আঘাত
আহমদ মেহেদী
বুলবুলের কারনে আজ দুদিন ধরে টানা বৃষ্টি । যেন আকাশ আজ বড্ড বেশি অভিমানী। রবিবার অফিস বন্ধ থাকলেও বাড়িতে যেতে পারিনি । বিদ্যুৎ না থাকায় অফিসের শনিবারের কাজ এখনো শেষ করতে পারিনি । পাশের মসজিদে মাগরিবের আজান হচ্ছে। বুয়াও আজ আসবে না বলে গেছে। স্মার্টফোনের টর্চ লাইটে আজকের পত্রিকা পড়তে শুরু করলাম । এমন সময় মোবাইল বেজে উঠলো।
-আস সালামু আলাইকুম সোহান ভাই , কেমন আছেন ?
-ভাল । আপনি কেমন আছেন?
-আছি ভাই কোনরকম, আপনার মেয়ের কি খবর ? ভাবির স¦াস্থ্য ভালোতো?
-একটা সমস্যায় পড়ে গেছি ভাই। আমার মেয়ের ফরম ফিলাপ করাতে হবে । টাকাটা দিতে পারবেন?
-গত সপ্তাহে বলেছিলাম এই মাসে বেতন পেয়ে দেব। আপনিতো কিছু বল্লেন না।
-তখনতো তো ভাই মেয়ের ফরম ফিলাপের কথা মাথায় আসেনি । তাছাড়া আর মাত্র দুদিন বাকি । বুজছেনইতো ভাই সবারই সংসার ধর্ম আছে ।
-আচ্ছা দেখি ভাই।
-দেখি-টেখি না, টাকাটা দিয়ে দিয়েন, পরে লাগলে আবার নিয়েন।
-ঠিক আছে ভাই ।
তার কথায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে আমার । আজকে মাসের দশ তারিখ । বেতন পেতে আরো বিশদিন লাগবে। মোবাইলেরও চার্জ যাই যাই করছে। বারান্দায় পাতা চেয়ারে আনমনে বসে আছি। এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। ভাবছি কী করা যায়। আবার কার কাছে ধার চাইবো, এভাবে ধার চাওয়ার কবে যে অবসান হবে? সৎভাবে বেচে থাকতে চাইলে কি এমন হয় মানুষের ? গত পরশুদিনও তার সাথে এ ব্যপারে কথা হয়েছে । কই তখন তো সে এমন করে বলেনি । বলেছিল এই মাসে বেতন পেয়ে দিলেও চলবে। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা এই মুহুর্তে।
রাত একটা বাজে । চোখে এক ফোঁটা ঘুম নেই । মোবাইলেরও চার্জ শেষ । মশাড়ির ভেতর একজন নির্ঘুম মানুষের ছটফট করা ছাড়া কিছু করার নেই। ক্ষিধেও লেগেছে খুব। মেসে দুপুরের ডাল আর ঠান্ডা ভাত অবশিষ্ট কিছু নেই।পরের দিন আমার স্কুল জীবনের বন্ধু খাদিজাকে কল দিলাম।
-কেমন আছ খাদিজা ?
-ভাল, তোমার কি অবস্থা? তাবাসসুম কেমন আছে ?
-ভালো। রিফাত কেমন আছে ?
-আছে ভালো, দোয়া করো কেমন । সে তো তোমার খুব ভক্ত । তুমি তাকে সাইকেল চালানো শিখালে।
-তাই বুঝি।
-হুম। এস ,আমার বাসায় একদিন বেড়িয়ে যাও। রিফাতের বাবা ইলিশ মাছ দিয়ে ফ্রিজ ভরে ফেলেছে।
-আচ্ছা, আসব। একটা কথা বলতাম তোমাকে ?
-হ্যাঁ , বলে ফেল । কোন সমস্যা?
-হ্যাঁ, তোমার কাছে দশ হাজার টাকা হবে , আমি বেতন পেয়ে তোমাকে দিয়ে দেব !
-টাকা লাগবে তোমার? কখন লাগবে ?
-দুএকদিনের মধ্যে দিলেই হবে ।
-এইতো ভাল হইছে , এটার অজুহাতে তো তুমি আমার বাসায় আসতে পার । কতবার বললাম তুমি তো এলেনা। বিকাশ-টিকাশ করতে পারব না । তুমি এসে নিয়ে যাও তাছাড়া রিফাতের জন্যে হলেও আস।
-ঠিক আছে যাব।
-কথা দাও, তোমারতো আবার ঠিক নাই । এখন বলবে আসবে পরে দেখা যাবে আর কল রিসিভই করবে না।
-কথা দিলাম।
কিছু কিছু সময়ে কথা দিয়ে দিতে হয় । জীবনে প্রথম খাদিজার কাছে টাকা চাইলাম । সোহান ভাইয়ের টাকাটা দিয়ে দিলাম। বুকের ভিতরটা কেমন জানি চিন করে উঠলো । তার এমন ব্যাবহার তো আগে দেখিনি । আমার মা-ই তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে , আমাদের বাড়িতে থেকেই সে লেখাপড়া করেছে । ছেলেবেলায় দেখতাম আমার বাবার দোকান থেকে সে কলেজে যাওয়ার সময় টাকা পয়সা নিতো । তখন বাবার ব্যাবসাও ভাল ছিল। সোহান ভাই কি এইসব অতীত ভুলে গেছে ? ভিতরের এই আঘাতটার কথা কাউকে বলতে পারছিনা আমি।বলতে পারলে নিজেকে একটু হালকা লাগতো। একদিন আমার বাবার ও যে পকেট ভর্তি টাকা ছিল। তখনও কাচা হলুদ রঙা রোদ হেসে বেড়াত, আমি তখন এমন বৃষ্টির দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।
নোয়াগাঁও, দেবিদ্বার, কুমিল্লা