ফাঁদ



ফাঁদ
মনিরা মিতা 

রাখালপুর গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তের কোলঘেষে মাসুমদের ছোট্ট কোণঠাসা বাড়ী। মাসুমের মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে পরিবারের জন্য সামান্য আয় করতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয়।
কত ভিটায় নতুন ঘর ওঠে, কত জনের ভাগ্য ফেরে, শুধু পরিবর্তন হয় না কাল প্রবাহে খড়-কুটার মত ভেসে বেড়ানো মজিদ যোদ্ধার জীবন। কালেভদ্রে এক আধটুকু হাসি ফোঁটে তার মুখে, ঘর সংসারের চিন্তায় তার মাথা সর্বদাই ঝুঁকে থাকে। তবে ইদানিং সে স্বপ্ন দেখে তার ছেলে মাসুম অদৃষ্টের দু:খ খন্ডাবে, ছেলে এবার এইচএসসি পাস করেছে।
হ্যাঁ, অনেক কষ্টে এ পর্যন্ত এসেছে মাসুম, পড়াশোনা আর চালানোর সাধ্য তার দরিদ্র পিতার নেই, তা তার অজানা নয়। মাসুম আর তা আশাও করে না। শুধু স্বপ্ন দেখে ছোট ভাইকে মানুষ করবে, বোন দুটোকে ভাল ঘরে বিয়ে দেবে, বাবা - মায়ের বৃদ্ধ বয়সের লাঠি হবে।
বেশ কিছুদিন ঢাকা এসেছে মাসুম একটা চাকরীর খোঁজে। কিন্তু চাকরী সেটা যে সোনার নয় হীরার হরিণ। জ¦লন্ত আগুন হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যতোটা না কষ্ট তার চেয়েও অধিক কষ্ট একটা চাকরী হাতের মুঠোয় বন্দি করা তাও আবার এইচএসসি পাশ করে।
দ্বিধা - জড়তা নিয়ে মাসুম যখন কুঁকড়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ এক বন্ধুর মামার সাথে পরিচয় হয়, যে কিনা বিদেশে লোক পাঠায় কম খরচে। খবরটা জানার পর থেকে চিন্তার ঘন কুঁয়াসায় ডুব দেয় মাসুম। মাথায় ঘুরপাক খায় অসংখ্য চিন্তা। এই জরাজীর্ণ জীবন থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠে সে।
অনেক আশা নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে মাসুম। ছেলের মুখে স্বপ্ন পূরনের কথা শুনে মজিদ মিয়ার বুকও উথাল-পাথাল করে। কিন্তু পরক্ষণে একটা ক্ষোভ দীর্ঘশ্বাস আকারে নেমে যায় মজিদ মিয়ার বুক চিরে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে কতজন মাসে মাসে সরকারি ভাতা হাতিয়ে নিচ্ছে অথচ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে সে সবকিছু থেকে বঞ্চিত। টাকার অভাবে নিজের ওষুধের টাকাই সে জোগাড় করতে পারে না আর ছেলের বিদেশ যাওয়ার এতো টাকা সে কোথা থেকে জোগাড় করবে? অবশেষে স্বপ্ন-বাস্তবের দোলায় দুলতে দুলতে মজিদ মিয়া সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেকে সত্যিই বিদেশ পাঠাবে। যদিও এ জন্য খোয়াতে হবে তার শেষ সম্বল, এক টুকরো জমি। বাবার মুখে বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন সত্যি হবে জেনে ঢাকা আসে মাসুম। অতি দ্রুত ঠিক করে ফেলে দুবাই যাওয়ার সব ব্যবস্থা। বন্ধুর মামা, তাই মাত্র দুই লক্ষ টাকায় সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। পাসপোর্টসহ নানা ফরমালিটি শেষ করে গ্রামে ফিরে আসে মাসুম।
ওদিকে মজিদ মিয়া চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু খুইয়ে জোগাড় করল ছেলে স্বপ্ন পূরনের ভিসা। সুতরাং নির্ধারিত সময়ে বাবা-মা ভাই-বোনকে শুভ বিদায় জানিয়ে সুখের ঠিকানায় পাড়ি দিল মাসুম।
তারপর...।
ছয়মাসে পার হল। আজ অসহায়ের মত বিমান থেকে ছেঁড়া কাপড় পরে নামল মাসুম। চোখে দুটো তার অথৈ সমুদ্র, সেখানে টলমল করছে বঞ্চিত-নিপিড়ীত হওয়ার জল।
দুবাই পৌঁছেই পুলিশের হাতে বন্দি হয় মাসুম। কারণ সে গলাকাটা পাসপোর্ট আর নকল ভিসা নিয়ে দুবাই এসেছে। হঠাৎ এক ঢেউয়ের তীব্র ঝাপটায় ডিঙ্গি উল্টে যাওয়ার মতই উল্টে যায় মাসুমের জীবন। ছয় মাসের জেল হয় তার। কারাগারের অন্ধকারে মাসুমের বারবার ভেসে ওঠে বাবা মায়ের করুন সুখ, অথচ সে নিরুপায়।
বাংলাদেশে পৌঁছে শ্রান্ত-ক্লান্ত মাসুম কি করবে ভেবে পায় না। বাড়ীর সবাই যে পথ চেয়ে আছে তার। বাবা শেষ সম্বল হাতে তুলে দিয়েছিলেন। একটু সুখের খোঁজে কি করে সব হারিয়ে বাবার সামনে যাবে মাসুম? কৃষ্ণপক্ষের গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেছে মাসুমের জীবন। মাকড়শার জালে মাছি যেমনি আটকা পরে তেমনি মাসুমও বন্দি, তবে মাকড়শার নয় লোভের ফাঁদে। আর সে লোভের বলি হয়েছে মাসুমের সর্বহারা পরিবার।

শিরোমনি,খুলনা


শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট