় হয়েছে কি?’
‘জানি না।’
‘আপনার ঘড়িতে কয়টা বাজে?’
‘ছয় টা দশ।’
‘তাহলে নামাজের সময় হয়ে গেছে। আমি তিন রাকাত নামাজ পড়ে আপনার সাথে আলাপ করবো।’
আশিক ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো। লোকটি গাড়ির সিটে বসেই নামাজ পড়ছেন। আশিক তার নামাজ পড়া দেখছে। লোকটি নামাজের সালাম ফিরিয়ে দেখলেন আশিক তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি আশিককে বললেন, ‘আমার নামাজ পড়া পছন্দ হয়েছে?’
আশিক মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিল।
লোকটি এবার বললেন, ‘আপনি নামাজ পড়বেন?’
আশিক ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না-সূচক উত্তর দিলো।
লোকটি আশিককে বললেন, ‘শুনুন ভাই সাহেব, নামাজ হলো বেহেশতের চাবি। নামাজ ছাড়া কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। সময় মতো নামাজ পড়বেন।’
সুপারভাইজার এসে বলল, ‘আমরা হোটেল বিরতিতে চলে এসেছি।’ এখানে মাত্র বিশ মিনিটের বিরতি। আমাদের গাড়ি নম্বর শূন্য সাত সাত সাত। আপনারা বিশ মিনিটের মধ্যে গাড়িতে ফিরে আসবেন।’

আশিকের পাশে বসা সাদা আলখেল্লা পরিহিত লোকটি উঠে পিছনে চলে গেলেন। আশিক গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। এই সময় ভারি খাবার খাওয়া যায় না। তাই আশিক পরোটা ও সবজির অর্ডার দিলো। সে খেতে খেতে ভাবছে, আলখাল্লা পরিহিত লোকটিকে নাস্তা খেতে ডাকা উচিত ছিল। চট্টগ্রাম পৌঁছাতে আরো কমপক্ষে তিন-চার ঘন্টা লাগবে। লোকটা কি ততক্ষণ না খেয়ে থাকবে?
আশিক হালকা নাস্তা সেরে গাড়িতে ফিরে এলো। সে লোকটিকে আর গাড়িতে দেখতে পাচ্ছে না। সে ভাবছে লোকটি হয়তো কিছু খেতে নিচে নেমেছেন।
গাড়ির সুপারভাইজার ড্রাইভারকে বলল, ‘উস্তাদ সবযাত্রী চলে আইছে। গাড়ি ছাইড়া দেন।’
আশিকের মনে প্রশ্ন এলো, একটি লোক গাড়িতে নেই, তবু সুপারভাইজার বলছে সব যাত্রী চলে এসেছে। এটি কি করে সম্ভব?
সে লোকটির জন্য চিন্তা করছে। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। আশিক যখনই সুপারভাইজারকে কিছু বলতে সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো, ঠিক তখনই লোকটিকে পিছন থেকে আশিকের কাছে আসতে দেখলো। তিনি আশিককে প্রশ্ন করলেন, ‘আমাকে খুঁজছেন?’
‘জি¦।’
‘আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘গাড়িতে।’
লোকটির কথা শুনে আশিকের কেমন যেন লাগছে। কিছুক্ষণ আগেও লোকটি ছিল না। তাহলে লোকটি কে?
লোকটি আবারও আশিকের পাশে বসলো। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘আমি তো আপনাকে গাড়িতে দেখতে পাই নাই।’
‘আমি পিছনেই ছিলাম।’
আশিক আবারও আতরের গন্ধ পাচ্ছে। ভয়ে তার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।
লোকটি আশিককে বলে উঠলো, ‘ভাই, আতর দিবেন? দামী আতর। মক্কার আতর। বড়ই পবিত্র জিনিস।’
‘আমি আতর দেই না।’
‘আরে ভাই, এটি সাধারণ আতর না।’
আশিক বলল, ‘আমি একটি বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। আতর দেয়া ঠিক হবে না।’
‘এটি সাধারণ আতর না।’
‘তা বুঝতে পেরেছি।’
‘আপনি কখনো আতর দেন নাই?’
আশিক বলল, ‘ছোট বেলায় প্রতি শুক্রবার দাদার সাথে জুমার নামাজ পড়তে যেতাম। তখন আতর দিতাম। দাদা মারা গেছেন দশ বছর আগে। তারপর আর আতর দেই নি। তাছাড়া আমার মা আতরের গন্ধ পছন্দ করেন না।’
‘কি বলেন! আতর সব মুসলিমই পছন্দ করে।’
‘আমার মা একজন হিন্দু। হিন্দু ধর্মে আতরের ব্যবহার নাই।’
‘তাহলে আপনিও কি হিন্দু?’
‘আমি হিন্দু-মুসলিম দুটোই। কারণ আমার বাবা মুসলিম, মা হিন্দু। আমি দুটি ধর্মের রীতিনীতি জানি।’
‘এক সঙ্গে দুটি ধর্ম পালন করা যায় না। আপনাকে একটি গ্রহণ করতে হবে, আরেকটি বাতিল করতে হবে।’
‘আমার কাছে মা যেমন, বাবাও তেমন। কাকে বাদ দিবো?’
‘বাবা-মাকে বাদ দিতে বলি নাই। ধর্মের কথা বলেছি।’
‘আমি এতো কিছু বুঝি না। আমি আমার মতো থাকতে চাই।’

আশিকের কথা শুনে লোকটি অবাক হলেন। তিনি দীর্ঘ শ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘কি আজব দুনিয়া এলো। স্ত্রী হিন্দু আর স্বামী মুসলিম, ছেলে দুটোই। এটা কি করে হয়?’
লোকটি এক শিশি আতর বের করে আশিককে দেখিয়ে বললেন, ‘এই আতর কিছুদিন আগে মক্কা থেকে এনেছি।’
আশিক বলল, ‘আপনি মক্কা গেছেন?’
‘হ্যাঁ। অনেকবার গেছি। পবিত্র শহর।’
লোকটি তার আলখেল্লায় আতর লাগাতে লাগাতে বলে যাচ্ছেন, ‘এই আতর সাধারণ আতর না।’
হঠাৎ বাসটি হার্ড ব্রেক করলো। আশিকের শার্টে পুরো এক শিশি আতর পড়ে গেলো।
লোকটি আশিকের হাত ধরে বললেন, ‘আমি দুঃখিত ভাই। সব আতর আপনার গায়ে পড়ে গেল। তবে এই আতর সাধারণ আতর না।’
‘দুঃখিত হচ্ছেন কেন? আপনি তো ইচ্ছা করে ফেলেন নি।’
‘ভাই, গাড়িটা ব্রেক না করলে পড়তো না।’
‘সমস্যা নাই। আমি চট্টগ্রাম নেমে আরেকটি শার্ট পরে নিবো।’

আতরের গন্ধে আশিকের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আতরের গন্ধটি তার ভালো লাগতে শুরু করলো। আতরটির গন্ধ তীব্র হলেও অসাধারণ লাগছে।
আশিকের পাশে বসা লোকটি একটি তসবিহ হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে জিগির করছেন। তসবিহর দানাগুলোও সাদা রংয়ের। আশিক ভাবছে, লোকটির মধ্যে নিশ্চয় আধ্যাতিœক কিছু আছে।
আশিক চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। বাহিরে তখনো প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিলো। এমন বৃষ্টিতে ঘুমাতে ভালোই লাগে। তবে বাসায় কাঁথা মুড়িয়ে ঘুমাতে পারলে বেশি ভালো হতো। আশিক গাড়ির সিটে হেলান দিতেই ঘুম এসে পড়লো।
হঠাৎ তাদের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাছের সাথে ধাক্কা লাগলো। তখন গাড়ির গতি ছিল প্রায় আশি কিলোমিটার। ভেজা রাস্তায় বেশি গতিতে গাড়ি চালানো উচিত নয়। এতে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই কঠিন। গাড়িটি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়লো। আশিক তখন ঘুমিয়ে ছিল। সে চোখ খুলেই দেখলো গাড়ির চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। সবাই গাড়ির ভিতরের মানুষদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। আশিক আলখেল্লা পরিহিত লোকটিকে আর দেখতে পাচ্ছে না।
লোকজন সব যাত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আশিকও হাসপাতালে এলো। তবে তার একটুও আঘাত লাগেনি। তার কোন চিকিৎসারও দরকার হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের বলছেন, ‘দুইজন যাত্রী মারা গেছেন, আর দুইজন মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে আছেন। আর একজন সৌভাগ্যবানের কোন আঘাত লাগেনি।’
বাসটির ড্রাইভার ও সুপারভাইজার পালিয়ে গেছে। বেশিরভাগ এক্সিডেন্টের ক্ষেত্রেই তারা পালিয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালানোর জন্যই বাসটি এক্সিডেন্ট হয়েছে।
আশিকের কোন আঘাত লাগেনি দেখে হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্স বিস্মিত হলেন। ডাক্তার সাহেব আশিককে বললেন, ‘আপনি খুব ভাগ্যবান মানুষ। এতো বড় এক্সিডেন্ট হলো অথচ আপনার কিছুই হলো না।’
আশিক আলখাল্লা পরিহিত লোকটিকে খুঁজছে। যে দুইজন মারা গেছেন সেখানে লোকটির লাশ নেই। আবার যে দুইজন যাত্রী আইসিইউতে আছেন সেখানেও লোকটি নেই। সে লোকটির ব্যাপারে কাউকে কিছু জিগ্যেস করতে পারছে না।
এক সময় আশিক ভাবছে, আসলেই কি আলখেল্লা পরিহিত কোন লোক বাসে ছিল? নাকি এটি তার স্বপ্ন ছিল?
সে বাসের সব ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছে। তার অনেকক্ষণ ঘুমানোর কথা মনে পড়ছে। ঘুমের মধ্যে মানুষ অনেক বিচিত্র স্বপ্ন দেখে। এটি হয়তো একটি স্বপ্নই হবে।
আশিক হাসপাতালের আইসিইউতে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে। একজন নার্স আশিককে বললেন, ‘ভাই, আপনি একটু বাহিরে যান।’
আশিক সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো, ‘কেন?’
নার্স বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আপনার শরীর থেকে আতরের গন্ধ আসছে। আতর দিয়েছেন, ভালো কথা, তাই বলে এতো আতর দিবেন? খুব গন্ধ আসছে। আপনার আতরের গন্ধে কেউ থাকতে পারছে না।’
আশিকের মনে পড়লো লোকটির আতরের কথা। লোকটি এক শিশি আতর তার শার্টে ফেলে দিয়েছিল। আশিক বুকের কাছে নাক নিয়ে আতরের গন্ধ শুঁকছে। সে বলে উঠলো, ‘তাইতো! আতরের গন্ধ। সেই আতর।’
আশিক এখন বুঝতে পেরেছে লোকটি সত্যিই ছিল। কিন্তু সে লোকটির রহস্য উদঘাটন করতে পারছে না।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট